মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪ ১৩:১৭ পিএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৪ ১৯:০৩ পিএম
নদী তাদের বড় ভালোবাসার ধন, আগ্রাসি ভাঙনে সব হারালেও ভালোবাসা হারায় না
তারা কেউ জেলে, কেউ মাঝি, কেউবা কুঠিয়াল, কৃষক। নদীকেন্দ্রিক সুখের জীবন ছিল তাদের। নদী মরে গেছে। বিষাক্ত নদীর পানি। জীবনজীবিকায় ঘটেছে ছন্দপতন। এখন কেউ বেকার, কেউবা করেছেন পেশাবদল। সুখ নেই। দুঃখভরা জীবন। খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন।
সোনালি অতীত
হাট থেকে ধান কিনে আনতেন। সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে কলে ভাঙাতেন। তারপর সে চাল বিক্রি করতেন। এটাই ছিল সন্ধ্যা নদীর পারের কুঠিয়াল রহিমের পেশা। তার বাবাও এ কাজ করতেন। দুধের গরু ছিল। নদীর পারে কয়েক বিঘা জমিও ছিল। সুখের কমতি ছিল না একটুও। ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালোই কাটছিল তার। সন্ধ্যার ভাঙন শুরু হলো। প্রথমে জমি গেল। তারপর বসতবাড়ি। অভাবের টানে বিক্রি করে দিলেন দুধের গরু। সব হারিয়ে নিঃস্ব রহিমের ঠাঁই হয়েছে অন্যের বাড়িতে। এককালের গেরস্থ রহিম এখন রিকশা চালান। ছেলেমেয়েরও পড়াশোনা হয়নি। মানুষের বাড়িতে কাজ করে তারা। বরিশালের বানারীপাড়ায় রহিমের বসবাস।
আহারে মায়া
নদীতে যখন তখন নেমে পড়া। নদীর পানি কাজে লাগানো। নৌকায় বাজারসদাই নিয়ে আসা। উৎপাদিত পণ্য নৌকায় বাজারে নিয়ে যাওয়া। মাছ ধরার জন্য নদীতে নৌকা ভাসানো। এমনিভাবেই সন্ধ্যাপাড়ের মানুষের জীবনে নদীর সম্পৃক্ততা। প্র্রয়োজনই কেবল নয়। মায়ার ভালোবাসার বন্ধনে তারা নদী আগলে রাখেন। নদী তাদের বড় ভালোবাসার ধন। নদীর আগ্রাসি ভাঙনে সব হারালেও ভালোবাসা হারায় না। সে গল্পটা শোনা যাক কৃষক জামালের মুখে। ‘মোর বাড়ি একবার নদীতে ভাঙ্গনে গেছে। তারপর আবার ঘর তুলি। আবার নদীর পেটে। এরপর আরও একবার। মোট তিনবার। তার পরও নদী ছেড়ে কোথাও যাইতে পারি না।’ কেন পারেন না? ‘মায়ায় জড়াইয়া গেছি। গাঙ্গের পাড়ে না বইটড পড়লে, নাও না চালাইলে, না পারলে মনে শান্তি পাই না।’ তৃতীয়বার জামাল যে বাড়িটা করেছেন তা-ও যেকোনো সময় সন্ধ্যার অতলগহ্বরে হারিয়ে যাবে। সন্ধ্যা থেকে খুব বেশি দূরে যেতে পারেননি।
রহিমার বাড়িটা ছিল সন্ধ্যার পারেই। তাকালে নদীর মোহনীয় রূপ চোখে ধরা পড়ত। ধান এনে সেদ্ধ করে রোদে শুকানোর পর ভাঙিয়ে চাল হয়। এ কাজ যারা করে তাদের কুঠিয়াল বলে। ধান থেকে চাল তৈরি করে বিক্রি করতেন রহিমা ও তার স্বামী। একমাত্র শিশু সন্তানটি নিয়ে এভাবে ভালোই কাটছিল দিন। একদিন খেলতে খেলতে নদীর পারে চলে যায় শিশুটি। খেয়াল হয়নি কারও। এরপর পানিতে ডুবে তার মৃত্যু পাল্টে দেয় রহিমার জীবন। কিন্তু এখনও তারা আগের কাজটিই করেন। নদী থেকে দূরে কোথাও বাড়ি করা সম্ভব হয়নি তার। সন্ধ্যার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ বুকে হাহাকার তোলে। তবু নদীকেন্দ্রিক এসব রহিমার জীবন কোনোরকম চলে যায়।
