মিস্ট্রি অব উত্তরাখণ্ড
আরিফুর সাজ্জাদ
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:৪৯ পিএম
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:১৫ পিএম
প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ফিট উচ্চতায় মাউন্ট ত্রিশূলের কোলে জায়গা পাওয়া রূপকুণ্ড লেক হচ্ছে এই ট্রেকের মূল আকর্ষণ
ভারতের উত্তরাঞ্চলের জনপ্রিয় ট্রেকিং জোন এই রূপকুণ্ড ট্রেকিং জোন। প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ফিট উচ্চতায় মাউন্ট ত্রিশূলের কোলে জায়গা পাওয়া রূপকুণ্ড লেক হচ্ছে এই ট্রেকের মূল আকর্ষণ। এই লেকের হিমশীতল সৌন্দর্যের জন্য তো বটেই সঙ্গে ট্রেকিং রুটের যে অপরূপতা তাই মানুষকে টেনে আনে এই ট্রেকে।
এই ট্রেকিং রুটে আপনি এক্সপ্লোর করতে পারবেন এলপাইন আর ‘ফি’ নামের গাছের জঙ্গল, রোডোডেনড্রন আর ওকের ঘন বন। মাউন্ট ত্রিশূলের দাম্ভিক গাম্ভীর্যের দৃশ্য ভোলার নয়। রূপকুণ্ড লেক থেকে দেখা মিলবে চৌখাম্বা রেঞ্জ, নীলকান্ত পিক, কেদারনাথ আর কেদারদামের।
রূপকুণ্ড মূলত ছোট্ট একটা গ্লেসিয়ার লেক, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার মিটার উঁচুতে। স্কেলেটন লেক নামেও একে ডাকা হয়, এখানে-সেখানে মানুষের কঙ্কাল ছড়িয়ে আছে বলে। এই কঙ্কালগুলো কীভাবে এলো এ নিয়ে নানা মিথ থাকলেও এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে জানা যায়নি কাদের কঙ্কাল এগুলো আর কীভাবেইবা এলো এখানে! ভারতের উত্তরাখণ্ডের অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেক রুট এই রূপকুণ্ড। বছরের ৬-৮ মাস বরফের নিচে ঢাকা থাকে এই রুট। মূলত এখানে ট্রেক করার জন্য দুটি সিজন আছে; মে মাসের শেষ থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর।
এখন গন্তব্য ভারতের উত্তরাখণ্ড। রূপকুণ্ড ট্রেক ধরে চলব। উঠব সাড়ে ১৬ হাজার ফুট উঁচু গ্লেসিয়ার লেক রূপকুণ্ডে। রাতে হাওড়ায় ট্রেনে চড়ে বসলাম। প্রায় ৩৬ ঘণ্টার জার্নি। ৬৬টি স্টেশন পেরিয়ে নামলাম উত্তরাখণ্ডের কাঠগুদামে। ততক্ষণে সবাই ক্লান্ত।
যাব দিদনা। সাত ঘণ্টার ট্রেকিং, ১০ কিলোমিটার পেরোতে হবে। এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথ ধরে যাচ্ছি। যতই এগোচ্ছি শীতের প্রকোপ বাড়ছে। তবে থামলে চলবে না। অবশেষে ৮ হাজার ৬০০ ফুট ওপরের দিদনা। তাপমাত্রা তখন দুই ডিগ্রি। শীতে সবাই জবুথবু। প্রথম ক্যাম্প করলাম। রাতের অবসরে দুপাশের পাহাড়ি দৃশ্য অপরূপ, ক্লান্তি অনেকটাই দূর হয়ে গেল। কেউ খুনসুটিতে ব্যস্ত, কেউ গলা ছেড়ে গান ধরল। পরদিন পাঁচ ঘণ্টা হেঁটে যাব ১২০০ ফুট ওপরের পাথার নাচুনি। সে যাত্রাপথের কষ্টের কথা না বলাই ভালো।
