আরতি রানী মণ্ডল বললেন
প্লাবন শুভ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর)
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৪ ১১:৫৫ এএম
আরতি রানী মণ্ডল দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অপেক্ষা করতে হয় প্রায় পাঁচ দশক
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আরতি রানী মণ্ডল। সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া আরতি যুদ্ধের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নিয়েছেন নার্সের ট্রেনিং। ট্রেনিং শেষে যান আগরতলায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় পাঁচ দশক। আরতি রানী মণ্ডলের যুদ্ধদিনের কথামালা ও তার ব্যক্তিজীবনের সংগ্রাম বিষয়ে কথা হয় প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে…
একাত্তর সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে পুরুষদের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছিলেন নারীরাও। রণাঙ্গনের অগ্নিঝরা দিনগুলোয় হানাদারদের বিরুদ্ধে কখনও সম্মুখ যুদ্ধে, কখনও বার্তাবাহক হিসেবে আবার কখনও আহত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের শুশ্রূষায় নিজেদের নিয়োজিত করেন তারা। তাদেরই একজন আরতি রানী মণ্ডল।
নওগাঁ জেলার দক্ষিণ কালীতলা মহল্লার অক্ষয় কুমার সাহা এবং শঙ্করী বালা সাহার মেয়ে আরতি। নওগাঁ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন বিএমসি কলেজে। ওই সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এপ্রিলের শেষ নাগাদ আরতি মণ্ডল পরিবারসহ ভারতের বালুরঘাট চলে যান। সেখান থেকে নিজের মনের তাড়নায় নাম লেখান মুক্তিবাহিনীতে।
জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে অংশ নিলেও এর স্বীকৃতি পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় দীর্ঘ পাঁচ দশক। মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা শুনতে হাজির হই তার বাসায়। বৈবাহিকসূত্রে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে বর্তমানে পরিবার নিয়ে বসবাস আরতি রানী মণ্ডলের।
মার্চ মাসের এক সকালে মুখোমুখি কথা হয় তার সঙ্গে। প্রশ্ন করি, মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে কীভাবে যুক্ত করলেন? আরতি রানী বলতে থাকেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স হবে ১৫ থেকে ১৬ বছর। পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর। চারদিকে আতঙ্ক। পরিবারের সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট ক্যাম্পে যাই। সেখানে কয়েক মাস থাকার পরে মনে হলো, আমি কেন বসে আছি। চাইলে তো দেশের জন্য কাজ করতে পারি। তখন পরিবারের সম্মতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে প্রথমে ভারতের গঙ্গারামপুরে গেরিলা বাহিনীতে যোগদান করি। কৃষ্ণনগর ক্যাম্পে ছিল বাবা-মা। মাথায় কাজ করছিল দেশের মানুষকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে হবে। আমাকে দেশের জন্য কিছু করতে হবে। এসব চিন্তা থেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।’
ট্রেনিংয়ের দিনগুলোর কথা এখনও মনে আছে আরতি রানী মণ্ডলের। প্রশ্ন করতেই বলতে থাকেন- ‘গঙ্গারামপুরে কিছুদিন থাকার পর প্রশিক্ষণ নিতে কলকাতা পার্ক সার্কাস গোবরা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাই। সে ক্যাম্পে প্রায় ৫০০ মেয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে আমাদের আর্মস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাজেদা চৌধুরী। কীভাবে আর্মস ধরতে হবে, কীভাবে ফায়ার করতে হবে, আগুন লাগলে সেখান থেকে কীভাবে বেঁচে ফেরা যাবেÑ এ বিষয়গুলোয় ভারতীয় ডা. বোস আমাদের প্রশিক্ষণ দেন। পাশাপাশি শিয়ালদা রেলওয়ে হাসপাতালে হয় নার্সিং প্রশিক্ষণ। আমাদের গেরিলা, আর্মস ও নার্সিংÑ তিনটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষে আগরতলার মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে আমাদের নার্স হিসেবে পাঠানো হয়। সেখানে আমি, শিরীন আক্তার, তুষার কণা মণ্ডল, সাবিত্রি, সুলতানা কামাল, ইরা কর, গিতা কর, গিতা মজুমদার, কৃষ্ণা দাস, বিশাখা, বিনা, রঞ্জিতাসহ ১৫ জন যোগদান করি। তখন সেখানে ডা. সিতারা, ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরীসহ ১২ জন চিকিৎসক ছিলেন। আহত রোগী ছিলেন ২৫০ জনের মতো।’
সেখানে আহত যোদ্ধাদের সেবা দেওয়াই ছিল তাদের প্রধান কাজ। হাসপাতালের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিতেই আরতি রানী বলতে থাকেন, ‘যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হতো এই হাসপাতালে। কেউ শেলের স্প্লিন্টারে আঘাতপ্রাপ্ত, কেউ গুলিবিদ্ধ। ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামের স্বল্পতা সত্ত্বেও সেবায় কোনো ত্রুটি থাকত না। আমিসহ আমার সহযোদ্ধারা মেধা, শ্রম ও দক্ষতা দিয়ে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। মনে পড়ে, একদিন একজন গুলিতে আহত মুক্তিযোদ্ধাকে হাসপাতালে আনা হয়। তার প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এদিকে তার জিহ্বাও কাটা পড়েছিল। তিনি সেই বিচ্ছিন্ন জিহ্বাটি কোমরের গামছায় বেঁধে নিয়ে আসেন। ডাক্তারদের ইশারায় খাতা ও কলম চান। এরপর লিখে জানান, তার কোমরে বাধা গামছায় ৬৫ টাকা আর জিহ্বার বিচ্ছিন্ন অংশটি আছে। সেখানে ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, ডা. জামান, ডা. নাজিম ছিলেন। তারপর তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার জিহ্বাটি প্রতিস্থাপন করা হয়। সেখানে থাকা ডা. মামুন তাকে রক্ত দেন। এরপর সেই মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে জানা যায়, তিনি চট্টগ্রাম সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি সুস্থ হয়ে ওঠার পর তার মুখে কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম।’
মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার প্রসঙ্গে জানতে চাই তার কাছে। আরতি রানী বলেন, ‘ডিসেম্বর মাসে দেশ স্বাধীন হলো। আমরা তখন কুমিরায়। পরে ঢাকায় একটি মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতাল করা হলে সেখানে নিয়ে আসা হয় আমাদের। কর্তৃপক্ষ তখন আমাদের জানায়, চাইলে তোমরা এখানে থাকতে পার কিংবা যে যার বাড়িতে ফিরে যেতে পার। সেখানে আমাদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও করে দিতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু আমরা থাকিনি। রাজশাহীর সাবিত্রী পোদ্দার ও জেন্নাতুন নেছা সেখান থেকে চলে এলে আমিও নিজ গ্রামে চলে আসি। এলাকায় ফিরে সামাজিকভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়নি। তেমন কোনো সমস্যাও হয়নি। যদিও আমি এসবে কর্ণপাত না করে আমার মতো পুনরায় জীবন শুরু করি।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সম্মাননা ছাড়াও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নারী সম্মাননা পেয়েছিলেন আরতি রানী মণ্ডল। কিন্তু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নওগাঁয় থাকা অবস্থায় জানতে পারি, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছি তাদের নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। তখন আমি যোগাযোগ শুরু করি। পরে আবেদন করতে বলা হয়। আমি আবেদন করলেও তা কোনো কারণে চাপা পড়ে যায়। বিয়ের পর ফুলবাড়ীতে চলে এলে এখানকার উপজেলা অফিসে গিয়ে যাবতীয় প্রমাণ দেখালে তারা বলেন, আপনি এখানে এসেছেন কেন? আপনি নওগাঁয় যান। যেখানে আপনার জন্মস্থান আপনি সেখানে যাবেন। এই বলে তারা আমাকে ফিরিয়ে দেন। তারপর আমি আবার নওগাঁয় যাই। সেখান থেকে আমাকে বলা হয়, আপনি যেখানে যুদ্ধ করেছেন সেখানে যান। এই বলে তারাও আমাকে ফিরিয়ে দেন। আমি নিরাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিই। আর কোনো চেষ্টা করিনি। এরপর ২০১৬ বা ১৭ সালে অনলাইনে আবেদনের সুযোগ এলে আবেদন করি। এরপর লোক মারফত চেষ্টা চালিয়ে যাই। কী কারণে স্বীকৃতি পাব না, এ আক্ষেপ জমে মনে। পরে যারা এ সংক্রান্ত কাজ করত আমি তখন তাদের সন্ধান করি। তাদের জানাই, তারা চেষ্টা চালায়। তারপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেখানে আমার নাম আসে। এরপর ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান যাচাই-বাছাইয়ের প্রমাণাদিসহ সাক্ষাৎকার নেন। তারপর কাগজপত্র ঢাকায় যায়। আবার যাছাই-বাছাইসহ সাক্ষাৎ প্রক্রিয়া হয়। এরপর কিছুদিন সবকিছু থেমে থাকল। কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাকে হঠাৎ একদিন দিনাজপুর জেলায় ডাকা হয়। সেখানেও সাক্ষাৎ প্রক্রিয়া হয়। সেখানে আমাকে তারা অবজ্ঞা করে। আমি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা তারা সেটা গ্রাহ্যই করলেন না। উল্টো বলেন, আপনি কেন এখানে এসেছেন? কেন এখানে নাম দিয়েছেন? হতাশ হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসি। পরে বিষয়টি আমার ভাই অজয় কুমার সাহাকে জানালে তিনি আমাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করার পরামর্শ দেন। তারপর প্রমাণাদিসহ দলিলপত্র পোস্ট অফিসের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠাই। আবেদনটি পাঠানোর ১৫ দিন পর একটি ফোনকল আসে। আমাকে জানানো হয়, আপনি নির্বাচিত হয়েছেন। সব কাগজপত্র নিয়ে ঢাকা মুক্তিযোদ্ধা ফোরামে যেতে বলে। পরদিন আমার মা মারা যাওয়ায় আমি ঢাকা যেতে পারিনি। আমার ছেলে হিমেল মণ্ডল কাজগপত্র নিয়ে ঢাকা যায়। পরবর্তীকালে যাচাই-বাছাই শেষে আমাকে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্যাজেটের মাধ্যমে আমার নাম প্রকাশ হয়।
যুদ্ধ শেষে নওগাঁ ফিরে আসার পর স্বাভাবিক জীবনেই ফিরে আসেন আরতি। ১৯৭৫ সালে পারিবারিকভাবে জয়পুরহাট জেলার শ্যামপুর গ্রামের অবনী কান্ত মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তিনি ছিলেন কলেজের অধ্যাপক। ১৯৭৮ সালে আরতি রানীও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তার স্বামী ফুলবাড়ী সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হলে আরতি রানীও ফুলবাড়ীতে চলে আসেন। সেখানে ফুলবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। যুদ্ধপরবর্তী জীবন নিয়ে বলতে থাকেন আরতি রানী মণ্ডলÑ ‘ফুলবাড়ীতে আসার পর কাটাবাড়ী গ্রামে একটি ভাড়া বাসায় থাকতাম। পরে সেই বাড়িটি আমরা কিনে নিই। আমাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়। খুবই সুখের পরিবার ছিল আমাদের। আমার মেয়ে খুবই মেধাবী ছিল। ছেলেও পড়াশোনা করত। ১৯৯৩ সালে আমার স্বামী অবসরে গিয়ে হোমিও চিকিৎসায় মন দেন। আমার মেয়ে বহ্নি মণ্ডলের বয়স যখন ১৪ এবং ছেলের বয়স ১২ বছর। সে সময় স্বামী প্রতিবেশী এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ফেরাতে ব্যর্থ হই। বাবার এমন কর্মকাণ্ডে আমার মেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। প্রায় ৩০ বছর হলো আমার মেয়ে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে শয্যাশায়ী আছে। এরপর আমার স্বামী বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আমার চাকরি ও তার পেনশনের টাকাসহ সবকিছু নিয়ে বাড়ি ছেড়ে ওই মেয়েকে নিয়ে চলে যান। পরে তারা বিয়ে করেন। আমার চাকরির টাকায় আমি প্রতিবন্ধী মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে জীবনযাত্রায় অগ্রসর হই। ২০০৬ সালে ছেলে হিমেল মণ্ডলকে ব্যবসার কাজে নিযুক্ত করি। ২০০৯ সালে আমি চাকরি থেকে অবসরে যাই। সেসময় আমার পেনশনের টাকা দিয়ে ছেলে নতুন ব্যবসায় নাম লেখায়। আমার ছেলে বিবাহিত। তার স্ত্রী ও পুত্রসন্তান রয়েছে। বর্তমানে আমার পেনশনের অর্থ ও ছেলের রোজগার দিয়ে ভালোই চলছে আমাদের।’
নিজের সংগ্রামময় জীবনের আরও নানান বিষয়ে কথা বলতে থাকেন আরতিÑ ‘আমার শ্বশুরবাড়িতে প্রায় সাড়ে ৯ বিঘা জমি আছে। এ ছাড়াও স্বামীর পেনশনের টাকা রয়েছে। ফুলবাড়ীতে ৬ শতক জমিতে যে বাড়িটি কিনেছি, তা রয়েছে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সে সম্পত্তি নিয়ে। আমার ছেলে বড় হয়েছে। আমার ছেলে তার বাবাকে বলেছে, আমি তোমার সম্পত্তি কিছু চাই না। আমরা যে বাড়িতে বসবাস করে বড় হয়েছি। সে বাড়িতে আমরা থাকতে চাই। শুধু এই বাড়িটা আমাদের নামে দাও। কিন্তু আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী এই জায়গা ছাড়তে চায় না। যে ৬ শতক জায়গা আছে তা থেকে ৩ শতকের ভাগ চায় সে। বর্তমানে এ জায়গা দখলে নিতে অত্যাচার শুরু করেছে।’
প্রশ্ন করি তার মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে নিয়ে। তিনি বলেন, ‘মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থানে তার চিকিৎসা চালাই। কিন্তু কোনো উন্নতি হয় না। পরে আমরাও হাল ছেড়ে দিই। প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়ে ধরনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। তার নামে প্রতিবন্ধী ভাতা বরাদ্দ করাতে ব্যর্থ হই। পরে আর চেষ্টা করে দেখিনি। বর্তমানে শয্যাশায়ী হয়ে একটি কক্ষে পড়ে আছে আমার মেয়ে বহ্নি মণ্ডল।’
ফিরে আসি আবার মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। স্বীকৃতি পাওয়ার পর অনুভূতির বিষয়ে জানতে চাই তার কাছে। আরতি রানী মণ্ডল জানান, ‘স্বীকৃতি পেয়ে আমি ও আমার পরিবারের সবাই খুশি। নিজেকে সার্থক মনে হয়। প্রায় ৫০ বছর সংগ্রাম করার পর আমার এই অর্জন। প্রথমে তো হয়রানির শিকার হয়ে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন নিজেকে গর্বিত মনে হয়। দেশের জন্য কাজ করে সম্মান পেয়েছি, এটাই অনেক বড় পাওয়া। অনেক কষ্ট ও যন্ত্রণার পর আমি স্বীকৃতি পেয়ে যে সম্মানটা পাচ্ছি এতেই আমার শান্তি।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমি এককালীন ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ভাতা পেয়েছিলাম। এখন প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছি।’
কথায় কথায় অনেক কথা হয় আমাদের। জানতে এই জীবনের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। আরতি রানী মণ্ডল জানালেন, ‘ছোট্ট এই জীবনে অনেক পেয়েছি। শেষ জীবনে এসে একটাই চাওয়া, আমার মেয়েটির জন্য স্থায়ী কোনো কিছু করে যেতে চাই। সরকারিভাবে তার ভাতা চালুসহ তার চিকিৎসার জন্য যদি কোনো সুযোগ পাওয়া যায়, ভালো হয়। এ ছাড়াও আমার বাড়িটি যেন রক্ষা হয়। স্বামী যেন এই বাড়িটি ছেলের নামে লিখে দেন- এটাই তার কাছে আমার শেষ চাওয়া। তার সম্পত্তি কিংবা পেনশনের টাকাসহ কিছুই চাই না আমরা।