দাদা, বাবা সবাই সন্ধ্যা নদীতে মাছ ধরতেন। সে পেশায় একসময় খেয়েপরে ভালো ছিলেন আব্বাস উদ্দিন। জাল ভর্তি রুপালি ইলিশ ধরা পড়ত। জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। হাসি আনন্দে ভরপুর। এখন দিন বদলেছে। বদলানোর ধরনটা সম্পর্কে আব্বাস বলেন, ‘এখন আর আগের মতো নদীতে মাছ পাই না। কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে আছি। মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু পারি না।’ শীর্ণ আব্বাসের মুখটা বড্ড মলিন। কংকালসার দেহ। বিষণ্ন মুখ। বোঝাই যায়, খাদ্যের অভাব কতটা ভোগাচ্ছে।
জেলেদের দুর্দিন
নদীকেন্দ্রিক জীবনজীবিকা ছিল তাদের। জাল ফেলে কিছুক্ষণ বসলেই হতো। রুপালি ইলিশে ভরে উঠত। ছোট জালে ইলিশ দেখলেই জেলের মুখে হাসি ফুটে উঠত। লম্বা চওড়া চকচকে ইলিশ উঠত। ইলিশ বিক্রি করে ভালোই কাটত তাদের দিন। সন্ধ্যার জেলেদের জন্য এসব এখন অতীত। ‘এখন আর তেমন মাছ পাই না। সারা দিনে দুয়েকটা পাই। কোনো দিন একটাও না।’ বলছিলেন জেলে কামাল উদ্দিন। বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। অভাবের সংসার। এ বয়সেও তাকে জাল ফেলতে হয়। ‘মাছ না ধরলে খামু কী? পোলার একার কামাইয়ে সংসার চলে না।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন কামাল। এ দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে চাপা পড়ে অছে তার সোনালি অতীত।
কেউ ভালো নেই
দেশে বর্তমানে ২০০ কিলোমিটারের বড় নদ-নদী রয়েছে ১৪টি। এ ছাড়া ১০০ থেকে ১৯৯ কিলোমিটারের নদ-নদী ৪২টি, ১০ থেকে ৯৯ কিলোমিটারের নদ-নদী ৪৮০টি এবং ১ থেকে ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদনদীর সংখ্যা ৩৭৬। ১ কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের নদ-নদী রয়েছে ৪১টি। সবচেয়ে বেশি নদনদী সুনামগঞ্জ জেলায়, ৯৭টি। গড়পড়তা কোনো নদ-নদীই ভালো নেই। দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। শুধু জেলে, কৃষক, মাঝি নয়; নদ-নদী ভালো না থাকলে কোনো মানুষেরই ভালো থাকার উপায় নেই। প্রত্যক্ষভাবেই নদ-নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সব মানুষের জীবন।
নদীকেন্দ্রিক। খাদ্য-মাছ উৎপাদন, দারিদ্র্যমোচন, হেলথ অ্যান্ড হাইজিনÑসব কিছুতেই নদ-নদীর ভূমিকা আছে। ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলোর পাশের জমি ছিল দোফসলি। কারখানার বর্জ্যে দূষণে এখন এক ফসলও হয় না। টঙ্গী থেকে বালু নদের ওপর অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ দোফসলি জমিগুলো এখন প্রায় খালিই পড়ে থাকে।