ফিরোজ আল সাবাহ
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৩৬ পিএম
সুন্দরবনের জামতলায় এক পাল হরিণের মুখোমুখি ছবি : লেখক
সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল, স্থানীয়দের কাছে যার পরিচিতি বাদাবন হিসেবে। যা পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্যময় প্রশস্ত বনভূমি ও প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির মধ্যে অন্যতম। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এই বনটিতে ২৯০ প্রজাতির পাখি, ১২০ প্রজাতির মাছ এবং ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের আবাসস্থল। বলাই বাহুল্য সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ডলফিন এবং লোনাপানির কুমিরের মতো বিপন্ন প্রজাতির বাড়িও বটে। সুন্দরবন শুধু বাঘ-কুমিরের মতো বৃহৎ প্রাণীকেই ধারণ করে না, সুন্দরবন অসংখ্য ছোট ছোট প্রাণীরও আশ্রয়স্থল। সুন্দরীগাছের নামানুসারে এই বনের নাম সুন্দরবন। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন।
সুন্দরবন-নির্ভর জনগোষ্ঠীর কাছে পূজিত এক নারীশক্তি বনবিবি। জেলে, বাওয়ালি আর মৌয়ালদের তিনি সুরক্ষার দেবী এই বিশ্বাস তাদের। এই সুরক্ষা বনের বাঘ এবং বাঘরূপী অপশক্তি ‘দক্ষিণ রায়’ বা ‘রায়মণির’ হাত থেকে। জল আর জঙ্গল মিলিয়ে সুন্দরবন। এর কোল ঘেঁষে বাস করে পরিশ্রমী মানুষ। তারা এই বনবিবিকে অতি আপনজন মনে করে বিপদে-আপদে স্মরণ করে। ভ্রমণপিপাসু, প্রকৃতিপ্রেমী ও ফটোগ্রাফারদের জন্য বাদাবন বা সুন্দরবন হলো এক আরাধ্য জায়গা। বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী হলে তো আর কথাই নেই। কী নেই সুন্দরবনে। বাঘ থেকে শুরু করে কুমির, হরিণ, বানর, সাপ, বিভিন্ন রকমের পাখি। বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্যারা পাখির আবাস এই সুন্দরবনেই। যার ইংরেজি নাম masked finfoot। মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া ছাড়া বাংলাদেশে এই পাখি সুন্দরবনেই শুধু টিকে আছে। যদিও তাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। মানুষের অসচেতনতা, আবাসস্থল ধ্বংস ও শিকারের ফলে এই সুন্দর পাখি এখন বিলুপ্তির পথে। এ ছাড়াও সুন্দরবন ছোট-বড় আরও নানা প্রাণীর আবাসস্থল। একজন বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রীকে আকর্ষণ করার জন্য আর কী চাই। আবার সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে দেখা গেছে আরেক দুর্লভ মাছ। নাম চিড়িং।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সুন্দরবন ভ্রমণের পরিকল্পনা করে আমাকে দলে ভেড়ালেন আলোকচিত্রী ইমদাদুল ইসলাম বিটু ভাই। আমিও সেই পঞ্চগড় থেকে রওনা দিলাম একদম দক্ষিণে, সুন্দরবনে।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পঞ্চগড় থেকে পৌঁছালাম সুন্দরবন। এমবি মাওয়ালির পিঠে চেপে প্রথম দিনটি প্রায় যাত্রা পথেই শেষ হয়ে গেল। যেতে যেতে ডলফিনদের সঙ্গে দেখা হলো অনেকবার। তাদের সঙ্গে ক্যামেরা ও ধৈর্যের পরীক্ষাও হয়ে গেল খানিকটা ।গল্প আড্ডায় শেষ বিকালে গন্তব্যে পৌঁছে উদরপূর্তি করে ছোট নৌকায় করে একটা খালে রওনা দিলাম।
নির্মেঘ নীলাকাশের নিচে সুন্দরবনের এক খাল দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নৌকা। ভাটা পড়ে এসেছে, শেষ বিকালে চনমনে সূর্যের আলো আসছে খালের উল্টোদিক থেকে। সুন্দরী আর গেওয়ার বনে আলো-ছায়ার খেলা। সুনসান নীরবতায় পাখিদের কলকাকলি ও নানা প্রাণীর আওয়াজ চারদিকে। ক্যামেরা হাতে আমাদের সবার সন্তর্পণ দৃষ্টি খালের দুপাড়ের কিনারে। কখন কী সামনে চলে আসবে তার ঠিক নেই!
আমাদের রাজকীয় জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রাজার বাসায় যে চলে এসেছি সেটা মোটেও ভুলিনি। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে যেকোনো সময় দেখা হয়ে যেতে পারে রাজার। হেতালের বনে হয়তো আয়েশি ভঙ্গিমায় বিশ্রাম নিচ্ছে, গোলপাতার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল আগুনের ঝলক পার হয়ে গেল বা দেখা গেল খাল পার হচ্ছে রাজকীয়ভাবে। এত সহজে ব্যাঘ্রমুহূর্ত ধরা দেবে সেটার আশা করিনি। উনি যে আমাদের এতক্ষণে দেখে নাই, তা বলতে পারি না।
সব ভাবতে ভাবতে আমাদের নৌকার সারেংভাই চাপা গলায় দুইবার বললেন- ‘সাপ সাপ’। টের পেলাম পেছনে ইকবাল ভাই নড়েচড়ে বসলেন। খালের এক পাড়ে একটা গাছে আঙুল নির্দেশ করে দেখিয়ে দিল। কাছে নৌকা ভিড়িয়ে আমরা সাপ খুঁজতে লাগলাম। ছয় জোড়া চোখ দিয়ে সাপের অস্তিত্ব টের পেতে আমাদের কয়েক মিনিট লেগে গেল। অথচ সাপ আমাদের ঠিক মাথার ওপরেই আছে। সবুজ একটা সাপের গায়ের খানিকটা দেখা গেল। কী অদ্ভুতভাবে গাছের সবুজ পাতার সঙ্গে মিশে আছে। বন্যজীবনে ক্যামোফ্লেজের এমন উৎকৃষ্ট উদাহরণ খুব কম দেখেছি।
এটি গ্রিন পিট ভাইপার না হলেও গ্রিন ক্যাট স্নেক, সৌন্দর্যের দিক থেকে মোটেও কম নয়। বিশেষ করে তার অদ্ভুত চোখে যেন কী অপার রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রথম দিনে সাপ ও কিছু ছোট পাখি ছাড়া কিছু দেখতে পেলাম না। যদিও সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য আমাদের চোখ ও মন দুই-ই ধাঁধিয়ে দিয়েছে।
সুন্দরবনে একটি অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আমরা লঞ্চে পৌঁছালাম। দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে যেতে পুরো আকাশ ভর্তি তারকারাজি জ্বলজ্বল করতে লাগল। ইচ্ছে হলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ছবি তুলতে। কিন্তু দোদুল্যমান নৌকা থেকে লং এক্সপোজার করা দুঃসাহস হলো না। আমরা রাতের খাওয়া সেরে লঞ্চের ডেকে খানিক আড্ডা দিয়ে দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। বাঘ দেখার স্বপ্ন।
এর পরের দিন গন্তব্য পক্ষীর খাল। এ খালে অনেক পাখি পাওয়া যাওয়া যায়। এজন্যই বোধহয় নাম হয়েছে পক্ষীর খাল। পক্ষীর খালে ঢুকতেই দেখা পাওয়া গেল খয়রাপাখ মাছরাঙার। সুন্দরবন যেন মাছরাঙার শহর, আমাদের দেশের ১২ প্রজাতির মাছরাঙার প্রায় বেশিরভাগেরই দেখা মিলবে সুন্দরবনে।
মাছরাঙার ছবি তুলে আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতেই দেখা গুইসাপের। ভরা জোয়ারে খাল পার হচ্ছে। জোয়ারের সময় হওয়ায় খালের আশপাশে তেমন পশুপাখি নেই। সবাই বনের ভেতরে। কয়েকটা হরিণের দেখা পাওয়া গেল। অতি সন্তর্পণে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদেরও চোখ হেতাল বনের আনাচা-কানাচে। কোথায় না জানি লুকিয়ে আছে বনের রাজা টাইগার।মনে পড়ে গেল জন ভেইলান্টের কথা- ‘আপনি বাঘকে দেখার আগে বাঘ আপনাকে শতবার দেখবে।’ জোয়ার নেমে আসতেই নানা পাখি দেখলাম আমরা। খাল ধরে চলতে চলতে হঠাৎ করে আমাদের গাইড কনক ভাই আবিষ্কার করলেন খালের পাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ। পায়ের ছাপ দেখে মনে হলো উনি হেঁটে গেছে কিছুক্ষণ আগে।
আমাদের এর পরদিন শুরু হলো বাঘের ডাক শোনার। আমি ও ভ্রমণসঙ্গী ইকবাল বাঘের ডাক শুনলাম খুব কাছেই। আজ আমাদের গন্তব্য জামতলা। জামতলার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে সুন্দরবনের খানিকটা দেখা যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে বাঘের দেখা পাওয়া যেতে পারে। বাঘের দেখা না পাওয়া গেলেও হরিণের পাল দেখা যাবে। হলোও তাই। এক পাল হরিণ দৌড়ে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। এ না হলে সুন্দরবন। পথ চলতে চলতে দেখলাম এক জায়গায় কিছু হরিণের শিং ও আরও কিছু উচ্ছিষ্টাংশ। আমাদের গাইড হাতে নিয়ে দেখে বললেন বাঘে খাওয়া। আমাদের উত্তেজনাই বেড়ে গেল এই কথা শুনে। মনে মনে কল্পনা করছিলাম সুন্দরবনে হরিণ শিকার করে খাচ্ছে টাইগার। এজন্য বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রীর আরাধ্য মুহূর্ত বটে। সবাই এদিক-সেদিক উঁকি দেওয়া হরিণের পালের ছবি তুলতে লাগলাম। সুন্দরবন নিয়ে অভিজ্ঞ এমদাদুল ইসলাম বিটু ভাইয়ের কাছ থেকে গল্প শুনতে শুনতে আমরা পৌঁছে গেলাম জামতলা সি বিচে।
সেখানে পৌঁছেই দেখা গেল ইয়া বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে আছে। সিডরের স্মৃতিচিহ্ন। বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় থেকে সুন্দরবন আমাদের কীভাবে রক্ষা করে নিজ চোখে দেখলাম। বিচের মধ্যে থরে থরে সাজানো সুন্দরীগাছের ফল। জোয়ারে ভেসে আবার ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে এসেছে সৈকতে। অনেকগুলো থেকে গাছও জন্মেছে। একটা-দুটো গাছ থেকে আবার গড়ে উঠবে সুন্দরীগাছ। কী অসাধারণভাবে প্রকৃতি নিজেকে সামলে নিচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে দেখা বানর বাহিনীর। প্রায় সবার কোলেই বাচ্চা। আমাদের থোড়াই কেয়ার করে। এদিক-সেদিক লম্ফঝম্ফ করে তাদের সময় যায়। এখানেই দেখা পাওয়া গেল সুন্দর পাখি বনমালীর। নীল রঙের ছোট্ট পাখি কয়েকটি গাছে উল্টো ঝুলে খাবার সন্ধানে ব্যস্ত।
গাছের ডালে ডালে একঝাঁক শ্বেতাক্ষীও খাবার সন্ধানে ব্যস্ত। ফেরার পথে আমরা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে শেষ বিকাল কাটালাম। বিস্তীর্ণ খোলার মাঠে হরিণদের সঙ্গে নজর রাখলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি কোথাও থেকে এসে হামলে পড়বে টাইগার। কিন্তু না, তা হলো না। আলো নেমে আসাতে আমরাও ফিরতি পথ ধরলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম আজ যে করে হোক আকাশ গঙ্গার ছবি তুলব। রাতে সুন্দরবনে নামা নিষেধ। আমাদের দলনেতা এমদাদুল ভাইকে বলতেই বললেন- সুন্দরবনে নামা যাবে না রাতে। ফারুক ভাই মিলে বুদ্ধি বের করলাম নৌকা জেটিতে ভিরিয়ে সেখান থেকে ছবি তোলার। অবশেষে তাই হলো। ঘণ্টাখানেক ধরে চলল আমাদের অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি। রাতের সুন্দরবনও অনিন্দ্য সুন্দর যার কোনো তুলনা নেই।
এর পরদিন আমাদের গন্তব্য ডিমের চর। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের মহাবিপন্ন পাখি মদনটাক দেখা। অর্ধেক বেলা যাত্রা করে আমরা পৌঁছালাম ডিমের চর। কিন্তু বিধিবাম দেখা পাওয়া গেল না মহাবিপন্ন মদনটাক পাখির। কিছু পরিযায়ী পাখির দেখা পেলাম। পেলাম বাবুইয়ের দেখা। মোটা হাঁটুপাখিও দেখলাম।
এখন ফেরার পালা। এবার উদ্দেশ্য বিরল চিড়িংমাছ দেখা। গন্তব্য করমজল। এর মধ্যে নামল বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নামলাম করমজলে। তখন ভাটার সময়। হাঁটা শুরু করলাম ট্রেইল দিয়ে, চোখ খুঁজছে লাল মাছরাঙা। এখানেও বিধিবাম দেখা পেলাম না লাল মাছরাঙার। কিন্তু দেখা হয়ে গেল দুর্লভ চিড়িংমাছের। ইকবাল ভাই প্রথম খুঁজে বের করলেন অনিন্দ্য সুন্দর এক জোড়া চিড়িংমাছ। ভাটার কাদায় লাফাচ্ছে। অনেকক্ষণ ছবি তোলা ও পর্যবেক্ষণের পর মনে হলো পুরুষ ও স্ত্রী চিড়িংমাছ। পুরুষ মাছটি স্ত্রী মাছের মন জয় করার জন্য বারবার রঙ বদল করছে। কী অসাধারণ তাদের রূপ।
নীলাভ আলোকচ্ছটায় পরিপূর্ণ এই মাছটির পিঠে রয়েছে উজ্জ্বল লালবর্ণের পাখনা, যা অন্য প্রজাতি থেকে একে আলাদা করেছে। এর ইংরেজি নাম Asian Dwarf Mudskipper। এই মাছ দেখতে অনেকটা ব্যাঙ্গাচির মতো। শরীরের আকৃতি অনেকটা টর্পেডোর মতো। এই উভচর মাছ বাতাস থেকে শ্বাস নিতে পারে ও দীর্ঘ সময় পানির বাইরে থাকতে পারে। অনন্য জীবনযাত্রায় অভিযোজিত এই মাছটি শক্তিশালী পাখার সাহায্যে মাটিতে হাঁটতে পারে। এই মাছ বেশিক্ষণ পানিতে থাকলে মারা যায়, ফলে বিশেষায়িত ফুলকার সাহায্যে বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে তারা।
পানির বাইরে শ্বাসমূলের ডগায়, গাছে বিশ্রাম নেয়। বর্ষাকাল এই মাছের প্রজনন সময়। সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে এই মাছ উজ্জ্বল রঙ ধারণ করতে পারে। আবার বিপদের সময়ে উজ্জ্বল নীল রঙ নিমিষেই মেটে রঙে বদলে যায়। এর মধ্যে আবার নামল বৃষ্টি। আমরা কোনোমতে ক্যামেরা বাঁচিয়ে করমজল টাওয়ারে উঠে পড়লাম। সেখানে থেকে বৃষ্টিস্নাত অপরূপ সুন্দরবনের দেখা পেলাম। দেখা গেল অনেক পাখিও।
এরপর আমাদের বিদায়ের পালা। রওনা দিতে হবে খুলনার দিকে। এই জীববৈচিত্র্যে ভরা জাদুকরী বনবিবির বাদাবন থেকে কোনোভাবেই বের হয়ে আবার যান্ত্রিক জীবনে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না।