পথের চেয়ে আরও বড় চ্যালেঞ্জে পড়লাম পাথার নাচুনিতে এসে। তাপমাত্রা ১৬ হলেও ভয়ানক ঠান্ডা বাতাস বইছে। হিম বাতাস যেন হাড়ে কামড় বসাচ্ছে। রাতে তাপমাত্রা নেমে এলো চার ডিগ্রিতে। পাঁচ স্তরের ভারী শীতের কাপড়েও কাজ হচ্ছে না, শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। ভোরের আলো ফোটার পর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তখন শুরু হলো নতুন যন্ত্রণা বৃষ্টি। তিন ঘণ্টায় মাত্র তিন কিলোমিটারের বেশি যাওয়া গেল না।
১৪ হাজার ২০২ ফুট ওপরে ভাগ্যবাসায় ক্যাম্প করতে হলো। ঠান্ডা, বৃষ্টি, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। তাঁবু টানাতে পারছি না, রান্নার আগুনও জ্বলছে না। এ অবস্থায় বাঁচিয়ে দিল অভিজ্ঞ গাইড। কাছের এক ছাউনিতে নিয়ে গেলেন হিমানচু। ততক্ষণে সবাই কাহিল। অনেকের গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। তার পরও থামতে নারাজ। এত কাছে এসে থেমে যাওয়ার মানে হয় না।
বিখ্যাত মাউন্ট ত্রিশূল। যেমনি নাম তেমনি তার গড়ন, সত্যিই অসাধারণ। দৃশ্য সুখকে সঙ্গে করেই একে একে সকালের কাজকর্ম ও ব্রেকফাস্ট সেরে আবার যাত্রা শুরু। আজকের গন্তব্য বাগুয়াবাসা। ক্যাম্প সাইট পেছনে ফেলে কিছুটা ওপরে উঠতেই ডানদিকে চোখে পড়ল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুগিয়ালের মধ্যে অন্যতম আলী বুগিয়াল। তবে আমাদের এগোতে হবে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে তাই আলী বুগিয়ালকে দূর থেকে দেখেই মনবাঞ্ছা মেটাতে হলো। লোহাজং থেকে দিদিনা হয়ে এলে ওই বুগিয়ালের ওপর থেকে আসা যায়। প্রথম দিকে পাথরনাচুনী অবধি মোটামুটি সমতল রাস্তা। পাহাড়ের রিজ ধরে ট্রেক করতে বেশ মজাই লাগল। পাথরনাচুনীতে ক্যাম্প হয় তবে আমরা সেখানে শুধু লাঞ্চ ব্রেকের জন্যই থামলাম।
ম্যাগি আর চা দিয়ে লাঞ্চপর্ব শেষ করে আবার হাঁটা শুরু। পাথরনাচুনী থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার পথ কুলুর বিনায়ক পৌঁছতে আমাদের লাগল প্রায় তিন ঘণ্টা। খাড়া চড়াই যাকে বলে সেটাই টের পেলাম এইটুকু পথ আসতে। পরের দুই কিলোমিটার পথ অপেক্ষাকৃত কম চড়াই থাকায় বেশ গতিতেই পার করব বলে ভেবেছিলাম। তবে বড় বড় পাথর বিছানো এই পথ পেরোতে একটু বেগ পেতে হলো। প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকায় টেন্টের মধ্যেই বুড়ো সাধু আর ভবনের মুখে বর্ণিত রূপকুণ্ডের ইতিহাস শুনেই সন্ধেটা কাটল।
মোবাইলে অ্যালার্মের দৌলতে ঘুম ভাঙল ভোর সাড়ে ৪টায়। বলাই বাহুল্য আকাশে তখনও আলোর লেশমাত্র নেই। কোনো রকমে এক কাপ চা খেয়ে আধাঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম ভবনকে সঙ্গে নিয়ে। মাইনাস টেম্পারেচারে পাথুরে এবড়োখেবড়ো পথে টর্চ হাতে আমাদের অভিযান চলল। প্রথম এক কিলোমিটার চলার পর যেখানে পৌঁছলাম সেখান থেকে পথ আরও কঠিন। পাথুরে রাস্তা সেখানে গিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ির মতো ওপরে উঠে গেছে। এই জায়গাটা হলো চিরিয়ানাগ।
রন্টি স্যাডেল ট্রেকে এই পথে পোর্টার ভাইয়েরা পিঠে করে মালপত্র টেনে নিয়ে যায়। আমাদের তো নিজেদের টেনে নিয়ে যাওয়াই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফোটায় লক্ষ করলাম আমরাই রূপকুণ্ডগামী সেদিনের প্রথম দল। অনেকটা নিচে আরও কিছু লোকের আনাগোনা চোখে পড়ল। ওপরের দিকে পথ আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠল। রাস্তা একে তো অত্যধিক ঢালু ও সংকীর্ণ, উপরন্তু ছোট পাথরে পরিপূর্ণ। যা কি না স্টেপ ফল করে নিচে পড়ার জন্য আদর্শ। এর মধ্যে আবার দোসর হলো স্নো ফল। যার ফলে পিছলানোর সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল। যাই হোক অতি সাবধানে, কিছু ক্ষেত্রে একে অপরের হাতে ভর করে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছলাম।
মেঘলা আকাশ ও স্নো ফলের জন্য দৃশ্য সুখ সেভাবে হলো না ঠিকই তবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরে আনন্দের অবকাশ রইল না। এই সেই রূপকুণ্ড লেক। ভূপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ১৬ হাজার ফুট ওপরে। লেক দেখে খুশিতে আত্মহারা হলেও কারও মুখ দেখে বোঝার জো নেই। একে তো অক্সিজেনের অভাবে দম নেওয়া যাচ্ছে না, তার ওপর ঠান্ডায় নাকাল অবস্থা। আকাশে মেঘ নেই। হিমালয়ের বরফ দেখছি পরিষ্কার। চোখে পড়ছে বিখ্যাত ত্রিশূল পর্বতমালা। পশ্চিম কুমায়ন পর্বতমালায় সর্বোচ্চ তিন চূড়া নিয়ে ‘ত্রিশূল’।
চারদিক বরফাবৃত আর তার মাঝে সেই বিখ্যাত রহস্যময়ী রূপকুণ্ড। পৌরাণিক মতে দেবী পার্বতী কৈলাস যাওয়ার সময় তার শৃঙ্গারের জন্য এই কুণ্ড নিজেই সৃষ্টি করেছিলেন। এই লেককে আরও বেশি রহস্যময় করে তুলেছে বহু বছর ধরে পড়ে থাকা মানব কঙ্কাল ও হাড়ের অবশিষ্টাংশ, যা নিয়ে অনেক রিসার্চ হয়েছে ঠিকই তবে তা নিয়েও অনেক মতভেদ আছে। যাই হোক, সেই মতভেদ থেকে মাথা না ঘামিয়ে আমরা এবার চা পানের বিরতি নিলাম। ঠিক ছিল আরও একটু ট্রেক করে জুনার গলি পাস অবধি যাব। কিন্তু আবহাওয়া এতটাই প্রতিকূল হতে থাকল যে, শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা বাতিল করে নিচে নামা শুরু করলাম। প্রায় পনেরো হাজার ফুট ওপর থেকে নিচের দৃশ্যটা ছিল প্রাণবন্ত।
পাহাড়ের রং কোথাও বাদামি তো কোথাও কালচে আবার কোথাও নীলচে সবুজ। এভাবেই একের পর এক পাহাড়ের সারি আকাশে বিলীন হয়ে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে বসে থেকে উপভোগ করার মতো সে দৃশ্য। তবে আমাদের হাতে অতক্ষণ সেখানে থাকার উপায় নেই। কারণ একে তো নিচে নামার চিন্তা তার মধ্যে আবার খারাপ আবহাওয়া। কাজেই এগোতে থাকলাম ক্যাম্প সাইটের দিকে। ১০টা নাগাদ বাগুয়াবাসা ফিরে সবাই মোটামুটি বিধ্বস্ত। যে যার মতো দেহ ফেলে দিলাম। প্ল্যান ছিল দুপুর ১২টার মধ্যে এখানকার পাট চুকিয়ে আবার ওইদিনই পাথরনাচুনী নেমে যাব। মাত্র চার কিলোমিটার রাস্তা, কোনো চাপ নেই। কে জানে কার কপালে কখন কী লেখা থাকে! বেলা সাড়ে ১১টার পর থেকে নামল বৃষ্টি।
১ ঘণ্টা দেরি হলেও কোনো অসুবিধা নেই, আপাতত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু পাহাড়ের বৃষ্টি কি আর সময় দেখে আসে! সে তো অবিরাম হয়েই চলেছে। দুই ঘণ্টা পরও কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং তার তীব্রতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে সঙ্গে আবার শিলার উপদ্রব। প্রায় টেন্ট ফুটো হয়ে যাওয়ার জোগাড়। একসময় তো ভেবেই নিয়েছিলাম আজ আর পাথরনাচুনী পৌঁছানো হবে না। অবশেষে এই ভাবনার সমাপ্তি ঘটল বিকাল ৩টার পর। বৃষ্টিও এবার হাঁপিয়ে উঠেছে। শেষমেশ টেন্ট তুলে আমরা রওনা হলাম। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই আমরা পাথরনাচুনী পৌঁছে গেলাম। জায়গাটা বেশ মনোরম। এখান থেকেও নীলকণ্ঠ, নন্দঘুঁটির মতো বেশকিছু পর্বত দৃষ্টিগোচর হয়।
সেদিনের রাতটা সেখানেই কাটিয়ে পরদিন আমরা ট্রেক শুরু করলাম কানোলের উদ্দেশে। এই পথে এমনিতে খুব বেশি লোকের যাতায়াত নেই। তাই ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর হবেÑ এই ভেবেই যাত্রা শুরু করলাম। প্রথম দিকে আবহাওয়া যতটা ভালো ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা ততোধিক খারাপ হতে শুরু করল। কখনও চড়াই-উতরাইয়ের পাথুরে পথ তো কখনও মাইলের পর মাইল বুগিয়াল আবার কখনও ঘন জঙ্গল। এই আমাদের আজকের ট্রেল। প্রায় সতেরো কিলোমিটার ট্রেকের বেশিরভাগ সময়ই আমাদের বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে হয়েছে।
রূপকুণ্ড উঠতেও এতটা কষ্ট হয়নি আজ যেটা হলো। বিকালে যখন আমরা কানোল পৌঁছলাম, তখন শুধু আমরা তিনজন নই, আমাদের গাইড ভবন এবং তার দুই সাগরেদ সবার অবস্থাই অত্যন্ত করুণ। কানোলে ইকো-ট্যুরিজমের একটা ছোট্ট রিসোর্ট আছে। যদিও সেটা দেখে আমার সরকারি প্রাথমিক স্কুল বলেই মনে হলো। যাই হোক সেখানেই আমরা সেদিনের মতো আমাদের টেন্ট ফেললাম। সন্ধে হতেই ছোট্ট করে একটা ক্যাম্প ফায়ার করা হলো। সঙ্গে পুষ্করের বানানো হরেক রকম অনুসারী খাবার আর বুড়ো সাধুর তপস্যা। সকালে উঠে কানোলের সৌন্দর্যটা প্রকৃতভাবে অনুভব করলাম। পুরো গ্রামটাই জঙ্গলে ঘেরা। একটা নদীও বয়ে গেছে গ্রামের মধ্যভাগ দিয়ে। এককথায় দারুণ সুন্দর জায়গাটা।