× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

স্বপ্নবাজ চার তরুণের মেঘের দেশের পাঠশালা

আসমাউল হুসনা

প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:০৪ পিএম

আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:২০ পিএম

ওয়াংনিম কিয়াং বিদ্যালয়ের চার প্রতিষ্ঠাতা

ওয়াংনিম কিয়াং বিদ্যালয়ের চার প্রতিষ্ঠাতা

চিম্বুকের ওপাশ থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। সোনালি রোদের আলোয় ঝলমল করছে আদুইপাড়ার সকাল। ম্রো গ্রামটি ঘিরে রাখা ধোঁয়াটে মেঘেরা ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছে। পাহাড়, মেঘ, অরণ্যের শব্দগুচ্ছ সব মিলিয়ে আশ্চর্য রকম স্নিগ্ধ পরিবেশ, কল্পলোককে হার মানানো এক সকাল। এখানে রয়েছে একটি বিদ্যাপীঠ। চার তরুণের স্বপ্নের এ পাঠশালার নাম ওয়াংনিম কিয়াং 

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য জেলা বান্দরবান। বান্দরবানের অন্যতম একটি উপজেলা আলীকদম। যেখানে পাহাড়ের বুক চিরে সূর্য জেগে উঠলেও নেই খুব একটা শিক্ষার আলো। মাতামুহুরী উপত্যকায় বসবাসকারী ম্রো সম্প্রদায় পিছিয়ে আছে জীবনের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে। এখানে রয়েছে একটি মাত্র সরকারি বিদ্যালয় যেখানে যাতায়াত করতে লেগে যায় অনেকটা সময়। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় পুরো পথটাই যেতে হয় হেঁটে। ম্রো শিশুরা সেখানে যেতে অনেকটাই অপারগ।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুম চাষ করেই ম্রোরা জীবন অতিবাহিত করছে। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ভুলতে বসেছে এ দুর্গম অঞ্চলের মানুষ। ম্রো শিশুদের মৌলিক অধিকার অর্জন ও তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পাহাড়প্রেমী চার যুবক দীর্ঘ এক বছরের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা করেন ওয়াংনিম কিয়াং নামে একটি বিদ্যালয়। স্বপ্নবাজ এই চার তরুণ হলেন সিফাত আমিন আদিল, তানভীর সাইতা, মহিউদ্দিন আল মুহিত, পেয়ারে আলম। ম্রো ভাষায় দেওয়া এ নামের অর্থ মেঘের দেশের পাঠশালা। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শিক্ষার্থীদের হাতে বই ও শিক্ষাসামগ্রী তুলে দেওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে ওয়াংনিম কিয়াং। ৪ নম্বর কুরুকপাতা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আদুইপাড়ায় বাঁশ ও ছন দিয়ে তৈরি বিদ্যালয়টি।

স্কুলড্রেস পরিধান করে একে একে বাচ্চারা স্কুলপ্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হচ্ছে। পাঠদান শুরু হতে এখনও দেরি। তাই কেউ কেউ ব্যস্ত খেলাধুলায়, কেউ পানি দিচ্ছে স্কুলপ্রাঙ্গণের ফুলগাছের গোড়ায়, কেউ আবার ঝিড়ি থেকে খাবার পানি এনে জমা করছে ক্লাসরুমে। কয়েকজন অফিসঘর থেকে বের করে উত্তোলন করল দেশের পতাকা। দুর্গম পাহাড়ে দখিনা বাতাসে উড়ছে লাল সবুজের বাংলাদেশ। শিক্ষক এলেন। ছাত্রছাত্রীরা সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। শুরু হলো অ্যাসেম্বলি। শারীরিক চর্চার পর জাতীয় পতাকার প্রতি সালাম প্রদর্শন করল সবাই। সমস্বরে গেয়ে উঠল জাতীয় সংগীতÑ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

বিদ্যালয়টিতে বিনামূল্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়

তারপর শুরু হলো বিদ্যালয়ের প্রাত্যহিক কার্যকলাপ। শিক্ষকের পাঠদান, শিক্ষার্থীদের পুনরাবৃত্তি, বন্ধুর সঙ্গে খুনসুটি, শিক্ষকের শাসন। এভাবেই চলতে থাকে দুপুর পর্যন্ত। খাবারের বিরতির পর আবার ক্লাস। দুই বছর আগে এসব বাচ্চা ভরদুপুরে থাকত ঘুমে কিংবা মা-বাবার সঙ্গে জুমে। আজকের চিত্র একেবারে ভিন্ন। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে তারা আজ শিখছে, এগিয়ে যাচ্ছে এক সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ওয়াংনিম কিয়াংয়ে বাচ্চারা ছবি আঁকে, গান গায়। নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করে। ওয়াংনিম কিয়াং বিশ্বাস করে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পাওয়া প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার। তাই এখানে শিক্ষার মাধ্যম ম্রো ভাষা। স্কুল ছুটি হয়। মিরিঞ্জার ওপাশে সূর্যটা ডুবে যায় আজকের মতো। রাত গড়িয়ে দিন হয়। আবারও শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে স্কুলপ্রাঙ্গণ। এভাবেই চলে আসছে দুটি বছর।

দুর্গম পাহাড়ে টিউশন ফি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। মনুষ্য নানা প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা। বিদ্যালয়টির সভাপতির দায়িত্বে আছেন মেনওয়ই ম্রো, সহসভাপতি তনশুওয়া ম্রো, সাধারণ সম্পাদক থংপ্রে ম্রো, সহসাধারণ সম্পাদক কুডং ম্রো, সদস্য পদে আছেন ইংরি ম্রো, মেনলিউ ম্রো এবং রেংফক্রি ম্রো আছেন ক্যাশিয়ার ও সহক্যাশিয়ারের দায়িত্বে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন মাং ওয়াই ম্রো।

বিদ্যালয়টির অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আল মুহিত বলেন, ‘পাহাড়ের প্রতি ভালোবাসা ও অনেকটা সময় ম্রোদের সঙ্গে চলাফেরা থেকেই পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা তৈরি হয়। নামমাত্র শিক্ষা প্রদান শুধু নয়, ম্রোদের নিজস্ব মাতৃভাষা শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা দান করা ওয়াংনিম কিয়াংয়ের মূল উদ্দেশ্য। আমরা চাই বর্তমান ম্রো শিশুদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়ে একটি শিক্ষিত ও আত্মনির্ভর ম্রো প্রজন্ম গড়ে তুলতে। পড়াশোনার পাশাপাশি লাইব্রেরি, সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলারও ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। আর আমাদের এ প্রচেষ্টায় আমরা পাশে পেয়েছি পাহাড়প্রেমী মানুষদের। যারা মন থেকে চান পাহাড়ের শিশুরা শিক্ষার আলোয় এগিয়ে যাক অনেক দূর।’

বিদ্যালয়টির নতুন ঘর

স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা চার তরুণের একজন সিফাত আমিন আদিল তাদের স্বপ্নের স্কুল নিয়ে বলেন, ‘পাহাড়ে শিক্ষার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ম্রো। পাহাড়ে স্কুল না থাকায় ম্রো শিশুরা বছরের পর বছর শিক্ষাবঞ্চিত। তাদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন অনেক দিনের। সে কাজ গতিময় করতেই আমি, মুহিত ভাই, তানভীর সাইতা ভাই ও পেয়ারে আলম ভাই মিলে এক বছরের প্রচেষ্টায় এবং স্থানীয়দের অক্লান্ত সহযোগিতায় তৈরি করেছি ওয়াংনিম কিয়াং। ম্রো ভাষা এবং প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যেই আমাদের পথচলা।’ প্রতিষ্ঠানটির আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা পেয়ারে আলম বলেন, ‘বর্তমানে চারজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের পাশাপাশি প্রায় ৩০ জন স্থায়ী সদস্য নিয়ে আমাদের ওয়াংনিম কিয়াং পরিবার। প্রতি মাসে চাঁদা তুলে চলছে স্কুল। বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে স্থানীয় ম্রো শিক্ষক। এ ছাড়া রয়েছে স্কুল পরিচালনা কমিটি।’

ওয়াংনিম কিয়াংয়ের আরেক প্রতিষ্ঠাতা তানভীর সাইতা বলেন, ‘বছরখানেক আগে শত উৎকণ্ঠা নিয়ে পাহাড়ে ম্রোদের জন্য একটা স্কুল করার পরিকল্পনা করেছিলাম। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সে স্কুল আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এ খুশি বলে বোঝানো সম্ভব না। স্বপ্নও ধীরে ধীরে ডালপালা ছড়াচ্ছে। একসময় এ ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়বে পাহাড় থেকে পাহাড়ে, পাড়া থেকে পাড়ায় এবং জীবন থেকে জীবনে।’

মহিউদ্দিন আল মুহিত বলেন, ‘বিদ্যালয়টির নতুন ঘর প্রায় প্রস্তুত করা হয়ে গেছে। অনেকেই আমাদের এ উদ্যোগে নিজেদের শামিল করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শুভাকাঙ্ক্ষী বোন ওয়াংনিম কিয়াংয়ের এক বছরের শিক্ষাসামগ্রী দিয়েছেন; যা সত্যিই বাচ্চাদের অনুপ্রাণিত করবে। এ রকম ছোট ছোট ভালোবাসা নিয়েই এগিয়ে চলবে মেঘদেশের পাঠশালা।’

শিক্ষার্থী রেংওয়ান ম্রোর বাবা খামলাই ম্রো বলেন, ‘আমরা পড়াশোনা করতে পারি নাই, তাই চাই ছেলেমেয়েরা যেন লেখাপড়া করতে পারে। আমার সন্তান রেংওয়ান ওয়াংনিমের নিয়মিত ছাত্র। সে এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। এটা খুবই আনন্দের বিষয়। কয়েক বছর আগেও যেখানে স্কুল ছিল না সেখানেই আজ বাচ্চারা লেখাপড়া করছে মনের আনন্দে। এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে?’

পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার অনুপ্রেরণা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ওয়াংনিম কিয়াং বিদ্যালয়টিতে বিনামূল্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিকে ১৫ ও প্রথম শ্রেণিতে ১৬- মোট ৩১ শিক্ষার্থী নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে ওয়াংনিম কিয়াং বিদ্যালয়। তৃতীয় শ্রেণির পাঠ শেষে আগ্রহী ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শহরে এনে উচ্চশিক্ষার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে ওয়াংনিম কিয়াং কর্তৃপক্ষ।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা