শাহরিয়ার কবির
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:৫৮ পিএম
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:১০ পিএম
প্রকৃতির নির্জনতাকে উপভোগ করতে ক্যাম্পিংয়ে পাওয়া যায় ভিন্ন অনুভূতি
প্রকৃতিকে যারা অনেক কাছ থেকে উপলব্ধি করতে চান তাদের জন্য বহু প্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা হলো ক্যাম্পিং। এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা প্রকৃতির বুনো মাদকতাকে সূক্ষ্মভাবে উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়। সেখানে ভয় ও উত্তেজনাকে ছাপিয়ে আবির্ভূত হয় রাতভর আড্ডা আর পূর্ণিমার আলোয় ঝিঁঝি পোকার ডাক। লিখেছেন শাহরিয়ার কবির
নগরের যান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে চান যারা তাদের জন্য ক্যাম্পিং একদম আদর্শ! তবে থাকতে হবে অ্যাডভেঞ্চারের মানসিকতাও। আর তাহলেই নিখাদ আনন্দের হয়ে ওঠে তাঁবুতে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর আগেও তেমন কোনো ক্যাম্পিং স্পট ছিল না। তবে এখন বদলে গেছে দৃশ্যপট। শীতকাল যেহেতু ক্যাম্পিংয়ের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময়, তাই এবার আপনাদের জানাচ্ছি বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্যাম্পিং স্পট কোনগুলো!
সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপ, কক্সবাজার
বালুকাবেলায় ক্যাম্পিং করতে চাইলে সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপ হতে পারে দুর্দান্ত গন্তব্য। নীল জলরাশি আর সমুদ্রের লোনা হাওয়া আপনার ক্যাম্পিং করার আনন্দকে পূর্ণতা দেবে নিশ্চিত। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিম সৈকত ও ছেঁড়া দ্বীপের পুরোটাই ক্যাম্পিং করার জন্য আদর্শ জায়গা। এ কথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নিরাপত্তা ও সৌন্দর্যের বিবেচনায় বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্যাম্পিং স্পটগুলোর তালিকায় থাকবে এ দ্বীপগুলো।
মারায়ন তং, বান্দরবান
সম্প্রতি মারায়ন তং ভ্রমণকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষত ক্যাম্পিং করার জন্য অনেকেই মারায়ন তংকে বেছে নিচ্ছেন। আলীকদমের মিরিঞ্জা রেঞ্জের চূড়ায় অবস্থিত এই স্পটে ক্যাম্পিং করার জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। শরতে মারায়ন তং-এর গাছের নিচের তাঁবুতে বসে দেখতে পারেন মেঘ-বাতাসের লুকোচুরি। নিজের তাবু না থাকলে আপনি আলিকদম বাজারে আবাসিক মোড়ের হোটেল থেকে তাবু ভাড়া নিতে পারেন। প্রতি রাতের জন্য তাবু ভাড়া সাইজের ভিত্তিতে ২০০-৩০০ টাকা পড়বে। গাইডও নিতে পারবেন এখান থেকেই।
মহামায়া লেক, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের মহামায়া লেকে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় ক্যাম্পিং করার সুযোগ রয়েছে। যারা সবেমাত্র ক্যাম্পিং শুরু করতে চান কিংবা যারা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ক্যাম্পিং করতে চাইছেন না, তারা মহামায়া লেক বেছে নিতে পারেন। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে লেকের চারপাশে ক্যাম্পিং করার সুযোগ দেয় লেক কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পিং করার জন্য তাঁবুসহ অন্যান্য সবকিছু এখানে ভাড়া পাওয়া যায়। মহামায়া লেকে ক্যাম্পিং এবং কায়াকিং পরিচালনা করেন মহামায়া কায়াকিং এন্ড ক্যাম্পিং পয়েন্ট। তাদের ক্যাম্পিং টাইম সন্ধ্যা ৬টা হতে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত। ক্যাম্পিংয়ের প্যাকেজ মূল্য ৯০০ টাকা জনপ্রতি।
রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্য, হবিগঞ্জ
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত রেমা কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অভয়ারণ্যগুলোর একটি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এখানে বনের ধারে ক্যাম্পিং করার সুযোগ আছে। সত্যিকার জঙ্গলে ক্যাম্পিং করার স্বাদ নিতে চাইলে এখানে চলে আসতে পারেন। রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে দুইভাবে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে সিলেটগামী বিভিন্ন পরিবহনে বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে নামতে হবে শায়েস্তাগঞ্জ। সেখান থেকে অটোরিকশায় চড়ে যেতে হবে কালেঙ্গা।
নিঝুম দ্বীপ, নোয়াখালী
নিঝুম দ্বীপের বিশেষত্ব হচ্ছে চিত্রা হরিণ ও শীতকালের অতিথি পাখি। একসঙ্গে এত চিত্রা হরিণ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। আর সন্ধ্যা নামলেই শিয়ালের ডাক শিরদাঁড়া দিয়ে রোমাঞ্চের ঢেউ তোলে। বাংলাদেশের দক্ষিণের বিভাগ চট্টগ্রামের নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হাতিয়া উপজেলার ছোট একটি দ্বীপ এই নিঝুম দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এই চরটি হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। চর ওসমান, বাউল্লার চর, কামলার চর ও মৌলভীর চরÑ এই চার চর নিয়ে পুরো নিঝুম দ্বীপ। শীতের অতিথি পাখি দেখার জন্য এখানকার আরও একটি দর্শনীয় জায়গা হচ্ছে ভার্জিন আইল্যান্ড। দমার চরের দক্ষিণে নতুন সৈকতটিই ভার্জিন আইল্যান্ড। দমার চর ঘুরে আসতে হলে ট্রলার ভাড়া পড়বে প্রায় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। নিঝুম দ্বীপ থেকে একটু দূরের পথে দেখা মিলবে ভোলার ঢালচর আর চর কুকরি-মুকরি।
শীতের নিঝুম দ্বীপ মানেই ক্যাম্পিং। দ্বীপে ক্যাম্পিংয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো নামার বাজারের নিঝুম রিসোর্টের পাশের খালটি পেরিয়ে সৈকতের কাছে প্রায় ছয় মাইলের বিশাল খোলা মাঠটি। ক্যাম্পিংয়ে রীতিমতো স্বয়ংসম্পূর্ণ নিঝুম দ্বীপ। এখানকার জাহাজমারা বাজারে ক্যাম্পিংয়ের প্রায় সব আইটেমই পাওয়া যায়। এ ছাড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায়ও তাঁবু ভাড়া পাওয়া যায়। তাই যাত্রার সময় সঙ্গে করে তেমন কিছুই নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সবচেয়ে সেরা উপায়টি হচ্ছে লঞ্চভ্রমণ। সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিকাল সাড়ে ৫টায় একমাত্র লঞ্চ হাতিয়ায় তমরুদ্দি ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তমরুদ্দি ঘাট থেকে ঢাকার ফিরতি লঞ্চ ছাড়ে দুপুর সাড়ে ১২টায়। তমরুদ্দি ঘাট থেকে মোটরসাইকেলে মোক্তারিয়া ঘাট পৌঁছা যাবে। বাকি পথটা একইভাবে পাড়ি দিতে হবে। তবে তমরুদ্দি ঘাট থেকে সরাসরি নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার পর্যন্ত জলপথটা পাড়ি দেওয়ার আরেকটি উপায় আছে। তমরুদ্দি ঘাট থেকে কিছু মাছ ধরার ট্রলার সরাসরি নামার বাজার যায়।
চর কুকরি মুকরি, ভোলা
নিশ্চুপ প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পিং করার লোভেই ছুটে যেতে পারেন ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরি মুকরিতে। চর কুকরি মুকরির বনে যেসব প্রাণী দেখা যায় তার মধ্যে আছে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বন্য মহিষ-গরু, বনবিড়াল, বনমোরগ প্রভৃতি। আর পাখি ও সরীসৃপ হিসেবে এই বনের অধিবাসীদের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বনমোরগ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল, গুইসাপ, বেজি, কচ্ছপ, কুকুরি বনের ও নানা ধরনের সাপ। এই চরে শীতকালের চিত্র ভিন্ন ধরনের। সুদূর সাইরেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এর মধ্যে সিংহভাগই ভোলায় অবস্থান করে। তখন স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি মুকরির চর অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে টেন্টে ক্যাম্পিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। এখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো, তাই সে বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সেখানে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো লঞ্চভ্রমণ। ঢাকা থেকে চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট পর্যন্ত লঞ্চরুটে যাওয়া ও আসার ভাড়া কিন্তু ভিন্ন। যাওয়ার সময় ডেক ভাড়া ৪০০ হলেও ফেরার সময় ৩০০ টাকা। সিঙ্গেল কেবিন ১২০০ ও ডাবল কেবিন ২৪০০ টাকা। বেতুয়া ঘাটে নেমে চর কুকরি মুকরিতে যাওয়ার দুই উপায়। প্রথমটি হলো, অটো নিয়ে চলে যেতে হবে চরফ্যাশন বাস টার্মিনালে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০-৪০ টাকা। সময় লাগবে ২০-২৫ মিনিট। চরফ্যাশন থেকে আপনি চর কচ্ছপিয়া যাওয়ার জন্য পাবেন দক্ষিণ আইচার বাস। ভাড়া জনপ্রতি ৪০ টাকা। সময় লাগবে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা। বাস থেকে নেমে আবার অটো বা রিকশায় জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়ায় কচ্ছপিয়া ঘাটে পৌঁছে যাবেন। চর কচ্ছপিয়া থেকে চর কুকরি মুকরি যাওয়ার উপায় মূলত দুটি। জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা ভাড়ায় ট্রলারে যেতে পারেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা ও দুপুর ১২টায় লোকাল ট্রলার চর কুকরি মুকরির উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
মেরিন ড্রাইভে ক্যাম্পিং
কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে ক্যাম্পিংয়ের জন্য আদর্শ একটা প্লেস হচ্ছে শাপলাপুর। পাশেই একঝাঁক নৌকা, তার পাশেই ক্যাম্পিং। রাস্তার ওপারেই আছে বাজার। নিরাপত্তার তেমন কোনো সমস্যা নেই। এলাকার মানুষ অনেক আন্তরিক। প্রতি সকালের মাছ কেনাবেচার হিড়িক বসে এখানে। দৈনিক এক কোটি টাকার মতো নাকি মাছ বিক্রি হয় এখানে। মেরিন ড্রাইভে ক্যাম্পিং করতে চাইলে চলে যেতে পারেন কক্সবাজার থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে মেরিন ড্রাইভ ঘেঁষে অবস্থিত শাপলাপুর বিচ।
বেস ক্যাম্প অ্যাডভেঞ্চার, গাজীপুর
গাজীপুরে অবস্থিত এই ক্যাম্পটি প্রথমবারের মতো বেসরকারিভাবে প্রকৃতির মাঝে নির্মিত ক্যাম্প। এখানে ক্যাম্পিংয়ের পাশাপাশি ব্যবস্থা আছে রোপ সাইক্লিং, ক্লাইম্বিং, আর্চারিসহ দারুণ কিছু আউটডোর অ্যাক্টিভিটিসের। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস অবধি দ্য বেস ক্যাম্প বাংলাদেশে ক্যাম্পিংয়ের সুযোগ দিয়ে থাকে। অ্যাক্টিভিটিসগুলোর ওপর নির্ভর করে স্কুল, পরিবার অথবা করপোরেট গ্রুপগুলোর ক্যাম্পিং প্যাকেজ ভিন্ন হয়ে থাকে। ২০ জনের একটি দলের প্রতি দুই সদস্যের এখানে তাঁবুতে থাকার জন্য ভাড়া পড়ে আড়াই হাজার টাকা।
মায়াদ্বীপ, নারায়ণগঞ্জ
এটি মূলত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনা নদীর ঠিক মাঝখানে জেগে ওঠা ত্রিভুজ আকৃতির একটি চর। ক্যাম্পিংয়ের আসল রোমাঞ্চকর আমেজের ষোলোআনাই পরিপূর্ণ হবে এই গ্রামটিতে। গুলিস্তান থেকে বাসে করে মোগড়াপাড়া; তারপর সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে বৈদ্যের বাজার বা আর একটু ভেতরে আনন্দবাজার ঘাট। এখান থেকেই নৌকা নিয়ে রওনা হওয়া যাবে মায়াদ্বীপের উদ্দেশে। পুরো যাতায়াতে খরচ পড়তে পারে বাস, অটোরিকশা ও নৌকা নিয়ে মোট প্রায় ৮০ টাকা।
প্রয়োজনীয় টিপস