ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৪৭ এএম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৪৫ পিএম
প্রতীকী ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র সবুজ চন্দ্র মিত্রের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। তখন সবুজ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রথম বর্ষে শ্রেণিকক্ষে প্রথম হন সবুজ। তবে দ্বিতীয় বর্ষে তার স্বপ্ন পূরণে শঙ্কা তৈরি হয়। মিডটার্মের ফলাফল, যেখানে সবুজ ১৫ মার্কে ৫ পান। সবুজের ধারণা তৈরি হয় হয়তো এই ফলাফলের জন্যই তার আর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না।
ভাবতে ভাবতে এক সপ্তাহের মাথায় আত্মহননের পথ বেছে নেন সবুজ। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে পরিবারের সবচেয়ে ছোট সবুজ ছিলেন সবচেয়ে মেধাবী। মিডটার্মের ৫ নম্বর কেন, সবুজের ওপর এতটা প্রভাব পড়েছিল? কেন তিনি মনে করলেন জীবনে তার আর শিক্ষক হওয়া হবে না? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। তাকে নিয়ে কথা হয় সবুজের ভাই নির্মল চন্দ্র মিত্রের। একই হলে একই সঙ্গে থাকতেন দুই ভাই। নির্মল তখন বাংলা বিভাগে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়তেন। তিনি বলেন, সবুজের ফলাফল খারাপ হওয়ার পেছনে শিক্ষকের মন্তব্য ছিল ওর হাতের লেখা ভালো না। সেদিন সবুজ একটি পোস্টও করেছিল ফেসবুকে সেখানে সে লিখেছিল হাতের লেখা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য ভাইয়ের চাপা স্বভাবও অনেকটা কারণ বলে মনে করেন নির্মল। তিনি বলেন, বাবা ২০১৫ সালে মারা গেলে আমিই টিউশনি করে সবুজের খরচ চালাতাম। ফলাফল খারাপ হওয়ায় প্রায়ই মন খারাপ থাকত। তবে সে সারাক্ষণই পড়ত। ওর একটা শার্ট দরকার হলেও আমি কিনে দিতাম। এর বাইরে একজন বন্ধু ছাড়া আর কারও সঙ্গে কোনো কথা বলত না। একা থাকত, আর শুধু পড়ত। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নটা এতটাই গেঁথে গিয়েছিল সে ধরেই নিয়েছে এই মার্কের জন্য তার আর শিক্ষক হওয়া হবে না। তবে আমি চাই, আমার ভাইয়ের মতো ভুলটা যেন কেউ না করে।
সেদিন কী ঘটেছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি হলে দুপুরে ঘুমাচ্ছিলাম। কাউকে কিছু না বলেই আমাদের বাড়ি পটুয়াখালীতে চলে যায় সে। সেখানে সবার সঙ্গে কথা বলে মেশে। সবসময় মায়ের সঙ্গে ঘুমালেও সেদিন ঘুমায়নি। মাঝরাতে ঝুলে পড়ে। আমার দোলাভাই আমাকে ফোনে জানায় মা খুব অসুস্থ বাড়ি যেতে হবে। তড়িঘড়ি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে হলের একজন এসে বলল সবুজ কাজটা কী করল! ততক্ষণে আমিও বুঝেছিলাম, তবে বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে সময়টায় আমি চাকরির প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম, তাই খুব বেশি ওর দিকে খেয়াল করেত পারিনি। তবে ঘটনাটা এতদূর যাবে তা ছিল কল্পনার বাইরে। যতদূর শুনেছি সে ফলাফলের পর শিক্ষকের রুমে গিয়েছিল। কখনও কখনও ও মিডটার্মে ১৫ নম্বরে ১৩ পেয়েছিল। সেই ছেলেটা ৫ নম্বর পেয়ে মেনে নিতে পারেনি। বিষয়টাও খুব অদ্ভুত। হাতের লেখা এত খারাপ হলে কি কেউ প্রথম হতে পারে?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার (ছদ্মনাম)। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী তখন। পরীক্ষা শেষে রমজানের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেননি তাহমিনা। আট বছর আগের এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন তাহমিনার বন্ধু মাহমুদ হাসান। তাহমিনা মৃত্যুর দুই দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় তার গ্রামের বাড়িতে। মেডিকেল রিপোর্টে দেখা যায় তাহমিনা বিষ পানে মারা গেছেন।
তাহমিনা থাকতেন তার মায়ের কাছে। ছোটবেলায়ই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। মা চাকরিজীবী ছিলেন বলে প্রায়ই বাইরে থাকতে হতো। সেদিনও বাসায় কেউ ছিল না।
তিনি বলেন, রমজানের আগে আমাদের একটা পরীক্ষা হয়। তাহমিনা ছিল খুব পড়ুয়া। ফলাফলও খুব ভালো ছিল। সেদিন পরীক্ষার হলে কোনো কারণে তার খাতা নিয়ে যান কর্তব্যরত শিক্ষক। তারপর অনেকটাই মন ভেঙে পড়েছিল। পরীক্ষাটা ভালো করে দিতে পারেননি। তবে বাড়িতেও তিনি খুব একাকিত্বে ভুগতেন।
দেশে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া আত্মহত্যা ফৌজদারি অপরাধ ও পাপ হিসেবে গণ্য হয়। ফলে কারও মধ্যে কোনো কারণে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগলেও ভয়ে তিনি তা প্রকাশ করেন না। মানসিক স্বাস্থ্যকে অবজ্ঞা করা, সামাজিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, অসহিষ্ণুতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব, মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, মাদকাসক্তি এবং মানুষের যন্ত্রনির্ভরতা অনেকটা বড় কারণ।
২০২৩ সালে সারা দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার অন্তত ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় জানা গেছে। প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, নিহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২২৭ (৪৪.২%) জন স্কুলের, ১৪০ (২৭.২%) জন কলেজের, ৯৮ (১৯.১%) জন বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ৪৮ (৯.৪%) জন মাদ্রাসার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৬০ দশমিক ২ শতাংশ ছিলেন মেয়ে শিক্ষার্থী। আর বাকি ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ছেলে। এ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ ছিল আবেগ বা অভিমান। ১৬৫ জন বা ৩২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী আবেগঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে, রোমান্টিক সম্পর্ক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চসংখ্যক পড়ুয়ার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর এ বিভাগে ১৪৯ জন শিক্ষার্থী এ পথ বেছে নেন। অন্যদিকে সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
বাংলাদেশে এখন মোট জনগোষ্ঠীর ১৮ ভাগ মানসিক রোগে ভুগছেন। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় বলা হয়, ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৪৮ দশমিক ৪ ভাগ মানসিক রোগী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ ৩৪৭ জন রোগীর ওপর গবেষণা করে ওই তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই রোগীদের মধ্যে ১৬৮ জন কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছিলেন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। প্রতিমাসে অন্তত একবার সব শিক্ষার্থীর জন্য নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া এটি দ্রুত ও সহজলভ্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য কর্নার স্থাপন এবং একটি টোল ফ্রি জাতীয় হটলাইন চালু করতে হবে।
তিনি বলেন, চূড়ান্ত হতাশা থেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এর পেছনে অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক কারণ আছে। সেগুলো এখনও বিদ্যমান। সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অস্থিরতা, যারা এসব নিতে পারেন না তারাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
পরিবারের বাবা-মায়ের মানসিক অবস্থাটাই বিপন্ন বলে মন্তব্য করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুলতানা আলগিন। তিনি বলেন, পরিবারের বাবা-মাই জানে না তাদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে। সন্তান যে ভেতরে ভেতরে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে, তা বাবা-মা কী করে ভাববে। একা সন্তান বেড়ে ওঠায় তারা তাদের কথাগুলো যেমন বলতে পারে না, তেমনি বাবা-মা বা বন্ধুদের কাউকেও সে কথাগুলো বলতে পারত, তাহলে হয়তো ঘটনাটা ঘটত না।
তিনি বলেন, ছোট ছোট ঘটনা জমা হতে হতেই আত্মহত্যাপ্রবণ হয়। যারা হঠাৎ করে কিছু করে ফেলে সেটাকে বলে ডিসিশন ইমপালসিভ পারসোনালিটি। যেকোনো ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে পরিবার, বন্ধুরা ভূমিকা রাখতে পারে। সবকিছু একটা আরেকটার সঙ্গে যুক্ত। একে অপরের সঙ্গে ইন্টারেকশনগুলো থাকতে হবে।