× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সীমান্তহত্যা ও ‘তীব্র প্রতিবাদলিপি’

সিরাজুল ইসলাম আবেদ

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:২৯ পিএম

আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:৫৫ পিএম

বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত সহযোদ্ধা সিপাহি মোহাম্মদ রইশুদ্দীনের লাশের কফিন কাঁধে বয়ে নিয়ে আসছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদস্যরা

বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত সহযোদ্ধা সিপাহি মোহাম্মদ রইশুদ্দীনের লাশের কফিন কাঁধে বয়ে নিয়ে আসছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদস্যরা

ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে প্রতি মাসেই প্রাণ হারাচ্ছেন বাংলাদেশের নাগরিক। সম্প্রতি তাদেরই হাতে নিহত হয়েছেন বিজিবির সদস্য সিপাহি মোহাম্মদ রইশুদ্দীন। সীমান্তে হত্যা বন্ধে আছে আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিবারই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হয়। তারপরও থামছে না সীমান্তে হত্যা। কিন্তু কেন থামছে না...

ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর গুলিতে নিহত সহযোদ্ধা সিপাহি মোহাম্মদ রইশুদ্দীনের লাশের কফিন কাঁধে বয়ে নিয়ে আসছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদস্যরা। ছবিটি অনেকেই দেখেছেন নিশ্চয়। না দেখে থাকলে আরেকবার দেখে নিতে পারেন। লাশ ফেরত দেওয়ার আগে বিএসএফ রইশুদ্দীনের কফিন গাঁদা ফুলের মালায় সাজিয়ে দিয়েছে। একেই বুঝি ‘সৌজন্য’ বলে! ২৪ জানুয়ারি লাশ হস্তান্তর হলেও বিএসএফ ‘সীমান্তহত্যা’র ঘটনাটি ঘটায় আরও দুই দিন আগে ২২ জানুয়ারি ভোর ৫টায়।

বিজিবির বিজ্ঞপ্তিসূত্রে জানা যায়, সোমবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বিজিবি যশোর ব্যাটালিয়নের ধান্যখোলা বিওপির জেলেপাড়া পোস্ট-সংলগ্ন এলাকায় ভারত থেকে একদল গরু চোরাকারবারিকে সীমান্ত অতিক্রম করে আসতে দেখে। এ সময় টহলদলের সদস্যরা চ্যালেঞ্জ করলে তারা দৌড়ে ভারতের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বিজিবি টহলদলের সদস্য সিপাহি মোহাম্মদ রইশুদ্দীন চোরাকারবারিদের ধাওয়া করতে করতে ঘন কুয়াশার কারণে দলবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

প্রাথমিকভাবে তাকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও পরে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, তিনি বিএসএফের গুলিতে আহত হয়ে ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এ নিয়ে বিজিবি-বিএসএফ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক হয়। পরে ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই সৈনিকের মৃত্যু হয়।

মনে পড়ে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানী হত্যার ঘটনা। নয়াদিল্লিতে গৃহকর্মীর কাজ করা ফেলানী তার বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরছিল। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের সময় ফেলানীর পোশাক কাঁটাতারের বেড়ায় জড়িয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সে চিৎকার শুরু করে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সেই চিৎকারের জবাব দেয় তাকে লক্ষ করে গুলি চালিয়ে। সেখানেই ফেলানী মারা যায়। তার নিষ্প্রাণ দেহ কাঁটাতারের বেড়ায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা উল্টোভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকারীদের ভয় দেখাতেই কি তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছিল?

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে নিহত কিশোরী ফেলানী কাঁটাতারে ঝুলে ছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা

ফেলানী হত্যার পর ভারত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চাপ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে তারা বিচারের আয়োজন করে। কিন্তু সবই ছিল লোকদেখানো। ন্যায়বিচার মেলেনি। এমনকি ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থা যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলেছিল তা-ও এখন পর্যন্ত মেলেনি।

বিজিবি জানিয়েছে, বিএসএফের কাছে ‘সুষ্ঠু তদন্তের দাবি’ জানানোর পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবে ‘তীব্র প্রতিবাদলিপি’ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? প্রতি বছরই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর তালিকা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিএসএফের গুলি, নির্যাতন ও ধাওয়ায় ২৩ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। ২০২১ সালে বিএসএফের হাতে গুলিসহ বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়েছিল ২০ জন। ২০২০ সালে গুলি ও নির্যাতনে হত্যার ঘটনা ঘটে ৪৮টি। ২০১৯ সালে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ৪৬ জন নিহত হয়। ২০১৮ সালে বিএসএফর গুলিতে নিহত হয় ৮ জন এবং নির্যাতনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ জন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ জন। আর ২০২৩ সালে সীমান্তে মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের। আহত হয়েছে আরও ৩১ জন। অধিকাংশই বিএসএফের গুলিতে। আমরা প্রায়ই বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলি। এ হত্যাগুলোকে ‘বিক্ষিপ্ত’ বলার চেষ্টা করি। ভারত বরাবরই সীমান্তে ‘মারণাস্ত্র’ ব্যবহার না করার কথা বলে আসছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সীমান্তহত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তার পরও বাস্তবতা হলো, সীমান্তহত্যার ৯০ ভাগই সংঘটিত হয়েছে বিএসএফের হাতে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিহতের অধিকাংশই গরু চোরাকারবারসহ বিভিন্ন পাচার ও অবৈধ কাজে যুক্ত। তার মানে তো এই নয়, তাদের দেখামাত্র গুলি করা হবে।

রইশুদ্দীন হত্যাকাণ্ডের পর ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সম্পাদক কিরীটি রায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘দুই মাস আগেও বলা হয়েছে সীমান্তহত্যা কমানো হবে। কিন্তু কমছে না। ভারত সরকার বলছে বিএসএফ তাদের কথা শুনছে না। এটা কীভাবে সম্ভব!’ 

তিনি বলেছেন, ‘সীমান্তহত্যার পেছনে যে গল্প ফাঁদা হয় তা-ও ঠিক নয়। তারা বলে সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান হয়। চোরাকারবারিদের হত্যা করা হয়। মনে হয় যেন সীমান্তে গরু জন্ম নেয় আর তা বাংলাদেশে পাচার করা হয়। বাস্তবে এসব গরু আনা হয় ভারতের অভ্যন্তরে দুই-আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে। গরুগুলো হাঁটিয়ে, ট্রাক, ট্রেনে করে আনা হয়। তখন কেউ দেখে না, আটকায় না! কারণ তারা ভাগ পায়। এখানে আসল কথা হলো দুর্নীতি, ভাগবাঁটোয়ারার মাধ্যমে সব করা হয়। যখন ভাগবাঁটোয়ারায় মেলে না তখন বিএসএফ হত্যা করে। ভারতের সীমানায় প্রবেশ এবং কথিত পাচারের অপরাধে কখনই মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া যায় না ভারতীয় আইন অনুযায়ী। আর বিএসএফের সাজা দেওয়ার অধিকারও নেই। তারা গ্রেফতার করে আদালতে নিয়ে যেতে পারত, কাউকে গুলি করে হত্যা কেন করা হলো?’

মাসুমের পক্ষ থেকে ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে যৌথভাবে তদন্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু এসবের যে তোয়াক্কাই করে না বিএসএফ তার প্রমাণ মিলল সপ্তাহ না পেরোতেই। এবারের স্পট লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম সীমান্ত। সেখানে ২৮ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে রফিউল ইসলাম টুকলু নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রফিউল পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়নের ডাঙ্গারপাড়া গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম সীমান্তের ডাঙ্গারপাড়ায় ১ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছে রফিউলকে হত্যা করা হয়। অপরাধ, রফিউল বাংলাদেশের সীমান্তরেখা অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এ সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ থানার ৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের অর্জুন ক্যাম্পের টহলরত সদস্য গুলি করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান রফিউল। অভিযোগ, রফিউর ভারতীয় পণ্য চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত।

ভারত বাংলাদেশকে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ বলছে কিন্তু ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমারেখাকে তারা মৃত্যুকূপ করে রাখছে; তা কীভাবে সম্ভব! বিএসএফ ধরাবাহিকভাবে সীমান্তহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তারা একে সীমান্তহত্যা নয়, বলতে চায় ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু’। সে যা-ই হোক, মুখে সীমান্তহত্যা কমিয়ে আনার কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বিএসএফ যে কারণ দেখিয়ে হত্যাকাণ্ডগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে তা-ও গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ চোরাকারবারি বা অপরাধী হলেও তাকে বিনা বিচারে হত্যা করা আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কোনো দেশের নাগরিককে এভাবে হত্যা করা যায় না। কিন্তু বিএসএফ নিয়মিতই করে যাচ্ছে এবং ভারত সরকারও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে একে বৈধতা দিচ্ছে। তাই আমাদেরও বোধ হয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে ‘বন্ধুত্ব’র খাতিরে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, ‘সুষ্ঠু তদন্তের দাবি’ আর ‘তীব্র প্রতিবাদলিপি’ থেকে বেরিয়ে আসার।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা