শহীদ স্বজনের শোকগাথা
কাজী ইসলাম
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১০:৩৪ এএম
ছবির টর্চলাইটটা এভারেডি কোম্পানির তৈরি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজী নুরুন্নবী ব্যবহার করতেন। আর বইয়ের লেখাটি নুরুন্নবী মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় Dillings Pharmacology বইয়ে কি চমৎকার হস্তাক্ষরে লেখা নিজের নাম।
১৯৭১ সালে কাজী নুরুন্নবী রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পঞ্চম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি করতেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। BLF (Bangladesh Liberation Front) যা পরে মুজিববাহিনী বলে পরিচিত হয়েছিল, তাতে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতের দেরাদুনের কাছে তাণ্ডুয়ায় সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। নিযুক্ত হয়েছিলেন মুজিববাহিনীর রাজশাহীর ডিস্ট্রিক্ট লিডার। স্বাধীনতার পর দেয়ালে টাঙানো ছবি হয়ে গেলেন। হয়ে গেলেন শহীদ কাজী নুরুন্নবী।
এ টর্চ হাতে নুরুন্নবী বাংলাদেশের নিকষ আঁধার কেটে আলোর দিকের, স্বাধীনতার দিকের পথ খুঁজেছেন। হেঁটেছেন বাংলাদেশের গ্রামের কাদামাটির পথ ধরে মাইলের পর মাইল। সহযোদ্ধাদের সংকেত দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছেন। মেঠো পথে, বিলের মাঝে, রণাঙ্গনে। মেডিকেল কলেজের শেষবর্ষের ছাত্র হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডাক্তারি দিকটা সামলানোর। তরুণ, বড় রোমান্টিক চে গুয়েভারাকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘স্টেথিস্কোপ হাতে হয়তো কয়েকজন মানুষের জীবন বাঁচানো যায়, কিন্তুরাইফেল হাতে শত্রুর হাত থেকে শত শত মানুষের জীবন বাঁচানো যায়।’ তার ডায়েরিতেও কথাটার উল্লেখ আছে। নুরুন্নবীর ডায়েরির ছত্রে ছত্রে আছে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার আকুতি। নিয়তি গ্রহণ করেছিল সে আকুতি। নিয়তির অমোঘ কোন কারিকুরিতে নুরুন্নবী ১ অক্টোবর পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। তার কোনো সংবাদ আর কখনও পাওয়া যায়নি।
ডিলিংয়ের ফারমাকোলজির বইটা, টর্চলাইটটা আছে আমাদের স্মৃতির দহনের জ্বালানি হিসেবে। মাকে লেখা চিঠিটাও আছে, বীরত্বের, দেশপ্রেমের, আত্মত্যাগের ইচ্ছার এক অনন্য দলিল হিসেবে।
নুরুন্নবী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছেন জেনে বুঝে। নিশ্চয়ই যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সেই বাংলাদেশ বাস্তবে রূপ নিলে তার আত্মা শান্তি পাবে। সে বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হলে নিশ্চয়ই তার পিতা-মাতা শোকের সাগরে ডুবে থেকেও গরিমা বোধ করতে পারতেন। দেশের স্বাধীনতায় ছেলেকে উৎসর্গ করার গরিমা। তবে বীরপুত্র জন্মদানের গরিমা তো তাঁদের নিশ্চয়ই ছিল।
নুরুন্নবীর মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত টর্চটা, আলোর উৎস ছিল এটা একসময় এক সাহসী তরুণের। আশার কুহকে ভাবি, নিশ্চয়ই বাংলাদেশে কখনও আবার আশার আলোটা জ্বলবেই।
বইটা সন্তর্পণে ছুঁই, নিশ্চয়ই মূর্খতা ও গোঁড়ামির আঁধার কেটে জ্ঞানের আলোও জ্বলবে এ দেশে, জ্বলতেই হবে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ কাজী নুরুন্নবীর ভাই