জাফর সাদেক
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:১০ পিএম
৩৭২০ মিটার উচ্চতায় হরম্বো হাট
মাত্র ১৫ দিনে ইউরোপ মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এলব্রুস এবং আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কিলিমানজারো জয় করেছেন তিনি। মাউন্ট এলব্রুসের উচ্চতা ৫ হাজার ৬৪২ মিটার এবং মাউন্ট কিলিমানজারোর উচ্চতা ৫ হাজার ৮৯৫ মিটার। ঘুরিয়া পাঠকের জন্য কিলিমানজারো জয়ের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন অভিযাত্রী জাফর সাদেক
আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কিলিমানজারো পৃথিবীতে মুক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র পর্বত। তিন মিলিয়ন বছর আগে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলে উদগিরিত ছাই, লাভা এবং শিলার সমন্বয়ে সৃষ্ট কিলিমানজারো পর্বতটি পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়া-কেনিয়া সীমান্তে অবস্থিত একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। আগ্নেয় বিস্ফোরণের ফলে শিরা, মাওয়েনজি এবং কিবো নামে তিনটি শৃঙ্গের জন্ম হয়। মাওয়েনজি ও শিরা বর্তমানে মৃতপ্রায় হলেও কিবো শৃঙ্গের সর্বোচ্চ বিন্দু উহুরো পিকের পাশের জ্বালামুখ সুপ্ত অবস্থায় আছে।
কিলিমানজারো পর্বতের পাদদেশ থেকে শীর্ষ পর্যন্ত ৫টি ভিন্ন জলবায়ু স্তর দেখা যায়। পাদদেশের সন্নিকটে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং বছরজুড়ে স্থিতিশীল থাকে। প্রায় ১৮০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত চাষাবাদযোগ্য আবহাওয়া বিদ্যমান রয়েছে, যেখানে আফ্রিকান উপজাতিরা বংশপরম্পরায় বসতি গড়ে তুলেছে। দুই হাজার মিটারের পর শুরু হয় রেইনফরেস্ট অঞ্চল। এখানে ঘন জঙ্গল আর বড় বড় প্রাচীন বৃক্ষের সমাহার। যুগ যুগ ধরে বন্য প্রাণীরা এই ফরেস্টে বিচরণ করছে। এই স্তরে তাপমাত্রা কিছুটা উষ্ণ এবং বায়ু আর্দ্র থাকে। প্রায় ২৮০০ মিটার উচ্চতার পর শুরু হয় মোরল্যান্ড তথা খোলা প্রান্তর। এই স্তরে এসে বৃক্ষ সাইজে ছোট হয়ে যায়। গুল্মজাতীয় গাছ আর বর্ণিল ফুলের সমাহার অভিযাত্রীদের মুগ্ধ করে।
রেইনফরেস্ট থেকে এর বাতাস শুষ্কতর এবং তাপমাত্রা কম। এরপর থেকে প্রতিটি স্তরে তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং বাতাস শুষ্ক হতে থাকে। চার হাজার মিটার উচ্চতায় শুরু হয় পার্বত্য মরুভূমি। এখানে প্রাণের কোনো নামগন্ধ নেই। পাঁচ হাজার মিটার থেকে পর্বতের চূড়া পর্যন্ত আর্কটিক জলবায়ুর প্রভাবে কিলিমানজারোর চূড়ায় বরফ জমে। এই স্তর পাথুরে শিলা এবং বরফে আচ্ছাদিত। এমন বিচিত্রময় স্তরবিন্যাস আর জলবায়ুর ভিন্নতা কিলিমানজারোকে অনন্য করে তুলেছে। প্রাচীন যুগ থেকে কিলিমানজারো পর্বত অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি বসতি স্থাপন করেছে। তাদের নিজস্ব আচার-ধর্ম, রীতিনীতি এই অঞ্চলের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
আমাদের কিলিমানজারো ছিল বাংলাদেশ-ভারতের অভিযাত্রীদের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান। ঢাকা থেকে মুজিব ভাই এবং কলকাতা থেকে লক্ষ্মী দিদি তানজানিয়ার রাজধানী দারুস সালামে পৌঁছার আগে আমি কয়েক দিন জানজিবারে চষে বেড়িয়েছি। অবশেষে ৫ আগস্ট সকালে আমাদের অভিযানের সমন্বয়ক ডেনিস এয়ারপোর্টে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানায় এবং ওইদিন সন্ধ্যায় আমরা দারুস সালাম থেকে কিলিমানজারো অভিযানের জন্য মোশি শহরের দিকে রওনা দিয়ে সারা রাত জার্নি শেষে গন্তব্যে পৌঁছলাম। পরদিন বিশ্রাম ও অভিযানের আনুষঙ্গিক কাজে অতিবাহিত হয়ে গেল। সন্ধ্যায় গাইড পোর্টারদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব আর অভিযানের রুট নির্বাচন শেষে দ্রুত ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়লাম। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি আর নতুন পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য একটা ফ্রেশ ঘুমের প্রয়োজন ছিল।
আমাদের তিন সদস্যের অভিযাত্রীর সঙ্গে প্রধান গাইড ছিল মোদি। তার সহযোগী হামিদ এবং তিনজন পোর্টার, পাচকসহ সাত সদস্যের সাপোর্ট স্টাফ। ৭ আগস্ট সকাল ১০টায় মোশি শহর থেকে মারাঙ্গু গেট পৌঁছে দুপুরের আহার শেষে প্রথম দিনের ট্রেকিং শুরু হলো। আজকের গন্তব্য মানদারাহাট। এই পথে যাওয়ার সময় পুরো রাস্তাটা ছিল বৈচিত্র্যময় রেইনফরেস্ট। এত ঘন জঙ্গল যে, কোথাও কোথাও সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না। সাদা বানর, হনুমান আর পাখির কিচিরমিচির গানে চারপাশ মাতোয়ারা । বন্য প্রাণীরা ঝিরিতে পিপাসা নিবারণে মত্ত। তাদের কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। জলপ্রপাতে গড়িয়ে পড়া জলের শব্দ সংগীতের দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। পথে বহু অভিযাত্রী ও গাইডের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বিদেশি অভিযাত্রীদের দেখলেই গাইড পোর্টাররা সোহায়লি ভাষায় ‘কারিবু তানজানিয়া, হাকুনা মাতাতা’ বলে অভিবাদন জানাচ্ছিল। এর বাংলা অর্থ তানজানিয়ায় আপনাদের স্বাগতম। আপনাদের অভিযান আনন্দময় হোক। তিন ঘণ্টা ট্রেকিং শেষে মানদারাহাটে এসে প্রথম দিনের যাত্রা সমাপ্ত হলো।
ঘন জঙ্গল পেরিয়ে দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য হরম্বোহাট। আজকে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরের এই মোরল্যান্ড প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য রঙের খেলা। গাছপালা সাইজে ছোট হয়ে গেছে। চারপাশে বাহারি ফুল ফুটে আছে। কখনও মেঘ এসে সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে। দৃষ্টিসীমায় কিছুই দেখা যায় না। মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি আর আফ্রিকার আমুদে প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে কথা বলে সারা দিন কেমনে চলে গেল টের পেলাম না। এখানকার গাইডরা যেন এক চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। আফ্রিকার ইতিহাস-ঐতিহ্য তাদের নখদর্পণে। গল্পের ফুলঝুরি দিয়ে তারা অভিযাত্রীদের মুগ্ধ করে। মোদি একজন চৌকস গাইড এবং আমুদে প্রকৃতির লোক। তার কাছ তানজানিয়ার ওয়াকোনিঙ্গো, বান্টু পিগমি, উম্বু, ওয়াঙ্গাসা, চাগাসহ বিভিন্ন উপজাতির ইতিহাস, আফ্রিকান উপকথা, কিংবদন্তি এবং রূপকথার গল্প শোনানো।
মোদির কাছ থেকে জানলাম একসময় উম্বু জাতির আক্রমণে ওয়াকোনিঙ্গোরা এই অঞ্চল থেকে পালিয়ে যায়। এখানে ওয়াঙ্গাসা নামক আরেকটি জাতির স্থাপনা পাওয়া গেছে, যারা আদিকাল থেকে কিলিমানজারো অঞ্চলে বসবাস করছে। ৪০০ বছর আগে এখানে ওয়াচাগা জাতির আগমন ঘটে। বহু বছরের যুদ্ধ, বিবাদের পর একসময় তারা চাগা জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ হয়। এখন পর্যন্ত তানজানিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চাগা জাতির নাম উচ্চারিত হয়। চাগা ভাষায় কিলিমা ও কিয়ারো- এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে কিলিমানজারো নামের উৎপত্তি । এর অর্থ আরোহণের অযোগ্য পাহাড়। আগ্নেয়গিরির ছাই, লাভা, শিলা এবং বরফের স্তূপ দেখে উপজাতিরা বিশ্বাস করত এই পাহাড় কোনোভাবেই আরোহণযোগ্য নয়। আবহাওয়া প্রায়ই চরমভাবাপন্ন হওয়ার কারণে বসবাস ও ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতো বলে উপজাতিরা বিভিন্ন পশু বলিদান এবং পূজা অর্চনার মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করার চেষ্টা করত। এই লোকজ বিশ্বাস এখনও বিদ্যমান। জার্মান উপনিবেশকালে এই জাতির সদস্যরা পশ্চিমা সংস্কৃতির স্পর্শে অনেকটাই নিজস্ব রীতি-ঐতিহ্য থেকে সরে আসে। তবে এখনও এরা নিজেদের চাগা হিসেবে পরিচয় দেয়। চাগা সমাজে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে কলা ও কফি। বহুকাল ধরে প্রাচীন বিনিময় প্রথা প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে এরা মুদ্রাভিত্তিক বাণিজ্য শুরু করেছে।
মোরল্যান্ড পাড়ি দিয়ে তৃতীয় দিন চলে আসলাম আল্পাইন ডেজার্ট এরিয়ায়। ৪৭৫০ মিটার উচ্চতায় কিবোহাটে বাতাসের তীব্রতা ও ঠান্ডায় ত্রাহি অবস্থা। এখানে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ধূসর মরুভূমির খোলা প্রান্তর বৃক্ষহীন বিরান মরুভূমিতে মুক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে উহুরু পর্বত চূড়া। পূর্বদিকে ১১ কিলোমিটার দূরে পাথুরে মাওয়েনজি পর্বত। রাংগাই এবং মারাঙ্গুর পথে যারা এসেছে তাদের সবার হাইক্যাম্প কিবোহাট। তাই এখানে অভিযাত্রীদের জটলা তুলনামূলক বেশি। বিকাল হলেই অভিযাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য গাইড-পোর্টাররা গানের আসর জমাত। নাচ-গানের মাধ্যমে অতি উচ্চতায় ট্রেকিংয়ের ক্লান্তি ভুলে যেতাম। ডিনারের পর মোদি জানাল আজকে রাতেই আমরা সামিটে যাব।
চারদিকে সাজসাজ রব উঠেছে। মধ্যরাতে হাইক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেখি চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে নক্ষত্ররা মিটিমিটি জ্বলছে। হেডল্যাম্পের আলোতে অভিযাত্রীরা ছুটছে আপন গন্তব্যে। গিলমান্স পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের দৃশ্য অবলোকন করছিলাম। এই সৌন্দর্যের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আর ২০০ মিটার ট্রেকিং করলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাব। গিলমান্স থেকে স্টেলা পয়েন্ট, গ্লেশিয়ার পেরিয়ে ১১ আগস্ট স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে ৫৮৯৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত কিলিমানজারোর সর্বোচ্চ পয়েন্ট উহুরু পর্বতের চূড়ায় পৌঁছলাম। রুকস্যাক থেকে লাল-সবুজ পতাকা হাতে ফটাফট ছবি আর ভিডিও ধারণ করে নিলাম।
কিলিমানজারো চূড়ার পাশে বরফের গ্লেশিয়ারের ছবি দেখে এই পর্বতে অভিযান করার পরিকল্পনা ছিল। অবশেষে সেই ইচ্ছের পূর্ণতা পেল। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে এই গ্লেশিয়ার দ্রুত গলছে। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস মতে, এই হারে গলন প্রক্রিয়া চালু থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে কিলিমানজারো বরফশূন্য ন্যাড়া পর্বতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। ফিরতি পথ ধরার সময় বারবার মনে হচ্ছিল এই পথে হয়তো কখনও আমার আসা হবে না। পৃথিবীর বহু স্থানেই এভাবে আমাদের সর্বশেষ পদচিহ্ন পড়ে গেছে।
আগামী প্রজন্মের অভিযাত্রীদের কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। এই পর্বতের বরফের স্তূপ আর কয়েক যুগ পরেই ইতিহাসের মলাটে বন্দি হয়ে যাবে। প্রাচ্য থেকে আফ্রিকান সাভানা অনেক দূরের দেশ। এই মহাদেশের বহু গল্পই আমাদের অজানা। কিলিমানজারোর দীর্ঘ পথের পরিক্রমায় অনেক গল্পে গাঁথুনি নিয়ে ফিরে এলাম। এই প্রান্তরের ১৫০ কিলোমিটার পথ হেঁটে হেঁটে বৈচিত্র্যময় দৃশ্য আর বুনোফুলের সৌন্দর্য দেখে পথের ক্লান্তি ভুলে গেছি। প্রকৃতি, মানুষ ও পরিবেশের এমন বৈচিত্র্যময় দৃশ্যে অবলোকনের জন্যই আমি গৃহত্যাগী হয়েছিলাম। সৌন্দর্যের মধ্যে একটা সুগভীর প্রশান্তি লুকিয়ে থাকে। আর এই প্রশান্তির আড়ালেই লুকিয়ে আছে বিষণ্নতা।