শহীদ স্বজনের শোকগাথা
ঝর্ণা ব্যানার্জি
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১০:২৪ এএম
শহীদ শংকুর বাড়ির দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার আত্মত্যাগের ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরু হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রংপুরে আন্দোলন শুরু হয়। পাড়ামহল্লায় মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ সালের মার্চে রংপুরে আন্দোলন জোরদার হয়। তখন আমার বয়স চার থেকে পাঁচ হবে। আমরা তখন গুপ্তপাড়া থাকতাম। শংকু সমজদার তখন কৈলাশ রঞ্জন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন।
৩ মার্চ সকালে বড় ভাই কুমারেশ সমজদারের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল শংকু। চারদিকে তখন মিছিলের শব্দ। যারা মিছিলে গিয়েছিলেন তাদের মুখে শুনেছি সেদিন ছাত্র, দিনমজুর, কৃষক, নারী-পুরুষ সর্বস্তরের মানুষ কারফিউ ভাঙার জন্য শহরের কাচারি বাজারে সমবেত হয়েছিল। মিছিলটি বর্তমান শাপলা চত্বরে এলে সেখানে বিভিন্ন দিক থেকে আসা স্বাধীনতাকামী মানুষ একত্র হয়। মিছিলটি আলমনগরের দিকে যেতে থাকে। আলমনগরের অবাঙালি সরফরাজ খানের বাসার সামনে এলে শংকু ওই বাসার দেয়ালে উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ডটি নামাতে ছুটে যায়। তখনই বাড়ির দিক থেকে গুলি ছুড়লে শংকু গুলিবিদ্ধ হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আমার কিশোর ভাই। পাঁজাকোলা করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পথেই শংকু মারা যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে নাম লেখায় শংকু। শংকুর মৃত্যুর খবর শুনে মা পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো লাশটি দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু শংকুর লাশটিও আমাদের দেখতে দেওয়া হয়নি। শুনেছি তার চোখে নাকি গুলি লেগেছিল। পরদিন ৪ মার্চ সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্মশানে শংকুর লাশ সৎকার করিয়েছে।
সরকার আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে। রংপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আসিব আহসান স্যার আমার মায়ের ঘর মেরামতসহ আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। মায়ের অনেক বয়স হওয়ায় তিনি চলাফেরা করতে পারতেন না। ২০২৩ সালের ৩ মার্চ আমাদের বাড়িতে এসে সাবেক জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন ম্যাডাম আমার মাকে হুইল চেয়ার, ঘরের জন্য ঢেউটিন এবং আর্থিক সহযোগিতা করে গিয়েছিলেন।
এভাবে বিগত জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা শংকুর প্রয়াণ দিবস ৩ মার্চে আমার মায়ের খোঁজখবর নিয়ে যেতেন। আমার মা তার জীবদ্দশায় সব সময় শংকুকে স্মরণ করতেন। তিনি চেয়েছিলেন শংকুর যে আত্মত্যাগ তা যেন মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকে। আমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল এ বাড়িতে যেন শংকুর একটি স্মৃতিচিহ্ন থাকে। জেলা প্রশাসক আমাদের অবস্থার খোঁজখবর নিয়ে বাড়ির চারদিকের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণসহ ঘরগুলো সংস্কার করে দিয়েছিলেন। সেবার আমার মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী বাড়ির সামনের দেয়ালে স্বাধীনতা আন্দোলনে ৩ মার্চের ঘটনাটি টেরাকোটার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বাড়ির সামনে নামফলক লাগানো হয়েছে। এখন বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে যারাই যায় একবার আমাদের দেয়ালের দিকে তাকায়। যারা এলাকার নন, বাইর থেকে আসা কোনো পথচারী এ রাস্তা দিয়ে গেলে একবার হলেও দেয়ালের দিকে তাকায়। তাদের মনে কৌতূহল জাগে এটি কী। অনেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমার ভাইয়ের আত্মত্যাগের কথা জানে। এসব দেখে আমার অনেক ভালো লাগে।
মায়ের কাছে সব সন্তানই প্রিয় হলেও শংকুর প্রতি মার একটু আলাদা টান ছিল। মা বেঁচে থাকাকালে তিনি চেয়েছিলেন প্রতি বছর সরকারিভাবে শংকু দিবস পালন করা হোক। শংকুকে স্মরণীয় করে রাখতে শহরের কোনো এক জায়গায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। যাতে সবাই শংকুকে চেনে। মায়ের কাছে যখনই প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা, সাংবাদিক কিংবা অন্য কোনো পেশার মানুষ আসতেন তিনি তাদের শংকুর নামে দিবস পালন, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কথা বলতেন। ডিসি স্যারও বলেছিলেন শংকুর নামে পার্কের মোড় এলাকায় স্মৃতিস্তম্ভ হবে। সেটি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
আমার মা ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন। মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে আমিই শুধু বেঁচে আছি। আমারও চাওয়া ৩ মার্চ শংকুর মৃত্যুর দিনটি সরকারিভাবে পালন করা হোক।
লেখক : শহীদ শংকুর ছোট বোন
অনুলিখন : মেরিনা লাভলী, রংপুর