গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:১৩ এএম
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৪০ পিএম
বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত যশোর জেলার গদখালী
শীতের হিমকে আনুষ্ঠানিক বিদায় দিয়ে ভালোবাসার দিনে চলে আসবে ফাল্গুনী সমীরণ; পাতাঝরা পলাশ আর শিমুলের ডালে ডালে যে রঙ লেগেছে, তারই উৎসব চলছে ভ্রমণপ্রেমীদের মনে। বসন্ত সমীরণে নিজেকে রাঙাতে আজ থাকছে এ সময়ে দেশের সেরা ৫ ভ্রমণ গন্তব্যের কথা। লিখেছেন গোলাম কিবরিয়া
ফুলের রাজধানী গদখালী
ফুলের
প্রতি মানুষের আকর্ষণ ও ভালোবাসা চিরন্তন।
তাই আপনি চাইলে ঘুরে
আসতে পারেন বাংলাদেশের মধ্যে এক টুকরো ফুলের
রাজ্য গদখালী থেকে। বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত যশোর জেলার গদখালী
বাজার। গদখালীতে আসা ফুলগুলো যশোর
থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে
ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার
৯০টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার বিঘা
জমিতে চাষ করা হয়।
ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার
গ্রামগুলোর রাস্তার দুই পাশে দিগন্ত
বিস্তৃত জমিতে লাল, নীল, হলুদ,
বেগুনি আর সাদা রঙের
ফুলের সমাহার দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো
তাকিয়ে থাকতে হয়। এ ছাড়া
ফুলের সুঘ্রাণ, মৌমাছির গুঞ্জন, আর রঙিন প্রজাপতির
ডানায় ভর করে এখানে
আসে চিরন্তন সুন্দরের বার্তা।
যশোর-বেনাপোল রোড ছেড়ে ডানে,
বায়ের গ্রামগুলোয় ঢুকে কিছু দূর
এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে দিগন্তজোড়া
ফুলের মাঠ। রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস,
গোলাপ আর গাঁদা ফুল
চাষ হয় এসব গ্রামে।
ফুল কেটে গরুর গাড়িতে
করে বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে থেকে বান্ডিল করে
চালান হয়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ
দেশের বিভিন্ন শহরে। মূলত ডিসেম্বর, জানুয়ারি
এবং ফেব্রুয়ারি মাসে গদখালীতে দর্শনার্থীদের
বিপুল ভিড় জমে ওঠে।
এই বৃহত্তম ফুলের রাজ্যে গেলে আপনার মন
আরও প্রাণময় হয়ে উঠবে, তা
নিশ্চিত বলা যায়।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যশোর যাওয়া যায়। যশোর বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে চলে যান লোকাল বাসস্ট্যান্ডে। এখান থেকেই পেয়ে যাবেন গদখালী যাওয়ার বাস। গদখালী নেমে ক্ষেত দেখার জন্য ভ্যান নিয়ে নিতে পারেন। ভ্যান ভাড়া নেবে ১০০-১৫০ টাকা। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার দুপাশে চোখে পড়বে ফুলের ক্ষেত। বাসস্ট্যান্ডের রাস্তার পাশেই সকালে বসে দেশের সর্ববৃহৎ ফুলের পাইকারি বাজার। এ ছাড়াও ঢাকা স্টেশন থেকে সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ছেড়ে যায়। থাকার জন্য যশোর শহরকেই বেছে নিতে হবে।
মেঘের রাজ্য সাজেক
পাহাড়ের
প্রতি ভালোবাসা আর এর সৌন্দর্য
উপভোগ করতে চাইলে যে
কয়টা নাম মাথায় আসে,
এর মধ্যে নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম বেছে নেওয়া যায়
সাজেক ভ্যালিকে। এই বসন্তে ভ্রমণ
তালিকায় রাখতে পারেন সাজেক। চাঁদ থেকে চাঁদের
গাড়ি, মেঘ থেকে মেঘের
চাদরÑ এ দুটোরই দেখা
মিলবে মেঘের রাজ্যখ্যাত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন সাজেক ভ্যালিতে। আঁকাবাঁকা পথ আর এলোমেলো
পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে
যাওয়া সুবিন্যস্ত পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন
যে সাজেক ভ্যালিতে পৌঁছে যাবেন, টেরও পাওয়া যাবে
না। সাদা মেঘের চাদরে
ঢেকে থাকা দৃশ্যের দিকে
চোখ বোলালে মনে হবে এ
যেন অন্য এক পৃথিবী,
যা শহরের যান্ত্রিক কোলাহল এবং দূষণ থেকে
কয়েক শতগুণ মুক্ত। উৎসুক মনকে কি প্রশ্ন
করা যায় মেঘেদের ওপর
পা দুলিয়ে ঝুলতে কেমন অনুভূত হবে?
হ্যাঁ, এরও সমাধান রয়েছে
সাজেকে। সুযোগ রয়েছে মেঘের ওপর দোলনায় বসে
পা দোলানোর সুযোগ। মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে
যাওয়া পাখিদের দেখে নিজেকে মনে
হবে মুক্তবিহঙ্গ। সাজেকের পথ ধরে হাঁটলে
মনে হবে গ্রামের মেঠোপথ
ধরে হাঁটছি, যে পথ পিচঢালা।
এই পথ ধরে ৪৫
মিনিটের দূরত্বে রয়েছে সিপ্পু পাহাড়ে অবস্থিত কংলাকপাড়া। সিপ্পু পাহাড়, যেটি শুধু সাজেকেরই
নয়, পুরো রাঙামাটি জেলার
সর্বোচ্চ পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার
৮০০ ফুট উঁচু। ছোট
এই পাহাড়টিতে বসবাস করে ‘পাংখো’ আদিবাসীরা।
সাজেক
যেভাবে
যাবেন : দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রথমে আপনাকে
খাগড়াছড়ি আসতে হবে। ঢাকা
থেকে শান্তি পরিবহনে ভ্রমণ করতে পারবেন। এ
ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে প্রতি এক
ঘণ্টা পরপর শান্তি পরিবহনের
গাড়ি ছাড়ে। তা ছাড়া চট্টগ্রামের
লোকাল বাসেও যাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি অথবা
দীঘিনালা থেকে ভাড়ায় চাঁদের
গাড়ি, ৩ হাজার ৫০০
থেকে ৬ হাজার টাকা,
সিএনজি ৩ হাজার থেকে
সাড়ে ৩ হাজার টাকা
অথবা মোটরবাইক ১ হাজার থেকে
১ হাজার ২০০ রিজার্ভ করে
আর্মি স্কটের সঙ্গে সময় মিলিয়ে চলে
যেতে হবে খাগড়াছড়ি থেকে
৮৫ কিলোমিটার দূরের অপূর্ব আর অনিন্দ্যসুন্দর সাজেক
ভ্যালিতে। সাজেক যাওয়ার পথে বাঘাইহাট জোনে
আপনার নাম, ঠিকানা এবং
মোবাইল নম্বর এট্রি করতে হবে।
সুরভিত ‘ গোলাপ গ্রাম’
সাদুল্লাহপুরকে এখন পর্যটকরা ‘গোলাপ গ্রাম’ হিসেবেই বেশি চেনেন। নগরের ইট-কাঠ-পাথরের ঝনঝন যান্ত্রিক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে এক দিনের জন্য যেতে পারেন এই গ্রামে। চোখ জুড়ানো দৃশ্য নিয়ে সেজে আছে পুরো গ্রাম। যেদিকে চোখ যায় গোলাপের ক্ষেত। গোলাপের নয়নাভিরাম দৃশ্য ও মনোমুগ্ধকর সুবাস গ্রাস করবে আপনাকে। গোলাপ তো আছেই, গ্ল্যাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, রজনীগন্ধা, আরও কত ফুল। ফুল কিনছেন অনুরাগীরা, কাছে গিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা কারও কারও। ঢাকার খুব কাছেই সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নে তুরাগ নদের তীরে এই গোলাপ গ্রাম সাদুল্লাহপুরের অবস্থান।
সাদুল্লাহপুরের গোলাপ গ্রাম
কীভাবে
যাবেন : ঢাকার খুব কাছেই সাভারে
তুরাগ তীরে সাদুল্লাহপুর। ঢাকার
যেকোনো জায়গা থেকেই প্রথমে যেতে হবে গাবতলী।
এরপর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে যেকোনো বাসে
সাভার বাসস্ট্যান্ডের ওভারব্রিজের নিচে নেমে ওভারব্রিজ
পার হয়ে পূর্বদিকের বিরুলিয়া
ইউনিয়নের রাস্তায় যেতে হবে। সেখান
থেকে ব্যাটারিচালিত হ্যালো বাইকে করে ভাড়া ২০
টাকায় পৌঁছে যাবেন স্বপ্নের মতো সুন্দর গোলাপ
গ্রামে।
এ ছাড়াও মিরপুর শাহআলী মাজারের সামনে কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে
আকরান বাজার। ভাড়া পড়বে ২০
টাকা। সেখান থেকে ১০ টাকা
অটো ভাড়ায় সাদুল্লাহপুর গ্রামে যেতে পারবেন। নিজস্ব
পরিবহনে যেতে চাইলে এই
পথ দিয়ে যাওয়া যাবে।
তাহিরপুরের শিমুল বাগান
বিশাল
এলাকাজুড়ে টকটকে লাল রঙের শিমুল
ফুলের বাগান। বড় বড় শিমুলগাছ
যেন বসন্তে পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। বসন্ত
আসতেই গাছে শিমুল ফুল
ফুটতে শুরু করে। ওপর
থেকে দেখলে মনে হবে লাল
চাদর ছড়িয়ে রাখা হয়েছে মাটিতে।
লাল টকটকে শিমুল ফুলের সৌন্দর্য দেখতে তাইতো দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ভিড় জমায় দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগানে। বলছি সুনামগঞ্জের শিমুল বাগানের কথা। এটি ১০০ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে অবস্থিত। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের মানিগাঁও এলাকায় এই শিমুল বাগানের অবস্থান। যাদুকাটা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই বাগানই দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান বলে পরিচিত। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে যাদুকাটা নদী আর এপারে শিমুল বাগান। শিমুল বাগান ভ্রমণে গিয়ে চারপাশের এসব সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারবেন। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পুরো এলাকাজুড়ে টকটকে লাল শিমুল ফুল দেখা যায়। রক্তিম আভায় পর্যটকরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন এই খোলামেলা বাগানে। ফাল্গুন আসতেই দেশ-বিদেশ থেকে আসতে শুরু করেন পর্যটকরা।
তাহিরপুরের শিমুল বাগান
কীভাবে
যাবেন : ঢাকা থেকে প্রথমে
যেকোনো বাসে চড়ে পৌঁছাতে
হবে সুনামগঞ্জ। ভাড়া পড়বে ৫০০-৭৫০ টাকা। যেতে
সময় লাগবে কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা। সুনামগঞ্জ
নেমে আব্দুর জহুর ব্রিজে মোটরসাইকেল,
সিএনজি, লেগুনা দাঁড়িয়ে থাকে। মোটসাইকেলে গেলে বারেক টিলা
নদীর এপার পর্যন্ত ভাড়া
নেবে ২০০-৩০০ টাকা।
এক বাইকে চালকসহ তিনজন ওঠা যায়।
যাদুকাটা
নদীর সামনে নামিয়ে দেবে। ৫-১০ টাকা
দিয়ে নৌকা পার হয়ে
ওপারে গেলেই বারেক টিলা। বারেক টিলা থেকে নেমেই
চোখে পড়বে কয়েকটি চায়ের
দোকান। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে শিমুল বাগান
যাওয়ার পথ।
বিকাল
পর্যন্ত বাগানে সময় কাটিয়ে যাদুকাটা
নদী পার হয়ে ফিরে
আসুন বারেক টিলায়। সেখান থেকে সিএনজি বা
মোটরসাইকেলে সুনামগঞ্জে ফিরে আসতে হবে।
অন্যান্য স্পট ঘুরতে চাইলে
বাগানে সকালে গিয়ে দুপুরের মধ্যে
ঘুরে আসুন। তাহলে ফেরার পথে টেকেরঘাট, নীলাদ্রি
লেক ও টাঙ্গুয়ার হাওরও
ঘুরে আসতে পারবেন।
সাবদি গ্রামে এক দিন
ঢাকার
কাছে ডে ট্রিপের জন্য
আদর্শ একটা জায়গা হতে
পারে ফুলের গ্রাম সাবদি। সাভারের গোলাপ গ্রামের মতোই নারায়ণগঞ্জের সাবদিতে
আস্ত একটা গ্রামে ফুলের
চাষ হয়। গোলাপ গ্রামে
শুধু গোলাপের আধিক্য থাকলেও সাবদি গ্রামে দেখা মিলবে হরেক
রকম ফুলের। এক ছুটির দিন
সকালে বউ-ছানাপোনা নিয়ে
বেরিয়ে পড়তে পারেন নারায়ণগঞ্জের
বন্দর উপজেলার সাবদি গ্রামের উদ্দেশে। গুলিস্তান থেকে এসি বাসে
নারায়ণগঞ্জ চাষাড়া পৌঁছাতে ৪০ মিনিটের মতো
সময় লাগবে। এরপর ঘাট থেকে
নৌকায় বন্দর পৌঁছাতে সময় লাগবে ১০
মিনিটের মতো। বন্দর ঘাট
থেকে টমটমে চেপে রওনা করতে
হবে সাবদি বাজারের পথে।
নারায়ণগঞ্জের সাবদি গ্রাম
সাবদি
বাজারে মালাই চা খেতে খেতে
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিন। বাজারের
ঠিক পাশেই একটা বিশাল ফুলের
বাগান। সারি সারি ফুলের
গাছ। কত শত ধরনের
ফুল ফুটে আছে। গ্ল্যাডিওলাস,
জারবেরা, জিপসি, গাঁদা, ডালিয়া, কসমস, কাঠমালতি, চন্দ্রমল্লিকা আরও কত নাম
না জানা ফুল! এ
যেন ফুলের রাজ্য! কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
নিঃশ্বাস নিলেই ফুলের ঘ্রাণ।
কীভাবে
যাবেন : নারায়ণগঞ্জ চাষাড়া থেকে রিকশা দিয়ে
২ নম্বর ঘাট যেতে ২০-৩০ টাকা ভাড়া
লাগবে। বাসে গেলে জনপ্রতি
১০ টাকায় যাওয়া যায়। এরপর সেখান
থেকে নদী পার হতে
জনপ্রতি ২ টাকা লাগবে।
নদী পার হওয়ার পর
সেখান থেকে অটোতে যাবেন
সাবদি ফুলের ক্ষেত। অটোতে জনপ্রতি ২৫-৩০ টাকা
ভাড়া নেবে। রিকশাওয়ালাকে বললেও নিয়ে যাবে সেখানে,
ভাড়া নেবে ৮০ টাকা।
এ ছাড়া অনেক মানুষ
সেখানে ঘুরতে যায় বলে বর্তমানে
সেখানে একটা ছোট পার্কের
মতো জায়গা করা হয়েছে, সেখানেও
ফুলের গাছ বোনা হয়েছে।
সেটিও সুন্দর জায়গা। পার্কের এন্ট্রি ফি ২০ টাকা।