× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শহীদ স্বজনের শোকগাথা

আব্বার পুনর্জন্ম

সালাহউদ্দিন আহমেদ সেলু

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৪ এএম

আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১৫:২১ পিএম

আব্বার পুনর্জন্ম

রিকশায় আমরা, আম্মা শক্ত করে পেট ধরে আছেন। কাদামাটির পথ, দাদাবাড়ি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সাচাইল গ্রাম, তাড়াইল। রিকশার চাকা গর্তে পড়তেই আম্মা ঝাঁকি খেয়ে হাত ছেড়ে দিলেন। আমি এক লাফে রিকশা থেকে নেমে দৌড়াচ্ছি, প্রাণপণ দৌড়, সমস্ত শক্তি দিয়ে। শৈশব মনে হলে, আব্বাকে মনে হলে সে দৌড় চোখে ভাসে।

বিশ্বাস করেছিলাম আব্বার কবর দেখব। জুতার সামনের অংশে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আব্বার কবর দেখছি বাঁ থেকে ডানে, বড় বড় ঘাস হয়েছে। পেছন থেকে আমার ঘাড়ে ভারী হাত পড়ল, ফিরে দেখি মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া চাচ্চু। বললেন, এ তোমার দাদার কবর। প্রচণ্ড নিরাশ হলাম, হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বার কবর কই? বললেন কেউ জানে না। হতাশ হলাম কি না বুঝলাম না, গলা ভরে দুই কানে চাপ লাগছে, বুঝতে পারছি ভেতর থেকে কান্নার স্রোত উপচে উঠছে। দুই চোখে অনর্গল পানি ঝরছে। চাচ্চু আমায় কোলে নিলেন, চোখ মুছলেন। বললেন, সংগ্রামের সময় পাক বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। তারপর খবর নেই- আছেন না মারা গেছেন। তখন কিছুই বুঝিনি-সংগ্রাম, পাক বাহিনী। হতবিহ্বল হয়ে শুনলাম। বুঝলাম আব্বার কথা সহজে বলা যাবে না। বড় বেদনার অধ্যায়।

পরিবারে আব্বার প্রয়োজন কী বুঝিনি। আম্মা সকালে স্কুলে যেতেন। ১১০ টাকা মাসহারায় শিক্ষকতা শুরু, বিকালে ফিরে বারান্দায় বসে গালে হাত রেখে মাগরিবের আজানের অপেক্ষায় থাকতেন। দিনের শেষে পড়ন্ত বিকালের বিস্বাদ আম্মার মুখাবয়বে স্থান করে নিত। আম্মার দিকে তাকাতে পারতাম না। বুক ভেঙে কান্না আসত। চার ভাইবোনকে বইতে আম্মার কষ্ট হচ্ছিল বুঝতাম। কিন্তু মজবুত চোয়ালে দাঁতে দাঁত পিষে আম্মা পড়াতে বসতেন। নিয়মিত রুটিন, বছরের পর বছর। যখনই বাইরে যেতে শুরু করেছি তখনই ‘বাবা’র প্রয়োজন নজরে আসে। সঙ্গে নিয়ে বাজারে যাওয়া, আবদারের মানুষ, সহাস্যবদনে আবদার পূরণ, মাথার চুলে পরম মমতায় হাত বোলানো, কিছু হলেই ছেলের নিরাপত্তায় বাবাদের এগিয়ে আসা, বারবার সাবধান করা, বাবা যেন আসমানের মতো, সদাসর্বত্র নিরাপত্তা, রোদ-বৃষ্টি-মেঘে মাঝে মাঝে ঢাকা থাকে তবে উপস্থিতি বোঝা যায়। এগুলো এত মনে রাখত- একা একা বসে কাঁদতাম।

শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুদ্দীন আহমেদ

একান্নবর্তীর আসরে কদাচিৎ আব্বার গল্প হতো, পূর্ণিমায় নৌকায় ভেসে বেড়ানো, বুনোহাঁস শিকারে বেরিয়ে পড়া, আয়োজন করে কাজী নজরুলের গান, শেকস্‌পিয়রের সংলাপ, হাসি-আনন্দে মামা-খালারা বিভোর হতেন। চার মামাই আব্বার অসম্ভব ভক্ত। ছোট মামা নাটকীয়ভাবে আব্বার হাঁটা দেখাতেন। বড় মামা নাকি শতভাগ কপি করতেন। আলমগীর মামার সঙ্গে প্রচণ্ড ঘনিষ্ঠতা ছিল আব্বার। এমন 

প্রিয়জনকে হারিয়ে পরিবারের সবাই দ্রুত ভুলতে চাইলেন, তা-ই হলো। আব্বার অনুপস্থিতিতে বড়রা সবাই বাবার শাসনের দায়িত্ব পেলেন যেন। পরিস্থিতি এমন হলো, আব্বা বিষয়ক আগ্রহ প্রকাশ করার কোনো সুযোগ থাকল না।

তাড়াইলের বেশির ভাগ জমি রাজাকাররা দখলে নিচ্ছে- এমন খবরে আম্মা সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়ে তটস্থ হয়ে যতটুকু জমিভিটা বিক্রি করা যায় করলেন। তাড়াইলের অধ্যায় তাতে বন্ধ হয়ে যায়, যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। আব্বাও আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে থাকেন। এর মধ্যে একবার তাড়াইলে গিয়ে শুনি আব্বা রাওয়ালপিন্ডি জেলে রয়েছেন, সেখান থেকে এক হাজজি পালিয়ে দেশে ফিরেছেন, তার সঙ্গে নাকি আব্বার কথা হয়েছে। এমন খবর মামাদের কানে তুললে তেমন গুরুত্ব পায় না।

আব্বার অস্তিত্ব দিন দিন ক্ষীণ হতে থাকে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে আম্মা, আমরা অপেক্ষায় থাকি মহকুমা-জেলা প্রশাসনের আমন্ত্রণপত্রের। কিন্তু অদ্যাবধি ৫২ বছরেও আসেনি। আব্বা শহীদ হয়েছেন জেনেও কোনো প্রমাণপত্র নেই। আম্মাও কখনও জানাননি আব্বা বিষয়ক কিছু। পরে পুত্রবধূদের কিছু কিছু বলে গেছেন।

২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময় উপদেষ্টা মেজর জেনারেল মতিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। শহীদ বুদ্ধিজীবী নিয়ে কোনো উদ্যোগ সরকারের নেই বলে জানান। এরপর তাড়াইলের সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সাংবাদিকরা আন্তরিকভাবে কাজ করলেও কোনো ফল হয়নি। এর মধ্যে জাতীয় দৈনিকগুলোয় বিজ্ঞাপন দিয়ে শহীদ স্বীকৃতির আবেদন জানিয়েছি। কেউ সাড়া দেয়নি। পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কৃষিবিদ মশিউর রহমান হুমায়ুনের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে ২০২০ সালে দেখা করে আবেদন জমা দিই। সংযুক্ত করি ১৯৭২ সালের ২৭ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংস্থাপন বিভাগের রেজুলেশন নম্বর ED/ J1-77/72-396-এ তৎকালীন ক্যাবিনেট সচিব এমএম জামান স্বাক্ষরিত গেজেটের মাধ্যমে আমাদের পরিবারবর্গকে দেওয়া আব্বার শহীদের খবর ও সান্ত্বনা পত্র।

গেজেটে বলা হয়, কর্মজীবনে আব্বা ডেপুটি মেজিস্ট্রেট হিসেবে কুমিল্লায় এবং সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে ঢাকা ও রাজশাহীতে চাকরি করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজশাহী সদরে সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসে কর্মরত ছিলেন।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর শামসুদ্দীন আহমেদ, আমাদের বাবা, সরকারি চাকরিজীবী হয়েও পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। এরই মধ্যে ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে রাজশাহীর দিকে হানাদার পাক বাহিনী আসছে শুনে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিটিংয়ে যোগ দিতে রাজশাহী সিঅ্যান্ডবির এসডিও মতিউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সরকারি জিপে তানোর থানায় যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে পাক বাহিনীর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হন। মূলত পাক সেনারা যখন রাজশাহী শহরে প্রবেশ করে তখন থেকেই তাদের কাছে শামসুদ্দীন আহমেদের ব্যাপারে তথ্য ছিল। আব্বাকে জিপ নামিয়ে নানানরকম জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। মতিউর রহমান ও আব্বার অফিস সহকারী কিশোরগঞ্জের আবুল হাশেমকে ছেড়ে দিয়ে আব্বাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর ফিরে আসেননি, কোনো খোঁজও পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে পাক বাহিনী আমাদের সরকারি বাসভবনও পুড়িয়ে দেয়। সন্তানসম্ভবা আম্মাকে নিয়ে আমরা তখন নানাবাড়ি, কিশোরগঞ্জে।

৫৩ বছর পর, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪-এ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তৃতীয় পর্বের তালিকায় ক্রমিক নম্বর ৯২, গেজেট নম্বর ৪২৭-এ আব্বাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার অ্যাডমিন ক্যাডারের একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবী।

আমার ছোট ভাই জুবায়ের আহমেদ শামীম মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেয়। খুবই উৎসুক ছিল আব্বার স্বীকৃতি নিয়ে কিন্তু ২০২২ সালে মারা যায়। আম্মা আর শামীম আব্বার পুনর্জন্ম দেখে যেতে পারেনি- আফসোস হয়। তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো রয়েছে।

লেখক : শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুদ্দীন আহমেদের সন্তান


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা