হাসনাত মোবারক
প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৪২ পিএম
আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:১৪ পিএম
‘আমি
চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে
রাষ্ট্রপুঞ্জে, আমি চাই মহুল
ফুটবে শৌখিনতার গোলাপ কুঞ্জে।’ কবীর সুমনের এ
গানের সুরে অনেকেই কণ্ঠ
মেলায়। কিন্তু বাস্তবতার সুর ভিন্ন। আমাদের
এ ভূখণ্ডে বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষার বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালেই তা
অনুধাবন করা যায়। বাংলাদেশে
বাংলা ছাড়াও যেসব ভাষাভাষীর মানুষ
রয়েছে তাদের ভাষা এখন অনেকটাই
বিলুপ্তির পথে। ক্রমে হারিয়ে
যাওয়া জাতিগোষ্ঠীর মুখে মুখে ফেরা
রূপকথার গল্প নিয়ে কাজ
করছেন মিজানুর রহমান সৈকত। তার সম্পাদনা ও
বাংলায় অনুলিখনে এবার বইমেলায় চার
সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে চারটি বই।
বাংলা
বর্ণমালার ভিড়ে এতটুকু জায়গা
পাওয়া এ জাতিসত্তাসমূহের ভাষায়
প্রকাশিত বই নিয়ে কথা
হয় মিজানুর রহমান সৈকতের সঙ্গে। ম্রো, চাকমা, মারমা ও সাঁওতালি ভাষার
রূপকথার গল্প নিয়ে বই
প্রকাশের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য।
এ প্রসঙ্গে তার কাছে জানতে
চাইলে বলেন, ‘আমাদের দেশে বাংলা ছাড়াও
অনেক ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। তারা নিজের মাতৃভাষার
হরফে লেখা কোনো বই
পড়ার সুযোগ পায় না। কারণ
তাদের ভাষায় খুব একটা বই
প্রকাশ হয় না। তাই
আমরা তাদের মাতৃভাষার হরফে লেখা বই
ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা দিতে এ উদ্যোগ
নিয়েছি।’ সৈকত আরও বলেন,
‘প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মুখে মুখে ফেরা
এমন শত রূপকথার গল্প
যুগ যুগ ধরে ঘুরছে
ফিরছে। আমরা এ রূপকথাগুলো
বই প্রকাশের মাধ্যমে সংরক্ষণের চেষ্টা করেছি মাত্র।’
বাংলা
ভাষায় সৈকতের অনুলিখনে এ বইগুলোর ভেতরের
পৃষ্ঠা ওল্টাতেই অমূল্য রত্ন চোখে পড়ে।
কোথায় লুকিয়ে ছিল এত দিন!
যদি বইগুলোয় তাদের ভাষার পাশাপাশি বাংলায় লেখা না থাকত;
আমরাও বঞ্চিত হতাম এ সাহিত্যকর্ম
থেকে।
ম্রো
২২, চাকমা ২১, মারমা ২৪
ও সাঁওতালি ভাষার ১৬টি রূপকথার চারটি
বই বাংলা ভাষার পাঠকের জন্যও বাড়তি পাওনা। প্রকাশিত এ গ্রন্থ চারটি
উল্টিয়ে দেখি প্রকাশনা সংস্থা
বিদ্যানন্দর নাম। ম্রো, মারমা,
চাকমা এ তিনটি ভাষার
রূপকথাগুলো পার্বত্য অঞ্চলে তাদের পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ
করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা মা-বাবার মুখ থেকে এগুলো
শুনেছে। আর সাঁওতালি ভাষার
রূপকথা বইয়ের গল্পগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে রাজশাহী
অঞ্চলের সাঁওতালি জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে।
এ বই চারটির গল্প
সংগ্রহ, অনুলিখন, অনুবাদে সব মিলিয়ে তিন
মাসের মতো লেগেছে তাদের।
সৈকত জানান, বিদ্যানন্দ অনাথ আশ্রমের শিক্ষকরাই
মূলত এ কাজের মূল
কৃতিত্ব পাওয়ার যোগ্য। শিক্ষকসহ প্রায় ৩০ জন এ
কাজের সঙ্গে যুক্ত। তিনি চাকমা ভাষার
বইটি হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা
উল্টিয়ে দেখালেন রিতা চাকমার মুখ
থেকে শোনা ‘লাল সুতো ও
বোকা লোক’ গল্পটি। এ
গল্পকথক ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
এ কথকদের মুখ থেকে গল্পগুলো
শোনার পর প্রথমে বাংলায়
লেখা হয়েছে। এরপর চাকমা, মারমা,
ম্রো সাঁওতালি ভাষা জানা এমন
কয়েকজনকে দিয়ে সে ভাষায়
রূপান্তর করা হয়েছে।
শ্রমসাধ্য
এ কাজে সাঁওতালি ভাষার
রূপকথার গল্পগুলো সংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন ইজ্রায়েল মার্ডি, ইমন হেম্ব্রম, রিপন
মার্ডি। তারা রাজশাহী অঞ্চলের
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে শুনে
সৈকতকে দিয়েছেন।
নিজের
মাতৃভাষায় লেখা বই দেখে
অনেকটাই আপ্লুত বান্দরবানের রুমা উপজেলার লেংচাপাড়ার
মেনসিং ম্রো। তার সঙ্গে এ
বই প্রসঙ্গে কথা হলে বলেন,
‘ছোট থেকে আমরা মায়ের
ভাষায় কথা বললেও কখনও
সে ভাষায় বই পড়ার সুযোগ
পাইনি। এখন নিজের বর্ণমালায়
বই প্রকাশ হতে দেখে যে
অনুভূতি হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ
করার মতো না। এমন
বই আরও হোক।’ ভবিষ্যৎ
পরিকল্পনা জানতে চাইলে সৈকত বলেন, ‘অনেক
সংখ্যালঘু জাতিসত্তা রয়েছে যাদের নিজস্ব বর্ণমালা আছে, কিন্তু তাদের
ভাষায় তেমন কোনো বই
নেই। তাদের ভাষা নিয়েও কাজ
করব।’