শহীদ স্বজনের শোকগাথা
আব্দুল গফুর
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১০:২৯ এএম
আমরা যখন খুবি ছোট আছলাম (ছিলাম) তখন আমরার আব্বা শহীদ আলী আকবর আমরারে (আমাদের) কোলে কইরা বাজারে যাইতেন, স্কুলে লইয়া যাইতেন। আব্বা জীবিত থাকতে আমরা কোনো দিন পরিবারের কোনো কামকাজ করছি না। খুব সুখেই আমরার পরিবার চলছে। আব্বা-চাচারা হকলে (সবাই) মিলে এ পরিবারে আছিলাম। খানি-কাপড়ের (অন্নবস্ত্র) কোনো অভাব অইছে (হইছে) না।
এরপর ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আমরার আব্বারে পাঞ্জাবি (পাক হানাদার বাহিনী) গুল্লি কইরা মারার পর আমরার বাড়িঘর আগুন দিয়া জ্বালাইছে ওই সময় আমরা বহুত কষ্ট করছি। আনন্দের পরিবারে দুঃখ নাইমা আইছিল। যুদ্ধের শেষ দিকে সামান্য ভাতের জন্য মানুষের বাসাবাড়ির কাজকাম করছি, বাড়িত কাম করছি।
আমার আব্বা শহীদ আলী আকবর যুদ্ধে গেছিলেন কালেঙ্গা পাহাড়ে ইন্ডিয়ার সীমানায়। আব্বার সাথে আমার চাচা আলী আজগর, মামা রফিক মিয়াও যুদ্ধে গেছিলেন। সাত মাস যুদ্ধ করার পর একদিন আমার আব্বারে পাঞ্জাবি হকলে (সকলে) গুল্লি করি মারিলাইছে। তাইন মারা যাওয়ার পর আমরা আমরার বাপের লাশটাও পাইনি। সে সময় আমরা ছোট ছোট ভাই-বোনরা মারে লইয়া অসহায় অবস্থায় আছলাম, বড় কষ্টে আমরার দিন গেছে। এখন আমরা ভাতা-ওতা (সরকারি তালিকাভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্ত ভাতা) পাইয়া চলরাম (চলছি) কোনোরকম।
যুদ্ধের সময় আমার বয়স আছিল মাত্র ১৬ বছর। যুদ্ধের প্রথম দিকে আমি ও আমার ভাইয়েরা গ্রামে ঘুইরা ঘুইরা (ঘুরে ঘুরে) পাঞ্জাবির খবর নিয়ে মুক্তিসেনাদের দিতাম। আমরা অনেক সময় তাদের কইতাম অমুক জাগায় পাঞ্জাবি আছে, আমরার কথা হুইন্না (শুনে) তারা (মুক্তিযোদ্ধারা) গেরিলা যুদ্ধ করতেন।
যুদ্ধের প্রথম দিকে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ২০ জন ২৫ জন কইরা আমরার বাড়িত আইতা (আসতেন), মা রান্না কইরা খাওইতা (খাওয়াতেন)। এরপর শেষ দিকে আমরার আব্বারে ধরি লাইছে পাঞ্জাবিরা। তানরে গুল্লি কইরা মারার পর আমরা অসহায়ের মতো আছিলাম। আমরারে দেখার মতো কেউ আছিল না। আব্বারে মারার পর পাঞ্জাবিরা আগুন দিয়া আমরার বাড়িঘর জ্বালাইলাছিল।
এ সময় আম্মা আমরারে লইয়া বহুত কষ্ট করছইন (করেছেন)। তিনি অশিক্ষিত আছলা (ছিলেন), লেখাপড়া জানতা নায়, কোনতা (কোন কিছুই) বুঝতা না। খালি বুঝতা শেখ সাবের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) নির্দেশে দেশ স্বাধীন করতে অইব।
যার কারণে আমার মার সাহস, ইচ্ছে ও সমর্থনে আব্বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর, চাচা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আজগর, মামা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রফিক মিয়াসহ আব্বা ও মামাদের দুই সংসারের ছয়জন মুক্তিযুদ্ধে যান। তারা হকলেই শহীদ হইছইন।
আমরার পরিবারের ছয়জন পাঞ্জাবির হাতে শহীদ অওয়ার পর পাঞ্জাবিরা আমরার বাড়িঘর জ্বালাইলাইছিল। এরপর শুরু অই গেছে আমরার কষ্টের জীবন। আম্মা আমরারে লইয়া বহুত কষ্ট করছইন। পাহাড়ের ছিপায় ছিপায় লুকাইছইন (লুকান)। যখন পাঞ্জাবিরা গুল্লি করত তকন আমরা হকলে (সকলে) পাহাড়ের ছিপাত (আড়ালে বা খাদে) গিয়া লুকাইতাম (লুকিয়ে থাকতাম)।
আমরার আব্বারে যখন পাঞ্জাবিরা কালেঙ্গা পাহাড় থিকা ধরি নিয়া আইল (ধরে নিয়ে এলো) তখন তানরে বহুত মারছে (অনেক মেরেছে) আরও মুক্তিযোদ্ধারার খবর নেওয়ার লাগি। তাইন মাইর খাইছইন, কিন্তু মুখ খুলছইন না। এরপর শ্রীমঙ্গল বিডিআর ক্যাম্পের সামনে সাধুবাবার গাছতলাত নিয়া তানরে গুল্লি কইরা মারি লাইল (মেরে ফেলল)।
আমার চাচা, আমার মামারেও মারল। তাদের লাশটা পর্যন্ত আমরা পাইনি। এ দুঃখ আমরার সারা জীবনের। এখন সরকারের তহবিল থেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হিসেবে ভাতা-ওতা পাই। কোনোরকমে চলি।’
লেখক : শহীদ আলী আকবরের বড় ছেলে
অনুলিখন : ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার