× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নারী ও শিশু নির্যাতন

যে ক্ষত রয়ে গেছে

বাসন্তি সাহা

প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:০০ পিএম

 যে ক্ষত রয়ে গেছে

৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩; বছরের শেষ দিনটিতে গাজীপুর সদর উপজেলার বাসন গ্রামে ১২ বছরের এক মেয়েকে পুলিশ ধানক্ষেতে খুঁজে পেয়েছে- নির্যাতিত, ক্ষতবিক্ষত, মৃত। এ লেখা লেখার সময় পর্যন্ত তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। 

গত বছরটা ছিল আমাদের অনেক অর্জনের। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু নগর অথবা নগর ছাড়িয়ে দেশের একেবারে প্রান্ত পর্যন্ত কোথাও নারীর প্রতি অবমাননা, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ কমেনি। গত কয়েক বছর ও কোভিডের সময় পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়েছিল যে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সংশোধিত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ অধ্যাদেশ আকারে জারি করা গিয়েছিল। আশা করা হয়েছিল দেশে সব ধরনের নারী নির্যাতন হ্রাস পাবে। কিন্তু বাস্তবে তা লক্ষ করা যাচ্ছে না।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) গত এক বছরের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালে ৬২৩ নারী এবং ৭৬৮ শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ২৩১টি, দলগত ধর্ষণের শিকার ১১৭ নারী, হত্যা ও ধর্ষণের শিকার ১৬ নারী, ধর্ষণের শিকার ১১০ নারী। অ্যাসিড আক্রমণের শিকার ১০ নারী। এ ছাড়া ৭২ প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৪২ প্রতিবন্ধী নারী ও শিশু বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী তার নিকটতম সঙ্গী বা অন্য কেউ কিংবা উভয়ের দ্বারা নিজের জীবদ্দশায় অন্তত একবার শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দেশে দেশে বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণীত হলেও নির্যাতনের সংখ্যায় খুব একটা হেরফের হয়নি।

এ ছাড়া মহিলা পরিষদ দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণের মাধ্যমেও নারীর প্রতি সারা দেশে সংঘটিত ঘটনাগুলো তুলে ধরে। মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা বলেন, ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার, উন্নয়ন সংগঠন, নারী ও মানবাধিকার সংগঠন, নারী আন্দোলন বহুমাত্রিক কাজ করলেও নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে বর্বরতার ধরন। বর্তমান সময়ে অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমে ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক অভিঘাতের কারণে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সমন্বিত বিনিয়োগ অপরিহার্য।’

উপরোক্ত তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারীর প্রতি অবমাননা, নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। অর্থনৈতিক উন্নতি বা শিক্ষায় মানুষের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এ নির্যাতন বা অবমাননা বন্ধ করতে পারছে না। এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলে ভাবতে হবে সমাজে কেন নারীবিদ্বেষী মনোভাব বাড়ছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামাজিক মাধ্যমে কেন নারী বা নারীর শরীর হয়েছে উঠেছে প্রধানতম প্রোডাক্ট। নারীই হয়ে উঠেছে সব বিদ্বেষ বা বিকৃত আনন্দ পাওয়ার মাধ্যম। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ মানসিকতার মধ্যে আদতে রয়েছে এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিকতার দমনমূলক মনোভাব। প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যিনি নিগ্রহ করছেন বা চাপ সৃষ্টি করছেন তিনি তার অবস্থানগত দিক থেকে বা ক্ষমতায়ও নারীর থেকে ঊর্ধ্বে রয়েছেন। ফলে সমাজে নারীর যে অধস্তন অবস্থান তার ক্ষমতাহীনতা তার নির্যাতনকে ত্বরান্বিত করছে। ধর্ষণ বা নির্যাতন কেবল যৌনতা নয়, এটা একটা ক্ষমতার অপপ্রয়োগের দিকও এখানে উন্মোচিত হয়। নারীকে ছোট করে দেখা, তাকে কেবল পণ্য হিসেবে দেখা, তাকে বিভিন্নভাবে অবমাননা করা এমন একটি মনোভাব, যেখানে যিনি নিগ্রহ করছেন তিনি মনে করছেন তার লিঙ্গপরিচয়গত একটি সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে।

দেশে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী নির্যাতন আইন সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু নারীসংক্রান্ত একমাত্র আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সনদ হলো সিডও। এ সনদের মূল বিষয়, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ বা দূরীকরণ। কিন্তু সেখানে ধারা ২ ও ১৬ গ থেকে বাংলাদেশ সরকার তার আপত্তি প্রত্যাহার করেনি। ধারা-২কে বলা হয় সিডও সনদের প্রাণ। ধারা-২-এ বলা হয়েছে, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন করতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক সব ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সিডওর এ ধারাগুলো সংরক্ষণ রেখে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এ সনদে স্বাক্ষর করে। ফলে নারীর প্রতি বৈষম্য সমাজে যেমন আছে রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামোতেও রয়ে গেছে। আইনজীবী তাসনিম বিনতে মুখলিস বলেন, ‘নারীর প্রতি বৈষম্য কমাতে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন জরুরি। কারণ নারী যত দিন তিনটি পি অর্থাৎ পাওয়ার, প্রেস্টিজ ও প্রোপার্টি অর্জন করতে না পারবে তত দিন সমাজে নারীর অবস্থান বদলাবে না। তাই সিডও সনদের বাস্তবায়ন জরুরি।’

উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী নাদিরা পারভিন বলেন, ‘সহিংসতা নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিকসহ সব অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে নতুন আকার দিতে পারি। নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি, বদ্ধমূল মানসিকতা ও আচরণের পরিবর্তন অপরিহার্য। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আইনগুলোর বার্ষিক পর্যবেক্ষণ এবং সেগুলো প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য সময়োপযোগী সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে বর্তমানে বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। সরকারকে অবশ্যই বিভিন্ন সেক্টর থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং জেন্ডার প্রতিক্রিয়াশীল বাজেটিংয়ের মাধ্যমে জাতীয় বাজেট সামঞ্জস্য করতে হবে।’

এমএসএফের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, সারা দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমে বাড়ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ও ভাঙচুর, বিভিন্ন কারণে উচ্ছেদ ও গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পার্বত্য আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ২৪টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫টি ধর্ষণ, ৪টি গণধর্ষণ ও ৫টি ধর্ষণচেষ্টা।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে জাতীয়, কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। জেলা-উপজেলা কমিটিতে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিয়মিত বৈঠকে উপস্থিত থাকা কিশোরগঞ্জের নারী নেত্রী খুজিস্তা বেগম জোনাকি বলেন, ‘নিয়মিত বৈঠক হয় এবং যে মামলাগুলো সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তিযোগ্য যেমন মুখে মুখে তালাক দেওয়া, দেনমোহর আদায় করা ইত্যাদি বিষয়ে মহিলা অধিদপ্তরের নেতৃত্বে আমরা নারী অধিকার কর্মীরা তদন্ত করি ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করি। এ ছাড়া কোনো হত্যা বা ধর্ষণ সংঘটিত হলে পোস্টমর্টেম বা মেডিকেল রিপোর্ট করার ব্যবস্থা করি। কিন্তু যে নির্যাতনের মামলাগুলো আদালতে নিষ্পত্তির এখতিয়ার সেগুলোর দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে।’

বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনায় মাত্র ৩ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনি সহায়তা চেয়ে থাকে। যেসব ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়ায়, তার খুব কমসংখ্যকই বিচারের মুখ দেখে। বিভিন্ন পর্যায়ে এসব মামলা নষ্ট হয়। প্রথমে নষ্ট হয় পুলিশের তদন্তে। মেডিকেল রিপোর্ট নিয়েও সন্দেহ থাকে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল তুষারকান্তি রায় বলেন, ‘নারী নির্যাতন মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু কোর্টের সংখ্যা কম ও উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে মামলা নিষ্পত্তি হয় না। এ ছাড়া বেশিরভাগ মামলা হয় ১১-এর গ ধারা অর্থাৎ যৌতুক ও সেকশন-৯-এ অ্যাটেমপ্‌ট্‌ টু রেপ, যার ৯০ ভাগ পরে প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য হয়। ফলে মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।’

দারিদ্র্যমুক্তি, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে বাল্যবিবাহ, নারীর প্রতি অবমাননা, হয়রানি, সহিংসতাও। ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তার এগিয়ে যাওয়ার বাধাগুলো খুব বেশি অপসারিত হয়নি। বরং সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে কোথাও কোথাও বেড়েছে। একটি সমাজ ও দেশ তখনই উন্নত ও মানবিক হবে যখন নারীর একটি ন্যায়সঙ্গত, মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে। নারীর চলাচল নিঃশঙ্ক হবে।

লেখক : কোঅর্ডিনেটর, রিসার্চ অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা