হাসনাত মোবারক
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪ ১২:৫৭ পিএম
২০১৪ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে যুদ্ধদিনের গল্প শোনান গোলাম মোস্তফা
‘কানসোনার কাজলরেখা শিশু-শিক্ষার পাতায় যে স্বপ্ন খুঁজেছিল এ বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে সেই স্বপ্নের আলোছায়ার জগৎ স্পর্শ করেছি কখন তা জানি না, কানসোনার গ্রাম ’৮৭-এর প্রদীপের আঁধার থেকে এখন বিদ্যুৎ আলোয় ঝলমল, তার পেছনে প্রতিবেদনের ফসল আছে। মোনাজাতউদ্দিন সেখানে হলধর।’ এ কথাগুলো লিখেছিলেন সন্তোষ গুপ্ত মোনাজাতউদ্দিনের ‘কানসোনার মুখ’ বইয়ের ভূমিকায়।
কৌতূহল জাগতে পারে। কোথায় এ কানসোনা? সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম কানসোনা। ওই গ্রামের কয়েকজন স্বপ্নবাজ যুবকের গড়া মুক্ত নাটক দল। তাদের পাণ্ডুলিপিহীন নাটকের কাহিনীতে কেউ সেজেছিলেন শোষক, জোতদার, মহাজন, টাউট, বদমাশ; কেউ বা ক্ষুদ্র চাষি, বর্গাদার, ভূমিহীন মজুরের ভূমিকায়। সে নাটক ঘিরে
মোনাজাতউদ্দিন কানসোনা গ্রামের জীবনচিত্রের ওপর প্রতিবেদন করেছিলেন। যেটা সারা দেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ওই মুক্ত নাটক দলের স্বপ্নবান যুবকদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা। এ বীর যোদ্ধা কৈশোর পেরোনোর সময়ই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দেশের মানুষের মুক্তি এনে দিয়ে ক্ষান্ত নন। চালিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক আন্দোলন। এ প্রজন্মের কাছে তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্পের দাদু’ হিসেবে পরিচিত। নয় বছর যাবৎ এ বীর যোদ্ধা স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের জানাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। জানাচ্ছেন সম্মুখসমরের ঘটনা। বর্ণনা করছেন যুদ্ধদিনের নানান ঘটনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গিয়ে টিফিন বা ক্লাসের ফাঁকে এ অনন্য কাজটি করেন। এখন পর্যন্ত উল্লাপাড়া উপজেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কলেজসহ দেড়শতাধিক
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন। এজন্য তিনি নেন না কোনো পারিশ্রমিক। তার এ উদ্যোগ সম্পর্কে কথা হয় উল্লাপাড়ার এইচ টি ইমাম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক রশিদ আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা নিজের খরচে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান। কেউ লাঞ্চ করাতে চাইলেও করেন না।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফার কাছে এ উদ্যোগের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী চক্র প্রকৃত ইতিহাস আড়াল করে নিজেদের স্বার্থচরিতার্থের জন্য যোগ করে ইতিহাসের ভিন্ন চিত্র; যা পরবর্তী সময়ে দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। এটি আমার চেতনায় নাড়া দেয়। কিন্তু অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ না থাকায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ হয়নি। ২০১৪ সালে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানোর কাজটি শুরু করি।’
১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই বীর যোদ্ধা। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে প্রবল দেশপ্রেম। ’৭১-এ দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য সতীর্থদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন উল্লাপাড়া সরকারি আকবর আলী কলেজে। সেখান থেকে করেছেন বিএ পাস। এর পর থেকে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রেখেছেন নিজেকে। আর এজন্য তিনি এলাকার মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা কুড়াচ্ছেন।
তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বীজ বপন করতে নিরন্তর ছুটে চলছেন। ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফার গল্প শুনে কতটুকু উপকৃত হয়েছেন?’ এমন প্রশ্ন করা হয় সরকারি আকবর আলী কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলামকে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা তো বইপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়েছি। কিন্তু উনি ক্লাসে এসে যখন গল্প বলেন, উনার যুদ্ধের বর্ণনা শুনে মনে হয় আমরাও যুদ্ধে উপস্থিত আছি।’
তার বলা মুক্তিযুদ্ধের গল্পে অনুপ্রাণিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বীর যোদ্ধার আশাÑনতুন প্রজন্ম জেগে উঠবে। শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে দেখেন আগামীর বাংলাদেশ।