× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জেমস লিও ফার্গুসন

স্কটিশ রক্তধারার এক মুক্তিযোদ্ধা

এলিজা বিনতে এলাহি

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৩৯ পিএম

লোভাছড়া চা বাগানের মালিক ও স্বাধীনতাযুদ্ধের একমাত্র স্কটিশ বীর মুক্তিযোদ্ধা জেমস লিও ফার্গুসন। নানকা নামেই যার পরিচিতি	
ছবি : লেখক

লোভাছড়া চা বাগানের মালিক ও স্বাধীনতাযুদ্ধের একমাত্র স্কটিশ বীর মুক্তিযোদ্ধা জেমস লিও ফার্গুসন। নানকা নামেই যার পরিচিতি ছবি : লেখক

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। জন্ম এ দেশে হলেও পৈতৃক সূত্রে তিনি স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। সেই হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একমাত্র স্কটিশ মুক্তিযোদ্ধা তিনি। জেমস লিও ফার্গুসন তথা নানকা নামে পরিচিত মানুষটি বাস করেন সিলেটের লোভাছড়ায়। তার সঙ্গে সাক্ষাতের গল্প নিয়ে আয়োজন... 

সিলেটের লোভাছড়া চা বাগানে গিয়েছিলাম ২০২১ সালের অক্টোবরে। উদ্দেশ্য ছিল টি-প্লান্টার্স সমাধির খোঁজ করা। দুই বছর সিলেট বিভাগজুড়ে খুঁজে বেড়িয়েছি টি-প্লান্টার্সদের সমাধিভূমি। সিলেটের অন্যান্য অঞ্চলের মতো লোভাছড়ার দিকে পর্যটকের আনাগোনা কম। টি-প্লান্টার্স সমাধিভূমির খোঁজ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য বীরের সঙ্গে দেখা করাও ছিল আরেকটি উদ্দেশ্য।

তিনি আর কেউ নন, ‘দ্য গ্রেট নানকা’! আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের একমাত্র স্কটিশ বীর মুক্তিযোদ্ধা জেমস লিও ফার্গুসন, নানকা যার ডাকনাম। লোভাছড়া চা বাগানের মালিকও তিনি। জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত টানা ১৭ বছর কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।

খড়ের চালের বাংলোর সামনে জেমস লিও ফার্গুসনের সঙ্গে লেখক

জেমস লিও ফার্গুসন তথা নানকার সঙ্গে দেখা হওয়া এবং তার বংশধর কয়েকজন টি-প্লান্টার্সের সমাধিভূমির গল্প নিয়েই আজকের লেখা।

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় লোভাছড়া চা বাগান ভারত সীমান্তের একদম কাছাকাছি অবস্থিত। যাতায়াতের কয়েকটি পথ আছে, তবে খুব বেশি যাত্রীবান্ধব নয় পথগুলো। সবকিছু বিবেচনায় জলপথ নিরাপদ মনে হলো। 

সিলেটের মূল শহরের হোটেল থেকে খানিকটা সকালেই রওনা হলাম। বাসে যেতে হবে কানাইঘাট। দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। কানাইঘাট শহর থেকে নদী পার হয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে দুই দিন থেকে। আমাদের নৌকা সুরমা নদী, লোভাছড়া আর কুশিয়ারার তিন মোহনা থেকে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে লোভাছড়া নদীর পথ ধরল। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মুলাগুল হলো কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল। এ অঞ্চলের বুক চিড়ে বয়ে গেছে লোভাছড়া নদী। লোভাছড়ার জন্ম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ের চূড়ায়। বাংলাদেশে প্রবেশ করে কালের বিবর্তনে পরিসর ও গভীরতা বৃদ্ধি পেয়ে এখন বড় একটি নদীতে পরিণত হয়েছে।

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, দূর সীমান্তে মেঘে ঢেকে যাওয়া পাহাড়, লোভার শান্ত জল, চারদিকের নির্জনতা সব মিলিয়ে এলোমেলো এক সময়। ৪০ মিনিট পর নৌকা একটি ঘাটে ভিড়ল। নেমে মিনিট বিশেক হাঁটার পর লোভাছড়া বাগানের গেটে এসে দাঁড়ালাম।

নানাবিধ কারণে বাগানটি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। ছোট একটি টিলার ওপর বাগানের মালিক ও তার পরিবারের বাসস্থান। পাথুরে রাস্তা হেঁটে টিলার ওপরে যাওয়ার পর চোখের সামনে খড়ের চালের পুরোনো বাংলোটি দেখে চোখ ছানাবড়া। এরকম খড়ের চালের সাজানো বাড়ি দেখেছিলাম জাপানের নিগাতা শহরে, সেটি ছিল ২০০ বছরের পুরোনো। এরও বয়স কম নয়। খড়ের চালের বাংলোটির নির্মাণকাল ১৮৭৬! 

জুন ফার্গুসন

এ বাগানের বর্তমান মালিক, যার কথা আগেই বলেছি, জেমস লিও ফার্গুসন। তার জন্ম এ বাংলোতেই। ১ হাজার ৮৪০ একর আয়তনের এ বাগানের আশপাশের রাস্তা এখনও কাঁচা। তাই ১৯২৫ সালে একটি ঝুলন্ত লোহার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছিল, যা এখনও রয়েছে। এত সবের মাঝে আচমকা এসে উপস্থিত মুক্তা। মালিকের পালিত হাতি। বয়স ৪০, উচ্চতা ৮ ফুট। শুধু হাতি নয়, এ পরিবারের রয়েছে পাঁচটি ঘোড়াও।

লোভাছড়া বাগানে গিয়েছিলাম টি-প্লান্টার্স সমাধির খোঁজে। কত অজানা রহস্য আর বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বুঝতে পারিনি। লোভাছড়া বাগানের পারিবারিক সিমেট্রি থেকে জানতে পারলাম এ উপমহাদেশের প্রথম নারী টি-প্লান্টার জুন ফার্গুসনের সমাধি রয়েছে এখানে। তিনি ফার্গুসনের মা। এ তথ্য বোধ করি সিলেটের চা বাগানের সমাধির ইতিহাসে সংযোজিত নেই। কারণ সিলেটের টি-প্লান্টার্সের সমাধি নিয়ে বই লিখেছেন একমাত্র ব্রিটিশ লেখক জন রাদফোর্ড। তার বইতে এ তথ্য আমি পাইনি।

 জেমস আর্থার ফার্গুসন

বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম একজনের সঙ্গে। এমন সময় দীর্ঘকায় একজন সুপুরুষ এসে ভারী গলায় বললেন, How are you Eliza? Welcome! I am Ferguson, freedom fighter of the Bangladesh Liberation War. লিও ফার্গুসনের সঙ্গে দেখা হওয়াটা সৌভাগ্যের বিষয় বটে। তার দরাজ কণ্ঠ আর ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তিতে আমি অভিভূত হলাম। তার সঙ্গে আলাপ চলতে থাকে।

প্রথমেই জানালেন নিজের শরীরে প্রবহমান যোদ্ধার রক্তের গল্প। কারণ ফার্গুসনের নানার বাবা ডোনাল্ড ফার্গুসন অংশ নিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তার ছেলে অর্থাৎ লিও ফার্গুসনের নানা জেমস আর্থার ফার্গুসন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। তারই নাতি আমার সামনে উপবিষ্ট মানুষটি ১৯৭১ সালে অংশ নেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে একমাত্র স্কটিশ মুক্তিযোদ্ধা।

ফার্গুসন বলছিলেন, ‘মায়ের অনুপ্রেরণায়ই আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। ৪ নম্বর সেক্টরের হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন চিত্তরঞ্জন দত্ত।’ মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে হয় আরও অনেক আলাপ। সেসব গল্প হবে আরেক দিন।

জুন ফার্গুসনের সমাধি 


আটটি ভাষায় কথা বলতে পারা ফার্গুসন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পেরে এবং একমাত্র স্কটিশ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দারুণ গর্বিত। সমানভাবে গর্বিত তার পরিবার ও মা জুন ফার্গুসনকে নিয়েও। আগেই বলেছি, জুন ফার্গুসন উপমহাদেশের প্রথম নারী টি-প্লান্টার। এ ছাড়া তিনি কর্মসূত্রে ছিলেন লোভাছড়ার ম্যানেজার। তৎকালীন ভারত ও পাকিস্তানে তিনিই ছিলেন কোনো চা-বাগানের প্রথম নারী ব্যবস্থাপক। এ ছাড়া ফার্গুসনের নানা ভারতের ইসাবেলা চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। বংশপরম্পরায় ফার্গুসন এখন লোভাছড়া বাগানের মালিক।

এ অঞ্চলের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক। তাই তো ভালোবাসাবশত এ অঞ্চলের লোকের কাছে তিনি নানকা বলে পরিচিত।

লিও ফার্গুসনের সঙ্গে গল্প যেন শেষ হচ্ছিল না। দুই মহাদেশের সঙ্গে যার সম্পর্ক, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর শতবর্ষের বেশি সময় ধরে লালন করে চলা পারিবারিক ঐতিহ্যসহ আরও অনেক অনেক কিছু। তার পারিবারিক অনেক ঐতিহাসিক ছবির সংগ্রহ দেখিয়েছেন নিজ হাতে।

গোটা একটি দিন কাটিয়েছি নানকা ও তার পরিবারের সঙ্গে। সকালের খাবার থেকে শুরু করে বিকালের চা খেয়ে ফিরেছি লোভাছড়া থেকে। লিও ফার্গুসনের স্ত্রী ও সন্তানরা থাকেন লন্ডনে। সময় করে দেখতে যান তাদের। তারাও আসেন এখানে।

লোভাছড়ার বাংলোয় তিনি ছাড়াও বসবাস করেন তার দুই বোন জেসি ও ইরা ফার্গুসন এবং তার পরিবারের সদস্যরা। দারুণ সময় কেটেছে সবার সান্নিধ্যে। আপ্লুত হয়েছি অজানা এক অতিথি হিসেবে তাদের এত ভালোবাসা পেয়ে।

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তায় জিপ চালাতে দারুণ পারদর্শী লিও ফার্গুসন ওরফে নানকা। তার প্রমাণ পেলাম নিজে জিপ চালিয়ে কানাইঘাট অবধি পৌঁছে দেওয়ার সময়ই।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা