রাতুল মুন্সী
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩১ পিএম
নিয়মিতই পাঠচক্র বসে স্বপ্নবিলাস উন্মুক্ত পাঠাগারে। প্রবা ফটো
তখন প্রাইমারিতে পড়ি। ব্র্যাকের সহযোগিতায় আমাদের
স্কুলে নতুন পাঠাগার হয়েছে। পাঠাগার নিয়ে তখন নানা কৌতূহল। কী আছে পাঠাগারে? কিছু দিন
পরে পাঠাগার চালু করা হলো। সম্পর্কে এক বড় বোন পাঠাগার পরিচালনা করেন। বড় বোনকে দেখে
সাহসটা বেড়ে গেল। যাই হোক, পাঠাগারটা নিজের মতো করে দেখতে পারব।
অনেক কৌতূহল নিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে একদিন টিফিনের
সময় পাঠাগারে ঢুকলাম। ঢুকেই নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মন ভরে গেল। রুমে তাকভর্তি সারি সারি
বই সাজানো। মেঝেতে খেলাধুলার কিছু সরঞ্জাম। খাতায় সাইন করে দুজন বসে গেল খেলতে আর আমরা
দু-তিনজন গল্পের বই নিয়ে টেবিলে বসলাম। সেই সময় গল্পের বই পড়ার থেকে মলাটে মজার মজার
ছবি দেখতেই বেশি ভালো লাগত। ঘণ্টা পড়ে গেল। টিফিন শেষ।
হইহুল্লোড় করে ক্লাসে ঢুকলাম। এরপর থেকে টিফিনের
ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই পাঠাগারে বসে বই পড়া, নতুন নতুন বইয়ের মলাটের ছবি দেখাসহ খেলাধুলায়
অনেক সময় কেটেছে। নতুন নতুন বই, লেখকদের ও গল্পের সাথে পরিচিত হতে শুরু করলাম। পাঠাগারের
যারা সদস্য ছিল তারা বই পড়তে বই বাড়িতে নিয়ে যেত এবং বাড়িতে পড়ে পরদিন স্কুলে এসে গল্প
করত। আমরা চুপ করে বসে শুনতাম।
এখন আর বুঝতে বাকি রইল না জ্ঞান, মেধা তৈরিতে
পাঠাগারের গুরুত্ব ও ভূমিকার কথা। তারপর থেকে দেখে আসছি ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগে
সারা দেশে অনেক পাঠাগার গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে গ্রাম-পাঠাগার আন্দোলন। বর্তমান সময়ে
বই পড়তে অনাগ্রহ, মোবাইল ও ইন্টারনেটে আসক্ত যখন উড়তি বয়সের সকল ছেলেমেয়ে, তখন ‘মন
হোক ঋদ্ধ, জ্ঞানে হই সমৃদ্ধ’- এই স্লোগানে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কয়েকজন
স্বপ্নবাজ তরুণ নিজেদের ইচ্ছায় ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্বপ্নবিলাস উন্মুক্ত
পাঠাগার’। শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চা বিকাশে গ্রামের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের
বই পড়তে উৎসাহী, ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার ও পরিবেশ নিয়ে সচেতন করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে
গ্রামের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছে স্বপ্নবিলাস
উন্মুক্ত পাঠাগারের একঝাঁক স্বপ্নবাজ তরুণ স্বেচ্ছাসেবী।
ত্রিশাল উপজেলা থেকে ৭ কিলোমিটার ভেতরে পোড়াবাড়ি
বাজারে গড়ে তোলা এই পাঠাগার ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করছে স্থানীয়দের মাঝে। তৈরি করছে নতুন
নতুন পাঠক। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এত বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে যে,
স্কুল ছুটি হওয়ার পর বই নিতে ভিড় লেগে যায় পাঠাগারের সামনে। শুধু তাই নয়, উন্মুক্ত
পাঠাগারের ভ্রাম্যমাণ ভ্যানের মাধ্যমে পাঠকের দ্বারে দ্বারে বই পৌঁছে দিচ্ছে পাঠাগারের
স্বেচ্ছাসেবীরা।
উদ্দেশ্য বই পাঠে আগ্রহ ও পাঠক তৈরি করা। বর্তমানে
উন্মুক্ত পাঠাগার ও ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৫০০। ৪২০ জনের
ওপর পাঠক নিয়মিত এখানে এসে বই পড়েন। রয়েছে সদস্য হওয়ার সুযোগ। শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান
ও সংস্কৃতিচর্চা বিকাশে সারা বছরই ছোট ছোট কার্যক্রম করে থাকে পাঠাগারের স্বেচ্ছাসেবীরা।
যেমন, অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহায়তা, দেশীয় পরিবেশবান্ধব ফলদ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, ‘পৌষালী
পাঠোৎসব’ নামে পাঠোৎসব। দুই দিনব্যাপী এই পাঠোৎসবে দেশবরেণ্য ব্যক্তি নিয়ে শিক্ষা অধিবেশনসহ
সুস্থধারার লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আয়োজন করা হয় দুই দিনব্যাপী বইমেলা।
পাঠাগারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খালেদ হাসান শান্তর
সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সকল বই উপহারের এবং কিছু বই ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই
দিয়েছেন। পাঠাগার পরিচালনায় সকল অর্থ আসে পরিচালনায় যারা তাদের মাসিক চাঁদা এবং সমাজের
বিশেষ ব্যক্তিবর্গের অনুদানে।’ শান্ত আরও বলেন, ‘আমরা এমন এলাকায় বাস করি, যেখানে সংবাদপত্র
পাওয়া যায় না। অথচ সংবাদপত্রকে বলা হয় জ্ঞানের ভান্ডার। আমরা একটা আমূল পরিবর্তন চাই।
সেক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সবচেয়ে জরুরি। সেজন্য আমরা বেছে নিয়েছি বই এবং আমরা
পাঠক তৈরি করতে চাই। যে পাঠক নৈতিকতাসম্পন্ন রুচিশীল ও বস্তুনিষ্ঠ হবে।’