কাশ্মির গ্রেট লেকস ট্রেক
আসাদুজ্জামান সাজ্জাদ
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪ ১৪:১৯ পিএম
গাডসার লেকের অবস্থান ৩ হাজার ২৪৫ মিটার উচ্চতায়
কাশ্মির বলতে আমরা কী বুঝি? প্রচুর টাকা খরচ করে বিলাসবহুল কোনো হোটেল কিংবা হাউসবোটে রাতযাপন? অথবা গাড়িতে চেপে সোনমার্গ, গুলমার্গ, পেহেলগামের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে কাশ্মিরের সৌন্দর্য উপভোগ? না, প্রচলিত এ রুট ছাড়াও কাশ্মিরে দেখার মতো আরও অনেক সৌন্দর্য লুক্কায়িত রয়েছে। যেখানে কাশ্মিরকে ‘ভূস্বর্গ’ বলা হয়, সেখানে কাশ্মির গ্রেট লেকসে ট্রেক করার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে, কোনো দিন ভেবে দেখেছেন? কাশ্মির গ্রেট লেকস হচ্ছে এমন একটি ট্রেকিং রুটের নাম যেটি বসন্তের সেরা ট্রেকিং রুটগুলোর মধ্যে অন্যতম।
গ্রেট লেকস নামটা শুনেই বোঝা যায়, এর মধ্যে এমন কিছু লুকিয়ে রয়েছে, যার টানে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ছুটে যায়। প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিটার উচ্চতায় ট্রেক করা একটু কষ্টকর হলেও অভিজ্ঞতা সারা জীবন মনে রাখার মতো। কাশ্মির গ্রেট লেকস ট্রেক সংক্ষেপে কেজিএল (KGL) ট্রেক। বছরে জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরÑতিন মাস এখানে যাওয়ার অনুমতি মেলে। বাকি সময় কেজিএল ট্রেক বরফে ঢাকা থাকে। প্রত্যেকে কোনো ট্যুরে যাওয়ার আগে পূর্বপরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে তারপর যান। সিদ্ধান্ত নিলাম কেজিএল ট্রেকে যাব। কেজিএল ট্রেকের পারমিশন পেতে ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স ও মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছালাম শ্রীনগর। আগে থেকে বুকিং করে রাখা এজেন্সির হোটেলে রাতটা থাকলাম।
গন্তব্য শিটকদি ক্যাম্প
আজ আমাদের যেতে হবে শিটকদি ক্যাম্প (৭ হাজার ৮০০ ফুট) থেকে নিচনাই ক্যাম্প (১১ হাজার ৯৪৮ ফুট বা ৩ হাজার ৬৪২ মিটার)। দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। বেস ক্যাম্প থেকে কিছুক্ষণ হাঁটার পর আর্মি ক্যাম্প। এখান থেকে সবার এন্ট্রি করে যেতে হয়।
সবুজ গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে চলছি দূরের এক পাহাড়ে। কয়েক হাজার বছর ধরে জমে থাকা বরফের আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। পথে বড় বড় পাইন গাছ কয়েকশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে গাছের শেকড়ে বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়। এখানে নেটওয়ার্ক শেষ। আগামী পাঁচ-ছয় দিন আর নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না। আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা দোকান পেলাম। এখান থেকে সবাই চা, ম্যাগি, চকলেট বা অন্য কিছু খেয়ে নিতে পারে। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে লাগলাম বনের ভেতর দিয়ে। এ পথের আশপাশে ম্যাপল, পাইন, ভোজ ইত্যাদি গাছ যুগযুগান্তর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এখানেই সৃষ্টি, এখানেই ক্ষয়, এখানেই মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া। নগরসভ্যতার দুষ্ট লোকের হাত এ গাছের ওপর কোনো দিন পড়েনি, আর পড়বেও না আশা করি। আজকের মতো গাছপালা এখানেই শেষ। আস্তে আস্তে ওপরে উঠছি গাছপালাও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। শেষ দিনের আগে আর কোনো গাছ দেখা যাবে না।
হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিলল বরফগলা ঝিরির। পাশ দিয়ে পাথরের বোল্ডার। সেগুলার ওপর দিয়ে আমাদের হেঁটে যেতে হবে ক্যাম্প সাইট পর্যন্ত। কখনও উঁচু পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে হয়, কখনো পাথরের বোল্ডার পেরিয়ে নিচে নামতে হয়। সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে, এখনও যেন পথ শেষই হচ্ছে না। সন্ধ্যা নামার আগে নিচনাই ক্যাম্পে এসে পৌঁছাই। এসেই ম্যাগি ও স্যুপ খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাই। আজকের এ রাতটি ছিল পূর্ণিমার, আকাশ মেঘলা।
কেজিএল ট্রেক : নিচনাই ক্যাম্প থেকে বিষানসার ক্যাম্প
পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারদিকের সব পাহাড়-পর্বত। আকাশে হালকা মেঘও দেখা যাচ্ছে। তাঁবু থেকে বেরিয়েই দেখতে পেলাম রহস্যময় কিছু তারা সারিবদ্ধ হয়ে ছুটে চলেছে; অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে কোনো ট্রেন আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। কি অদ্ভুত! পরে জানতে পারলাম এগুলো ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট।
বাইরে অনেক ঠান্ডা। তাঁবুর ভেতরে স্লিপিং ব্যাগ দিয়ে শরীরটা ভালোভাবে মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে হঠাৎ কিছু শব্দে জেগে উঠি। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এবং বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সকালে উঠে দেখি আমাদের পুরো ক্যাম্প সাইট বরফে ধবধবে সাদা হয়ে আছে। আজ আমাদের ট্রেকের দ্বিতীয় দিন। আমাদের গন্তব্য নিচনাই ক্যাম্প থেকে বিষানসার ক্যাম্প (উচ্চতা ১২ হাজার ১৫২ ফুট বা ৩ হাজার ৭০৪ মিটার)। দূরত্ব প্রায় ১৫ কিমি। আমাদের নিচনাই পাস অতিক্রম করতে হবে; যার উচ্চতা ১৩ হাজার ৪৫৮ ফুট।
ক্যাম্প থেকে সকালের নাশতা খেয়ে এবং লাঞ্চ প্যাক নিয়ে যাত্রা করলাম। গতকালের বরফগলা ঝিরিটা পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি নিচনাই পাসের দিকে। যত ওপরে উঠছি দূরের পাহাড়গুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। আর চারদিক দেখে মনে হচ্ছে স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছি। হঠাৎ পুরো আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। ঘণ্টা তিনেক ওপরে ওঠার পর অবশেষে নিচনাই পাসে এসে পৌঁছালাম। নিচনাই পাসের ওপর দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে মনে হলো কি অদ্ভুত সুন্দর এক জায়গা। পায়ের নিচে আশপাশে সব পাহাড়-পর্বত। নিচনাই পাসে রয়েছে একটি ম্যাগি পয়েন্ট। সেখান থেকে একটি ম্যাগি ও চা নিয়ে খাচ্ছি। খাওয়ার পর শরীরটা একটু চাঙা হলো।
নিচনাই পাসে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। আমাদের দেশে বৃষ্টি হলে যে পানি পড়ে এমন বৃষ্টি নয়। এখানে বৃষ্টি হলে শুধুই বরফের খণ্ড পড়ে, আমরা যাকে শিলাবৃষ্টি বলি। মুষলধারে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যেই হেঁটে চলেছি নিচের দিকে। পাহাড়চূড়ার ওপর ভেসে থাকা মেঘ, নিচে জমে থাকা বরফখণ্ড এবং চলার পথে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বনফুলে সমৃদ্ধ তৃণভূমি যেন মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। আরও ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর একটি ঝিরির কাছে এসে পৌঁছালাম। ঝিরির পাশে বসে সবাই দুপুরের খাবার খাচ্ছে, আমরাও খাচ্ছি। হঠাৎ চোখ পড়ল একজন গাইডের দিকে। ঝিরির পাশে নামাজ পড়ছেন এ দৃশ্য পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি।
খাবার খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আবার হাঁটা দিলাম। খুব সুন্দর একটা ভ্যালির মধ্য দিয়ে হাঁটছি। কিছুক্ষণ পর দেখা দিল আমাদের ক্যাম্প সাইট। আজ গতকালের তুলনায় অনেক আগেই চলে এসেছি মনে হচ্ছে। এখানকার ট্রেকিং রাস্তাগুলো জিকজ্যাক হওয়ায় এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ওঠানামা করতে তত বেশি কষ্ট হয় না। কিন্তু অতি উচ্চতায় ট্রেকিং করতে হয়। আজ আমাদের ক্যাম্পের অবস্থান বিষানসার লেকের ১০-১৫ মিনিটের দূরত্বে খুব সুন্দর এক সবুজ গালিচার মাঝে। কিছুক্ষণ ক্যাম্পে বিশ্রাম নিয়ে চলে যাই বিষানসার লেকে। শেষবেলায় সূর্য যখন লেকের মধ্যে এসে পড়ে তখন লেকের আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। পুরো বিকাল একা একা লেকের পাশে কাটিয়ে দিই। সন্ধ্যা নামার আগেই ক্যাম্পে চলে আসি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি শিশিরভেজা ঘাসগুলো জমে বরফ হয়ে আছে।
বিষানসার ক্যাম্প থেকে গাডসার ক্যাম্প
আজ আমাদের গন্তব্য বিষানসার ক্যাম্প থেকে গাডসার ক্যাম্প (উচ্চতা ১০ হাজার ৭৭৭ ফুট বা ৩ হাজার ২৪৫ মিটার)। দূরত্ব প্রায় ২০ কিমি। অতিক্রম করতে হবে এ ট্রেকের সবচেয়ে কঠিন এবং উঁচু পথ গাডসার পাস; যার উচ্চতা ১৩ হাজার ৭৫০ ফুট বা ৪ হাজার ১৯০ মিটার। মানে আজ আমাদের ৩ হাজার ৭০০ মিটার থেকে ৪ হাজার ২০০ মিটার পর্যন্ত উঠতে হবে। আবার সেখান থেকে ৩ হাজার ২০০ মিটারে নেমে আসতে হবে।
বিষানসার ক্যাম্প থেকে ১০-১৫ মিনিট হাঁটলেই দেখা মিলবে অপরূপ বিষানসার লেকের। চলার পথে আছে কিছুটা পাথরের বোল্ডার সেগুলো পেরিয়ে ওপরের দিকে যেতে হবে। গতকাল বিকালে বিষানসারের যে রূপ দেখতে পেয়েছি এখন একটু ভিন্ন রূপ দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা সাদা বরফের প্রতিবিম্ব এসে পড়েছে পানির ওপর। প্রতিবিম্বের ছবি দেখে তাকে লেক বললে ভুল হবে। যেন ওইরকম আরেকটা পাহাড় ঠিক ওই পাহাড়টির নিচেই উল্টে রয়েছে। বিষানসার লেক থেকে ১৫-২০ মিনিট হেঁটে ওপরে এলেই দেখা যাবে কিষানসার লেকের। কিন্তু নিচ থেকে কিষানসারের আসল সৌন্দর্য বোঝা যাচ্ছিল না। আস্তে আস্তে যতই ওপরে উঠি ‘লাভ’ আকৃতির কিষানসার লেক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে বিষানসার লেকের কম্বিনেশনে টুইন লেক দেখা যাচ্ছে। যতই ওপরে উঠছি ততই অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে। ওপরের দিকে ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর অবশেষে পৌঁছে গেলাম গাডসার পাসের চূড়ায়। দুই দিকে নীল জলের দুটি করে টুইন লেক দেখা যায়। চারপাশের পর্বতের গায়ে গায়ে ছেঁড়া সাদা তুলোর মতো জমে থাকা বরফখণ্ড, পরিষ্কার নীল আকাশ আর বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা পাহাড়চূড়া যেন সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
আবার হাঁটতে শুরু করলাম নিচের দিকে। আজকের দিনের আকর্ষণ এ গাডসার আলপাইন তৃণভূমির ওপর হেঁটে যাওয়া। আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর হাতের বাঁ পাশে দেখা মিলবে এ ট্রেকের সবচেয়ে বড় এবং মনোরম সৌন্দর্যের গাডসার লেকের। পর্বতের ওপর জমে থাকা বরফখণ্ড, নীল ও স্বচ্ছ জলের ওপর পড়া সূর্যের প্রতিবিম্ব এবং নাম না জানা কত বন্য ফুল যেন সৃষ্টিকর্তা সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছেন ট্রেকারদের জন্য। গাডসার লেকের আরেক নাম Velly of Flowers।
গাডসার থেকে সাতসার
সারা দিনের ক্লান্তি শেষে গাডসার ক্যাম্পে খুব ভালো একটি ঘুম হয়। গতকাল আমাদের গন্তব্যে সাতসার ক্যাম্প (উচ্চতা প্রায় ১১ হাজার ৮৬০ ফুট বা ৩ হাজার ৬১৫ মিটার)। দূরত্ব প্রায় ১২ কিমি। সাতসার কথার মানে হচ্ছে সাতটি সার বা লেক। ক্যাম্পের পাশেই বিশাল এক বরফের আস্তরণ। এর নিচ দিয়েই চলে গেসে একটি খরস্রোতা ঝিরিপথ। এ ঝিরিপথ পার হতে হলে অবশ্য বরফখণ্ডটির ওপর দিয়ে যেতে হবে। খুব সাবধানে বরফের আস্তরণটি পার হলাম। তারপর একদম খাড়া ওপরে উঠতে হবে। একদিকে পাহাড়ি চূড়া অন্যদিকে খাদ। দুই দিকেই বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে তৃণভূমি, আর তার মধ্যে ফুটে রয়েছে হাজারো নাম না জানা ফুল। কিছুক্ষণ পর সাতসারের প্রথম লেকটি দেখতে পেলাম। পাথরের বোল্ডার পেরিয়ে আসতে আসতে ওপরে উঠতেই পর পর আরও কয়েকটি লেকের দেখা। এখানের লেকগুলো আবার স্বচ্ছ। লেকের পানির কালার কিছুটা সবুজ ও নীল। সাতসার ক্যাম্প পর্যন্ত আমরা মোট সাতটি ছোট ছোট লেক দেখতে পেলাম।
ট্রিপের রুট প্ল্যান
ঢাকা-বেনাপোল-কলকাতা-জম্মু-শ্রীনগর-সোনমার্গ-শিটকদি-নিচনাই-বিষানসার-কিষানসার-গাডসার-সাতসার।