× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পাথরের জাদুঘর ঘুরে এসে...

আল-আমিন

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৪ ১৫:০৯ পিএম

পঞ্চগড়ের রকস মিউজিয়ামে বিভিন্ন পাথর ছাড়াও আছে শালগাছ খোদাই করে তৈরি প্রায় ৩ শতাব্দী প্রাচীন দুটি নৌকা। ছবি : লেখক

পঞ্চগড়ের রকস মিউজিয়ামে বিভিন্ন পাথর ছাড়াও আছে শালগাছ খোদাই করে তৈরি প্রায় ৩ শতাব্দী প্রাচীন দুটি নৌকা। ছবি : লেখক

সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা এ জাদুঘর। বিষয় বৈচিত্র্যেও আলাদা। এটি পাথরের জাদুঘর বা রকস মিউজিয়াম। কঠিন শিলা নিয়ে দেশের প্রথম এবং একমাত্র সংগ্রহশালা এটি। এখানে আছে নানান প্রজাতির এবং আকারের পাথর। পঞ্চগড়ে অবস্থিত ভিন্নধর্মী এ জাদুঘর ঘুরে এসেলিখেছেন আল-আমিন

জাদুঘর হলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানের সংগ্রহশালা, যেখানে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, শিল্পবিষয়ক নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সংগ্রহ করে জনসাধারণের উদ্দেশে প্রদর্শন করা হয়। তবে এক ব্যতিক্রমী সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. মো. নাজমুল হক। ১৯৯৭ সালে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলেন ‘রকস মিউজিয়াম পঞ্চগড়


রকস মিউজিয়াম নামটি শুনেই মাথায় আটকে যায় ‘রকস শব্দটি। রকস মানে ‘শিলা। এখানে বিভিন্ন ধরনের শিলা ও শিলাখণ্ড সংরক্ষিত রয়েছে। শিলা প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত- আগ্নেয়, পাললিক ও রূপান্তরিত। রকস মিউজিয়ামে তিন ধরনের শিলাই আছে। যার মধ্যে অন্যতম গ্রানাইট, বেলেপাথর, চুনাপাথর, সিস্ট, সিলিকা প্রভৃতি।

১৯৯৭ সালে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হক এ সংগ্রহশালাটি গড়ার উদ্যোগ নেন। তিনি জানান, কলেজটি দৃষ্টিনন্দন করতে ও গোছাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেন। এর মধ্য পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ, ফুলের বাগান তৈরিসহ পঞ্চগড়ের বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর সংগ্রহ করেন কলেজের সৌন্দর্য বাড়াতে। এভাবেই গড়ে তোলেন রকস মিউজিয়াম। মিউজিয়াম গড়তে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও খরচে প্রথমে পাথর সংগ্রহ করতেন। পাথর সংগ্রহে ঝামেলায় পড়লে পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তা পেতেন বলে জানান।

বর্তমানে রকস মিউজিয়ামের সংগ্রহ ১ হাজার ২০০-এর অধিক। ২০০৮ সালে এলজিইডি থেকে একটি দ্বিতল রকস ভবন করে দেওয়া হয় মিউজিয়ামের জন্য। প্রথম তলায় রয়েছে মিউজিয়াম, দ্বিতীয় তলাটি ক্লাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে নতুন ভবন হলে এটি ছেড়ে দেওয়া হবে রকস মিউজিয়ামের জন্য।

এটি মূলত পাথরের সংগ্রহশালা হলেও পঞ্চগড়ের লোকশিল্পের নিদর্শনও সংরক্ষিত আছে এখানে।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে ঢুকতেই চোখে পড়বে দ্বিতল রকস ভবন; যার প্রথম তলায় রকস মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের বাইরে চোখে পড়বে দুর্লভ সব ঐতিহাসিক পাথরের সংগ্রহ। লম্বাটে, গোলাকার; সাদা, হলুদ, কালো ইত্যাদি।


নাজমুল হক ও নাজিবা সাইয়ারা তাদের Rocks Museum : A Key for Uncloaking Ancient Human Habitation গ্রন্থে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিলাগুলো চার শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথা পরিবেশগত শিলা, প্রত্নতাত্ত্বিক শিলা, নৃতাত্ত্বিক শিলা ও জাতিতাত্ত্বিক শিলা।

মিউজিয়ামে ঢুকতেই পাথরের পাশাপাশি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংগ্রহও চোখে পড়বে। আছে প্রাচীনকালের মূর্তি, টেরাকোটা বা পোড়ামাটির নকশা, প্রাচীন মুদ্রা। দৃষ্টি আকর্ষণ করে শালগাছের মাঝখানে খোদাই করে তৈরি প্রায় ৩ শতাব্দী প্রাচীন দুটি নৌকা।

এ অঞ্চলের ভূখণ্ডের বয়স নির্ণয়, ভূ-বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান, প্রাগৈতিহাসিককালের নমুনা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয় জাদুঘরটি। মিউজিয়ামের ভেতর উন্মুক্ত গ্যালারিতে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ছোটবড় পাথর, আগ্নেয়শিলা, পাললিক শিলা ও নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, কাচবালি, খনিজ বালি, সাদা মাটি, তরঙ্গায়িত চ্যাপটা পাথর, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিনশিলা ও হরেক রকমের পাথরের সমারোহ। এ ছাড়া আছে এ অঞ্চলের নানা রকমের মৃৎপাত্র, মাটির কূপের জন্য ব্যবহৃত রিং, ব্রিটিশ আমলের মাইলফলক, প্রথম মহকুমা চেয়ার, প্রথম কম্পিউটার, গ্রামোফোনসহ নানা দুর্লভ তৈজসপত্র।


এ সংগ্রহশালার বৃহৎ একটি অংশ পরিবেশগত শিলা; যা বিভিন্ন উপাদানে তৈরিÑআগ্নেয়, পাললিক ও রূপান্তরিত শিলা। প্রত্নতাত্ত্বিক শিলা বলতে বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবহার্য শিলাখণ্ডকে বোঝানো হয়েছে; যেগুলো দ্বারা প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বোঝা সম্ভব। যেমন সমাধি কিংবা বিভিন্ন স্থানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত শিলাখণ্ড দ্বারা নির্মিত পাথরের স্লাব প্রভৃতি। নৃতাত্ত্বিক শিলা বলতে মানুষের ব্যবহারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ বহন করে এমন নিদর্শন যেমন বিভিন্ন আকৃতি দিয়ে কাটা শিলা যেগুলো কোনো বৃহৎ শিলার অংশ হতে পারে। এ ছাড়া পাথরের তৈজসপত্র, হাতিয়ার, বিভিন্ন ধরনের চিত্র বা সংকেতযুক্ত শিলাখণ্ড। রকস মিউজিয়ামে বিভিন্ন ধরনের পাথর এবং পাথরের তৈরি উপাদান ছাড়াও রয়েছে দুটি বৃহৎ শালকাঠের নৌকা। ধারণামতে সেগুলো প্রায় হাজার বছরের পুরোনো। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, ভিতরগড় প্রত্নস্থান থেকে পাওয়া প্রত্ননিদর্শন যেমন ইট, এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া মূর্তি, বাঁশের তৈরি নিদর্শন প্রভৃতি।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. লুৎফর রহমান প্রধান বলেন, ‘আমি কলেজের দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢেলে সাজিয়েছি মিউজিয়ামটি। দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী এটি দেখতে আসেন, এটি কলেজকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করছে। কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে আরও ভালোভাবে এটি চালানো যাবে। মিউজিয়ামটি সমৃদ্ধ ও আধুনিকায়ন করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।


অধ্যাপক মো. হাসনুর রশিদ বাবু জানান, রকস মিউজিয়ামটি পাথরের পাশাপাশি পঞ্চগড়ের ঐতিহাস-ঐতিহ্য, লোকশিল্প সংগ্রহ এবং পর্যটনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

দেশের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এ অঞ্চলে পাথরের নিদর্শন তেমন পাওয়া যায় না। বিভিন্ন স্থাপনায় ইট-সুরকির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তদুপরি, পাথরের যে নিদর্শনগুলো পাওয়া গেছে সেগুলোও সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি বললেই চলে। অথচ এ ভিন্নধর্মী মিউজিয়ামটি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। রকস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত পাথরগুলো নব্যপ্রস্তরযুগের প্রমাণ বহন করছে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হক। অনেক পাথর পাওয়া গেছে ভিতরগড় এলাকায়। ধারণা করা হয়, সেগুলোও অনেক পুরোনো। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু পাথর সেতু নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এ অঞ্চলে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে পাথরের ব্যবহার লক্ষণীয়। বিভিন্ন পাথরের গায়ে জ্যামিতিক নকশা, তির-ধনুক, মানুষের চোখ ইত্যাদি অঙ্কিত রয়েছে। এ ছাড়া কিছু কিছু সংকেতে নেপালি, ব্রাহ্মী ও চীনা লিপির সাদৃশ্য রয়েছে বলে নাজমুল হকের পূর্বোক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে পাথরের হাতিয়ার নিঃসন্দেহে প্রাগৈতিহাসিক পাথরের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে। এখানে সংরক্ষিত অনেক পাথরের সঙ্গে অতীত মানুষের ধর্মীয় রীতির সংশ্লিষ্টতা থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায় না। পাশাপাশি এ নিদর্শনগুলো হিমালয়ের পাদদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের পরিচয় বহন করতে পারে।

জাদুঘরে দুটি বৃহৎ শালকাঠের নৌকা সংরক্ষিত রয়েছে। যদিও এগুলোর আকার-আকৃতি বর্তমান বাংলাদেশে প্রাপ্ত নৌকার সঙ্গে মেলে না। সেগুলো আদিবাসীদের দ্বারা নির্মিত ও ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা। অর্থাৎ রকস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত প্রত্ননিদর্শন গবেষণার মাধ্যমে এ অঞ্চলের ইতিহাস নতুন করে বিনির্মিত হতে পারে; যেগুলো মানুষের অতীত সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে।

প্রদর্শনীর বেশিরভাগ পাথর ভিতরগড় দুর্গনগরী এবং এর আশপাশ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত। জনশ্রুতি আছে, দেড় হাজার বছর আগে ভিতরগড় ছিল পৃথু রাজার রাজধানী। জাদুঘরটি আয়তনে ছোট হলেও এর দুর্লভ সংগ্রহে মুগ্ধ হন দর্শনার্থী।


এখানে একটি জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে আছে এ অঞ্চলের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ব্যবহৃত কালনাগ, মনসার পিতলমূর্তি, বিষোহরির মূর্তি, বিষ্ণু-গণেশের মূর্তি, ধাতবপাত্র, প্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ, পিঁপড়ার বাসার জীবাশ্ম, হুলির গানে ব্যবহৃত ঢোল, সাঁওতালদের ব্যবহৃত ধূম্রদব্য সাকামচুকি, পাথরের বাটি। আরও চোখ কাড়ে মোগল সেনাদের তরবারি; যা দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করে এবং এ অঞ্চলের জীবনবৈচিত্র্য সম্পর্কে জানা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র এ পাথরের জাদুঘরটি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে।

তবে কিউরেটর না থাকাসহ নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে দেশের একমাত্র ব্যতিক্রমী এ পাথরের সংগ্রহশালাটির। কলেজ প্রশাসনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এটি চলে।

আগ্রহীরা যেতে চাইলে ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে পঞ্চগড় এসে রিকশায় পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে গেলেই দেখতে পাবেন মিউজিয়ামটি। প্রবেশ ফি সাধারণের জন্য ২০ টাকা। শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা। উত্তরের প্রান্তিক জনপদ পঞ্চগড়ের সমতলভূমির চা-বাগান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রকস মিউজিয়াম দেখতে ঘুরে যেতে পারেন প্রিয়জন ও পরিবার নিয়ে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা