× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ক্লাস টু পাস সাইদুর যেভাবে প্রেস ব্যবসায় সফল

হাসনাত মোবারক

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৫৬ পিএম

আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:১৫ পিএম

সংগ্রামী সাইদুর রহমান জীবন যুদ্ধে সফল একজন

সংগ্রামী সাইদুর রহমান জীবন যুদ্ধে সফল একজন

টানাটানির সংসার। বিবাহ উপযুক্ত বড় দুই বোন, তার পরে আরও ছোট তিন ভাই। বাবা-মাসহ আটজনের সংসার। দিনমজুর বাবার একার আয়ে তিন বেলা পেট পুরে খাবার জোটে না। তাই ক্লাস টুতে উঠে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাট চোকাতে হয়। তবে কবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে সে সালটি এখন আর মনে করতে পারেন না।

তার শুধু মনে আছে একটি সাল, ১৯৮৮। কেননা ওই বছরের কোনো একদিন কিশোর বয়সে অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। বলছি বর্ণা ডাই কাটিং অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী সাইদুর রহমানের কথা। লেখাপড়া না জেনেও যিনি ছাপাখানা ব্যবসায় সফল হয়েছেন। নিজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, কাঁধে তুলে নিয়েছেন গোটা পরিবারের ভার।

সাইদুর রহমানের সেই বাড়ি পালানোর কথায় ফিরে যাই আবার। সেদিন পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার কাটনহারি গ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে নীলফামারীর ডোমার স্টেশনে পৌঁছান। ট্রেন এলে লাফিয়ে ওঠেন। সে ট্রেনের গন্তব্য দিনাজপুরের পার্বতীপুর। কিন্তু সেই কিশোর যাবে আরও দূরে! কই যাবে? জানে না। ইতোমধ্যে স্টেশনে চলে আসে ঢাকাগামী একতা এক্সপ্রেস। ওই ট্রেনে চড়ে গাইবান্ধার বাহাদুরাবাদ স্টেশনে নামেন। সেখান থেকে স্টিমারে ফুলছড়ি ঘাট। ওঠেন ট্রেনে। অচেনা পথ। রঙবেরঙের মানুষের মুখ দেখতে দেখতে এসে নামেন ঢাকার তেজগাঁও স্টেশনে। দীর্ঘ পথভ্রমণে সেই কিশোরের একটিও পয়সা খরচ হয়নি। ট্রেনে, লঞ্চে লোভনীয় খাবার দেখেছেন। পেটে ক্ষুধা ছিল, কিন্তু বারবার মনে পড়ছে তার তো পুঁজি সবে পাঁচ টাকা! বয়স কম, তাই কেউ ভাড়াও চায়নি।

অচেনা নগর, নেই কোনো স্বজন। প্রথম রাতটি স্টেশনে কাটান। পর দিন এক টাকা দিয়ে কিছু কিনে খান। খাওয়ার পর মনে হলো কোনো দোকানে শুধু ভাতের ব্যবস্থা হলেই কাজ করবেন। কিন্তু পড়েন নতুন বিপদে। যেখানে যান সবাই কটুকথা বলে তাড়িয়ে দেয়। এ রকম বেশ কয়েক রাত স্টেশনে পার করেন। সঙ্গের টাকাও খরচ হয়ে গেছে। আধপেট খেয়ে তিন দিন পার করেন। এমন সময় পরিচয় এক ব্যক্তির সঙ্গে। তার পরিচিত একজন তেজগাঁওয়ের প্রগেসিভ প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করেন। পর দিন এ কিশোরকে নিয়ে কাজে লাগিয়ে দেন প্রেসে। দৈনিক ২০ টাকা বেতনে কাজ শুরু। মাস পাঁচেক বই বাঁধাইয়ের কাজ করার পর ডাই কাটিংয়ের কাজ শেখেন। এখানে বেতন একটু বেশি। কাজে মনোযোগী দেখে ম্যানেজার তার বেতন বাড়িয়ে দেন। তেজগাঁওয়ে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত একই প্রেসে কাজ করেন।

কৈশোর পেরিয়ে তত দিনে হয়ে গেছেন যুবক। প্রিন্টিংয়ের খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে। বেতন বেড়ে ৫ হাজার হয়। একসময় সেখান থেকে পল্টনে বাসন্তী প্রিন্টার্সে চাকরি নেন। বেতন ৮ হাজার টাকা। 

২০০০ সাল। নতুন শতাব্দীতে নিজের ভাগ্যে পরিবর্তন আনতে সিদ্ধান্ত নিলেন ডাই কাটিং মেশিন কিনবেন। কিন্তু টাকা পাবেন কই? সে সময় একটা মেশিনের দাম ২ লাখ টাকা। এত দিনে যা আয় করেছেন, তা দিয়ে দুই বোনের বিয়েতে আর সংসারে খরচ করেছেন। নিজেও করেছেন বিয়েও।


আত্মীয়দের থেকে ধার নেবেন এমন কেউ নেই। প্রিন্টিং পেশায় কাজের সুবাদে অনেকের সঙ্গে পরিচয় আছে। কাজ করে টাকা শোধ করবেন এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে অনেক কোম্পানির কাছে ধরনা দেন। দুয়েকজন রাজি হন। তারা মেশিন কেনার জন্য কিছু টাকা দেন।  দিনরাত পরিশ্রম করে সে টাকা কিছুদিনের মধ্যে পরিশোধ করে আরও একটি মেশিন কেনেন। ছোট্ট একটি মেশিনঘর। কাজ শেষে ওখানেই থাকেন। রান্নাবান্নাও চলে। এভাবে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে  থাকে। ২০০২ সালে আর একটু কলেবরে শুরু করলেন ব্যবসা। নিজে ব্যবসা শুরুর দুই যুগ পরে এসে এখন তার রয়েছে নিজস্ব ছাপাখানা, বাঁধাই কারখানাসহ শুরুর ডাই কাটিংয়ের ব্যবসা।

তিন যুগের ছাপাখানার জীবনে কত মানুষের উপাখ্যান সাইদুর রহমানের হাত দিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছেছে; কিন্তু এই মানুষটির জীবনের কোনো ঘটনা পাঠক জানবে না। কেননা সাইদুর রহমান লেখাপড়া জানেন না। ‍তার ব্যবসা পরিচালনায় ব্যাংক হিসাবের বইয়ে স্বাক্ষর দিতে যে তিনটি অক্ষর লাগে, শুধু ওই তিনটি বর্ণই লিখতে পারেন তিনি।

ব্যবসার প্রসার ও পড়ালেখা না জানার পরও তিনি কীভাবে এ কাজ করেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এ কাজ তো জটিল। এখানে লাগে অভিজ্ঞতা।’ বইয়ের একটি ডামি ফর্মা দেখিয়ে বলেলেন, ‘১৬ পৃষ্ঠায় ফর্মা। ফর্মা বসিয়ে কাগজে প্রিন্ট দিয়ে মেলানোর পর সেটা প্রেসে ছেড়ে দিই।’ হেসে বললেন, ‘জানেন তো, দেখায় শিক্ষা নাচনে বিদ্যা।’ সাইদুর রহমান জানান, পড়ালেখা না জানলেও চলে। প্রেসে ব্যবসায় লাগে হিসাব। কত রিম কাগজ লাগবে তার সঠিক হিসাব জানতে হবে।

ব্যবসার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘তিনটি কারখানায় ৫০ জন সহকর্মী আছে। যাদের মাসিক বেতন ৫ লাখ টাকা। অফিস, গোডাউন, কারখানার ভাড়া ৬০ হাজার।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ব্যবসা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে দুই তলা বাড়ি করেছি। ছোট দুই ভাইকে গ্রামে চাষবাস করার জন্য জমি কিনে দিয়েছি। বড় মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে একটা কোম্পানিতে চাকরি করছে। ছোট তিন মেয়ে পড়ালেখা করে।’

বইমেলার এই সময়ে দারুণ ব্যস্ত সাইদুর রহমান। সবশেষে বললেন, ‘পরিশ্রমই যে সব তার প্রমাণ আমি। কয়টা টাকা বেশি আয়ের জন্য দিনে কারখানায় কাজ করেছি, রাতে কুলির কাজ করেছি।’ আরেক দিন কথা হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের মতো চলে আসি।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা