এস এ এইচ ওয়ালিউল্লাহ
প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:২৯ পিএম
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জারি করা তামার একপাই
সংস্কৃতের
‘টঙ্ক’ শব্দটি অনেক যুগ আগে
মুদ্রা অর্থে বাংলার মানুষের কাছে হয়ে গেছে
টাকা। বাংলা ভূখণ্ডে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ অথবা পঞ্চম শতাব্দী
থেকেই মুদ্রার প্রচলন থাকলেও সেসব মুদ্রা এ
দেশে রাজত্বকারী কোনো স্বদেশি রাজা
জারিকৃত ছিল না। সেগুলো
ছিল হয়তো ভারতীয় মুদ্রা অথবা ভারতীয় মুদ্রার
আদলে অনুকৃত মুদ্রা। সেসব মুদ্রায় ছিল
না কোনো লিপি বা
বর্ণ। লিপি বা বর্ণের
পরিবর্তে সেসব মুদ্রায় গাছ,
সূর্য, মাছ, পাহাড়, চন্দ্র,
তিরের ফলা, নদী, খরগোশ,
হাতি, ষাঁড়সহ বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতির ছাপ থাকত। এসব
চিহ্ন দেখে মানুষ বুঝতে
পারত মুদ্রাগুলো কোন অঞ্চলে ব্যবহৃত
হয়।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের শেষ দিকে দেশজ রাজাদের মধ্যে প্রথম সমতটের (বর্তমান কুমিল্লা) রাজা বলভট্ট নিজ নামে সোনার মুদ্রা জারি করেন। মুদ্রাটির মুখ্য দিকে ব্রাহ্মী ভাষার লিপিভাষ্য ‘শ্রী বল(ভট্ট)’ রয়েছে। এখান থেকেই (সম্ভবত) শুরু হয় বাংলা ভূমে জারি করা নিজস্ব এবং লিপিযুক্ত মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাস। আরও পরে খ্রিস্টীয় তেরো শতকের শুরুতে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির গৌড় বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় সুলতানি শাসনের সূত্রপাত ঘটে। নিজ নামে মুদ্রা জারি সার্বভৌমত্বের বিশেষ অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলার সুলতানরা ক্ষমতাগ্রহণ, স্বাধীনতা ঘোষণা এবং কখনও কখনও যুদ্ধবিজয় স্মরণীয় করে রাখতে স্ব-স্ব নামে মুদ্রার প্রচলন করেন। কিন্তু বাংলার নিজস্ব সেসব মুদ্রায়ও তখনও ঠাঁই পায়নি বাংলা লিপিভাষ্য।
১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে আসাম রাজ্যের বাংলা লিপি যুক্ত রৌপ্যমুদ্রা
আবিষ্কৃত
মুদ্রার আলোকে বাংলা লিপিতে প্রথম মুদ্রা জারি করার কৃতিত্ব
রাজা দনুজমর্দন দেবের। এ দনুজমর্দন সম্পর্কে
ইতিহাসবিদরা দুই ভাগে বিভক্ত।
একদল দাবি করেন, দনুজমর্দন
দেব হচ্ছেন বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সভাসদ।
পরে চক্রান্ত করে নিজেই বাংলার
সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং দনুজমর্দন
নাম ধারণ করে মুদ্রা
জারি করেন। আরেক পক্ষ দাবি
করেন, দনুজমর্দন হচ্ছেন চন্দ্রদ্বীপের (বর্তমান বরিশাল) রাজা। তবে দনুজমর্দন দেব
যিনিই হোন না কেন,
১৩৩৯ শকাব্দে (১৪১৭ খ্রি) জারি
করা মুদ্রার মাধ্যমে বাংলা লিপিতে মুদ্রাতাত্ত্বিক ইতিহাসের সূচনা প্রথম তিনিই করেন। চট্টগ্রাম টাঁকশাল থেকে জারি করা
মুদ্রাটির মুখ্য দিকে রয়েছে ‘শ্রী
শ্রী দনুজমর্দন দেব’ এবং গৌণ
পিঠে রয়েছে ‘শ্রী চণ্ডীচরণ পরায়ণ’
বাংলা লিপিভাষ্য। ১৩৪০ শকাব্দে (১৪১৮
খ্রি) জারি করা আরেকজন
রাজা মহেন্দ্র দেবের মুদ্রাও বাংলা লিপিভাষ্যেই উৎকীর্ণ। মহেন্দ্র দেবের মুদ্রার এক পিঠে রয়েছে
‘শ্রী শ্রী মহেন্দ্র দেব’
এবং অন্য পিঠে ‘শ্রী
চণ্ডীচরণ পরায়ণ’ লিপিভাষ্য, টাঁকশালের নাম এবং মুদ্রা
জারির বছর। এর কয়েক
যুগ পরই ১৩৮৬ শকাব্দ
মোতাবেক ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার
রাজা রত্ন মাণিক্য সর্বপ্রথম
ত্রিপুরা রাজ্যে মুদ্রা চালু করেন। এ
মুদ্রা ছিল বাংলা লিপিতে
উৎকীর্ণ। মুদ্রাটির সামনের পিঠে মাঝখানে অঙ্কিত
সিংহের প্রতিকৃতি এবং সিংহের চারপাশে
‘শ্রী নারায়ণ চরণ পর রত্নপুরেন
১৩৮৬’ লিপিভাষ্য এবং পেছনের পিঠে
‘শ্রী শ্রী নারায়ণ চরণ
পর শ্রী শ্রী রত্ন
মাণিক্য দেব’ লিপিভাষ্য বিদ্যমান।
১৫৫৫
খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্যের রাজা নর নারায়ণের
হাত ধরে শুরু হয়
বাংলা লিপিতে নারায়ণী মুদ্রার প্রচলন। এ মুদ্রার সামনের
দিকে রয়েছে পাঁচ লাইনের লিপিভাষ্য
‘শ্রী শ্রীমান নর নারায়ণ ভূপালস্য
শাকে-১৪৭৭’। আর
মুদ্রাটির পেছনের দিকে চার লাইনে
‘শ্রী শ্রী শিবচরণ কমল
মধু করস্য’ লেখা রয়েছে। এ
রাজ্যের সব রাজার নামের
শেষে ‘নারায়ণ’ উল্লেখ থাকার কারণে তাদের মুদ্রা নারায়ণী মুদ্রা নামে পরিচিতি লাভ
করে। এরপর রাজা জয়ধ্বজ
সিংহ ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে অহম
(আসাম) রাজ্যের মুদ্রাও বাংলা লিপিতেই উৎকীর্ণ শুরু করেন। অষ্টকোণাকৃতির
সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের এ
মুদ্রা ছিল অহমের প্রথম
মুদ্রা। ভাষা অসমীয়া হলেও
বর্ণগুলো ছিল বাংলা।
রাজা মহেন্দ্র দেব কর্তৃক জারীকৃত বাংলা লিপির রৌপ্যমুদ্রা
সর্বসাধারণের ব্যবহারোপযোগী মুদ্রায় প্রথম বাংলা ভাষা ব্যবহার করে
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
সতেরো শতকের শেষের দিকে কোম্পানি বেঙ্গল
প্রেসিডেন্সির জন্য মুঘল বাদশাহ
দ্বিতীয় শাহ আলমের নামে
মুদ্রা তৈরি করে। এ
সময় তারা এক পয়সা
এবং আধা পয়সা মূল্যমানের
তামার মুদ্রা বাজারে ছাড়ে। এ মুদ্রা দুটির
এক পাশে গুজরাটি এবং
ফারসি ভাষার পাশাপাশি বাংলায় লেখা হয় ‘এক
পাই সিককা’ এবং ‘আদ পাই
সিককা’। পরে (১৮৩১-৩৫ খ্রি) বাংলায়
‘এক পাই’ এবং ‘অ
র্ধ্ব আ না’ লেখা
ক্ষুদ্রাকৃতির আরও দুটি মুদ্রা
বাজারে ছাড়ে কোম্পানি। মুদ্রা
দুটিতে কোনো সাল উল্লেখ
নেই, নেই শাসকের নাম।
শুধু চার ভাষায় (বাংলা,
ইংরেজি, উর্দু ও দেবনাগরী) মুদ্রার
মূল্যমান উল্লেখ রয়েছে।
১৮৫৮
খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিপ্লবের কারণে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে রানী ভিক্টোরিয়া ভারত
শাসনের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় ধাতব
মুদ্রায় নতুন করে বাংলা
মুদ্রণ বন্ধ হয়ে যায়।
তবে কাগজি নোটগুলোয় মূল্যমান লেখার ক্ষেত্রে অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলার উপস্থিতি দৃশ্যমান ছিল। ১৯০৬ সালে
রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের আমলে মুদ্রায় বাংলা
লিপিভাষ্যে মুদ্রার মূল্যমান উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে
আবারও ধাতব মুদ্রায় ফেরত
আসে বাংলা ভাষা। বাংলায় মুদ্রা প্রচলনের ধারা দেশভাগের আগ
পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
দেশভাগের পর প্রাথমিক অবস্থায় পাকিস্তান ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র মাধ্যমে ভারতীয় কাগজি মুদ্রায় উর্দুতে ‘হুকুমাত ই পাকিস্তান’ এবং ইংরেজিতে Government of Pakistan শব্দগুলো ওভার প্রিন্ট করে স্বাধীন পাকিস্তানের মুদ্রাতাত্ত্বিক ইতিহাসের সূচনা করে। এ মুদ্রাগুলোয় বাংলাসহ মোট সাতটি ভাষায় মুদ্রার মূল্যমান উল্লেখ ছিল। কিন্তু ১৯৪৮ সালে হঠাৎই পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে বসে ‘স্রেফ উর্দু’ই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এমন সিদ্ধান্তের জন্য মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সমমর্যাদার দাবিতে দ্রোহে ফেটে পড়ে বাঙালি জাতি। অবশেষে ১৯৫২ সালে বাঙালির রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষার অধিকার। এরপর ১৯৫৩ সালে বাধ্য হয়ে ধাতব মুদ্রায় বাংলার ব্যবহার শুরু করে পাকিস্তান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর পরে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান বাংলা লিপিতে মুদ্রা জারি করে গেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে বাংলা ভাষায় নিজস্ব মুদ্রা ‘টাকা’ অবমুক্ত করে সার্বভৌমত্বের নিদর্শন বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রায় স্থায়ীভাবে স্থান পায় বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলা।