× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রেংমিটচ্য

একটি ভাষা যেভাবে প্রাণ ফিরে পেল

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা

প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৫৪ পিএম

আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৫৪ পিএম

রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষায় ইয়াংঙান ম্রো ও সিংরা ম্রোর সামাজিক আন্দোলনে শামিল হয়ে উৎসাহ জোগাচ্ছে ম্রো ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষ

রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষায় ইয়াংঙান ম্রো ও সিংরা ম্রোর সামাজিক আন্দোলনে শামিল হয়ে উৎসাহ জোগাচ্ছে ম্রো ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষ

বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার হারিয়ে যেতে বসা রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষায় এগিয়ে এসেছেন অনেকে। অনেকটা সামাজিক আন্দোলনের মতো মাতৃভাষাকে বাঁচাতে ম্রো জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন তরুণের হাত ধরে রেংমিটচ্য ভাষা শিখছে পরবর্তী প্রজন্ম...

 বাংলাদেশে ৪১টি ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধিকরণ প্রকল্প (ইবিএলআইসিটি) ভাষাগুলোর ডকুমেন্টেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চিহ্নিত ভাষাগুলো হলো : আবেং (গারো), আত্তং (গারো), মিগাম (গারো), কোচ (কোচ), লালেং (পাত্র), বম (বম), লুসাই (লুসাই), পাংখোয়া (পাংখোয়া), খিয়াং (খিয়াং), খুমি (খুমি), রেংমিটচ্য (ম্রো), ম্রো (ম্রো), ককবরক (ত্রিপুরা), উসুই (ত্রিপুরা), মারমা (মারমা), রাখাইন (রাখাইন), চাক (চাক), মৈতৈ (মণিপুরি), হাজং (হাজং), চাকমা (চাকমা), তঞ্চঙ্গ্যা (তঞ্চঙ্গ্যা), বিষ্ণুপ্রিয়া (মণিপুরি), অহমিয়া (অহমিয়া), নেপালি (গুর্খা), উড়িয়া (উড়িয়া), বিহারি (বিহারি), সাদরি (ওরাওঁ, মালো, পাহান, রাজোয়াড়, খারিয়া, বড়াইক, শিং, তুরি), সান্তালি (সাঁওতাল), মুন্ডারি (মুন্ডা), মাহলে (মাহালী), কোল (কোল), কোডা (কোডা), খাড়িয়া (খাড়িয়া), খাসিয়া (খাসিয়া), কুড়ুখ (ওরাওঁ), সৌরা (সৌরা), মাদ্রাজি (মাদ্রাজি), তেলুগু (তেলুগু), কুই (কন্দ), পাহাড়িয়া (পাহাড়িয়া) এবং থার (বেদে) এই ৪১ ভাষার মধ্যে প্রায় ১৪টি বিপন্নতার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে। তার মধ্যে রেংমিটচ্য ভাষা অন্যতম। ভাষাটি চীনা-তিব্বতি ভাষাপরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য। ১৯৬০-এর দশকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলার কয়েকটি পাড়ায় শতাধিক রেংমিটচ্যভাষী পরিবার ছিল বলে ক্লাউসডিয়েটার ব্রাউনস লোরেন্স জি লোফলার তাদের Mru : Hill People on the Border of Bangladesh নামে বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন (ব্রাউনস ১৯৯০, পৃ. ২৪৮) বইয়ের সূত্রমতে, তখন রেংমিটচ্যভাষীরা মূলত ছিল খুমি জনগোষ্ঠীর। যারা আরাকান থেকে এসে মাতামুহুরীর উজানে ম্রোদের সঙ্গে মিশে গেছে।

মাং পুন ম্রেংরো, কুনরাও ম্রো ও কুন রাও ম্রো- ক্রাংসি পাড়ায় এই তিনজন রেংমিটচ্য ভাষা জানেন

যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড পিটারসন ২০১৩ সালে ভাষার ভাষিক জনসংখ্যা পেয়েছিলেন ২২। পরে তার সহকারী ম্রো ভাষার লেখক-গবেষক ইয়াংঙান ম্রো বিভিন্ন ম্রোপাড়ায় আরও ১০ জন রেংমিটচ্যভাষীর সন্ধান পান। ডেভিড ভাষা অনুসন্ধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে দুবার আসতেন। বাকি দিনগুলোয় ইয়াংঙান ম্রো নিজ উদ্যোগে অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যেতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তিনি চাকরিতে না ঢুকে মনোনিবেশ করেন ভাষা গবেষণায়। তিনি লক্ষ করেন, প্রতি বছর কমতে কমতে ২০২১ সালে রেংমিটচ্যভাষীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১০ (সমকাল, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) এবং ২০২২ সালে (প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)

সাম্প্রতিক এক আলাপচারিতায় ইয়াংঙান ম্রো শোনালেন কিছু আশার কথা। তিনি জানান, দিন দিন রেংমিটচ্যভাষীর সংখ্যা আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রেংমিটচ্যভাষী পরিবারগুলোর যেসব সন্তান তাদের পূর্বসূরিদের ভাষা ভুলে গিয়েছিল, তারা আগ্রহের সঙ্গে সে ভাষা শেখার দিকে ঝুঁকছে। যে ছয়জন প্রায় ষাটোর্ধ্ব রেংমিটচ্যভাষী এখনও বেঁচে আছেন, তাদের মধ্যে মাংপুন ম্রো অন্যতম, যার বয়স এখন ৭৭ বছর। তার ছেলে সিংরা ম্রো রেংমিটচ্য ভাষা জানতেন না। নিজের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে দেখে সিংরা ম্রো ভাষাটি শিখতে শুরু করেন। তার বাবার কাছ থেকেই তিনি রেংমিটচ্য রপ্ত করে ভাষায় শোনা, বলা, পড়া লেখার দক্ষতা অর্জন করেন। ইয়াংঙান ম্রোর তথ্যমতে, বর্তমানে রেংমিটচ্যভাষীর সংখ্যা - উন্নীত হয়েছে।

ইতোমধ্যে আর্থিক টানাপড়েন মোকাবিলা করে ইয়াংঙান ম্রো ১০ বছর গবেষণা করে প্রকাশ করেন রেংমিটচ্য ভাষার অভিধানমিটচ্য তখক কোনো প্রকাশক না পাওয়ায় নিজ খরচেই মাত্র দেড়শ কপি অভিধান বের করেন তিনি স্থানীয় প্রেস থেকে। যে ছয়জন রেংমিটচ্যভাষী এখনও বেঁচে রয়েছেন, তারা হলেন ৬৯ বছর বয়সি নারী কুনরাও, ৭৭ বছরের মাংপুন, ৪৫ বছরের সিংরা, ৫৮ বছরের থোয়াইংলক, ৭২ বছরের রেংপুন ৬০ বছরের মাংওয়াই। তিনি তার অভিধানে দুজন নারী চারজন পুরুষ রেংমিটচ্যভাষীর ছবি ব্যবহার করেছেন। অভিধানটিতে বাংলা শব্দার্থসহ হাজার ৪০০ শব্দ সন্নিবেশ করা হয়েছে। ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষি, খাবার, ফলমূলসহ দৈনন্দিন জীবনে রেংমটিচ্যভাষীদের ব্যবহৃত শব্দগুলো গ্রন্থিত হয়েছে। অভিধানের একটি অংশে আলাপচারিতামূলক বাক্য বা কথোপথন উপস্থাপন করা হয়েছে। তার অভিধান ব্যবহার করে ৪৫ বছরের সিংরা এখন শিশুকিশোরদের রেংমিটচ্য ভাষা শেখাচ্ছেন। গত বছরের ডিসেম্বর শুরু হওয়া রেংমিটচ্য ভাষা ক্লাসে প্রথমে ২২ জন রেংমিটচ্যভাষী পরিবারের শিশু ভর্তি হয়েছিল। এখন আরও অনেক আগ্রহী শিক্ষার্থী সে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। পর্যন্ত প্রায় ৩৫ জন শিক্ষার্থী রেংমিটচ্য স্কুলে ভর্তি হয়েছে। কেবল শিশুকিশোর নয়, বয়স্করাও এখন তাদের পূর্বসূরিদের ভাষা শেখার জন্য এগিয়ে আসছেন। বিলুপ্তপ্রায় মাতৃভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা শুরু করেছেন একটি সামাজিক আন্দোলন। রেংমিটচ্যভাষী পরিবারের সদস্য ছাড়াও স্কুলে ম্রো শিশুকিশোর-বয়স্করাও এখন রেংমিটচ্য ভাষা শিখছেন।

রেংমিটচ্যভাষী মাংপুন ম্রো পরিবারের সদস্যরা। 

ইয়াংঙান ম্রো সিংরা ম্রোর সামাজিক আন্দোলনে শামিল হয়েছেন এবং উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন ম্রো অন্যান্য জনগোষ্ঠীর অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি সামাজিক নেতৃবৃন্দ। ইয়াংঙান ম্রোমিটচ্য তখক রিক সাংনামে আরেকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছেন। এটি রেংমিটচ্য ভাষার প্রাথমিক শিক্ষার বই। কিছু কথোকপথনও আছে বইটিতে। সবার সুবিধার্থে বইটিতে ম্রো বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়েছে।

রেংমিটচ্য ভাষা বিপন্নতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারিভাবে যেমন নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তেমন বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশেষায়িত সংস্থা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থারও এগিয়ে আসা উচিত। সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে রেংমিটচ্য ভাষার ওপর গবেষণা আলোচনা, অভিধানসহ বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ, একাডেমিক গবেষণার জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানসহ কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো রেংমিটচ্য ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনা, বই প্রকাশ, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, রেংমিটচ্যভাষীর জন্য উৎসাহমূলক বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন, তাদের সংগঠিত হওয়ার জন্য সহায়তামূলক কর্মসূচি ইত্যাদি পরিচালনা করতে পারে।

রেংমিটচ্য ভাষা পুনরুজ্জীবন, উন্নয়ন সংরক্ষণে সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব রয়েছে ম্রো জাতিগোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক, শিক্ষক, সামাজিক প্রথাগত নেতৃবৃন্দের। কারণ ভাষাটি অন্য একটি ভাষাপরিবেশ থেকে এসে তাদের সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। ভাষাটি যদি পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়, তাহলে তা ম্রো জনগোষ্ঠীর ভাষিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করবে। রেংমিটচ্য ভাষা টিকে থাকলে তা কেবল ম্রো জনগোষ্ঠী কিংবা রিংমিটচ্যভাষী মানুষের উপকারেই আসবে না, ভাষার বিপন্নতা কিংবা পুনরুজ্জীবনের ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের সামগ্রিক ভাষিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। কারণ একটি ভাষা সে ভাষার ভৌগোলিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সমৃদ্ধ করার জন্য রত্নসম্পদের মতোই ভূমিকা পালন করে। একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানেই সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য পরিহিত অলংকারাজি থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অলংকার খসে পড়ার মতোই আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সৌন্দর্য ম্লান করে দেয়।

  • লেখক : গবেষক এবং নির্বাহী পরিচালক, জাবারাং কল্যাণ সমিতি
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা