ইমদাদুল হক
প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:১১ পিএম
আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:১৬ পিএম
সাইবার অপরাধে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন। ছবি- সংগৃহীত
পৃথিবীর পেটে জন্ম হয়েছে আরেকটা পৃথিবীর। ভার্চুয়াল সেই পৃথিবীতে এখন আমাদের নিত্য বসবাস। এ নেটদুনিয়ার আকর্ষণ যেন একটু বেশিই। তাই হয়তো ফেসবুকে পরিচয়, ইউটিউবে গোপন ভিডিও প্রকাশ, অনলাইন জুয়ায় সর্বস্বান্ত, স্ক্যামের শিকার হয়ে টাকা খোয়ানো, আইডি হ্যাক, আঙুলের ছাপ বিক্রির মতো ঘটনা দিন দিন বাড়ছেই।
ঘটনা-১
অনলাইনে টু-লেট গ্রুপে বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন কবির হোসেন। কম টাকায় সব ধরনের সুযোগসুবিধাসহ বাসা ভাড়া পাওয়ায় দুই পক্ষেই কথা এগোয়। একপর্যায়ে পোস্টদাতা কয়েকজন আগ্রহীর কথা বলে কবিরের কাছে বাসা ভাড়ার ব্যাপারে দুই মাসের অ্যাডভান্স দাবি করে বলেন, ‘বাসা নিতে হলে আপনাকে অ্যাডভ্যান্স করতে হবে।’ সব শর্ত মিলে যাওয়ায় কবিরও সামনাসামনি বাসা না দেখে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাকে টাকা পাঠিয়ে দেন। দুই দিন পর পোস্টদাতার দেওয়া ঠিকানামতো বাসা দেখতে গিয়ে আসলে সেখানে কোনো বাসার খোঁজ পাননি কবির। পোস্টদাতার মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ। এভাবেই অনলাইনে বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন তিনি।
ঘটনা-২
ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে চুমকির বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের কাছে একাধিক টেক্সট পাঠায় হ্যাকার। সাহায্যের নামে ঋণ চায়। সঙ্গে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট নম্বর পাঠায়। এরপর জানা গেল, চুমকি সেই টাকা চাননি। এরপর মেইলে একটি লিঙ্ক আসে। বলা হয়, মোবাইলে কাজ করলে দিনে ২ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। এজন্য নিবন্ধন করতে হবে লিঙ্কে ক্লিক করে। ক্লিক করা মাত্রই নিয়ে যাওয়া হয় একটি পর্নোসাইটে!
ঘটনা-৩
দক্ষতা বৃদ্ধির ট্রেনিং দিতে এসএমএস করে একটি লিঙ্ক দেওয়া হয়। বলা হয় ফ্রি ট্রেনিং করতে নাম-ঠিকানা নিবন্ধন করুন। নিবন্ধন করার পর ইমোয় বার্তা আসে বন্ধুত্বের। এরপর কীভাবে যেন ইমোর পাসওয়ার্ডটাও কবজা করে নেয় হ্যাকার।
ঘটনা-৪
ফেসবুকে প্রেম। বুঝতে পেরেই ব্রেকআপে যান সায়ান। এরপর বন্ধুদের কাছে ছড়িয়ে যায় ব্যক্তিগত ছবি! অনৈতিক প্রস্তাব আসে। শুরু হয় বুলিং।
ঘটনা-৫
কলেজের প্রিন্সিপালসহ সবাই ভিডিওটি দেখলেন এবং শিক্ষক ও ছাত্রীকে বহিষ্কার করা হলো। ছাত্রীটি কোনোভাবে বোঝাতে পারলেন এ কাজটি কে করেছে। সে রাতেই ওই ছেলেটিকে ফোন করে ল্যাপটপে বসতে বলল এবং বলল আমি জানি, এ কাজটি তুমি করেছ। এবার তুমি এর শেষটাও দেখে নাও। তখন ছেলেটি দেখল মেয়েটি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁসিতে ঝুলছেন!
বিশ্বজুড়েই কম্পিউটার, মোবাইল বা অন্য যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস, সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট বা ই-কমার্স ওয়েবসাইটের তথ্য বা ক্রেডিট কার্ডের নম্বর হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। বিভিন্ন পর্নোসাইটে ভিজিটকারী ব্যক্তির ডিভাইস ক্ষতিকর কম্পিউটার ভাইরাস দিয়ে যেকোনো সময় হ্যাকাররা হ্যাক করে ফেলে। মাদক থেকে শুরু করে নারী-শিশু পাচার সবই এখন ইন্টারনেট প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হচ্ছে।
হয়রানি : কেউ যদি আপনার ছবি দিয়ে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আইডি খোলে, আপনার ছবি ব্যবহার করে কোনো পোস্ট প্রদান করে, আপনার ছবির সঙ্গে অন্য ছবি জোড়া লাগিয়ে বিতর্কিত কিছু বানোয়াট খবর প্রকাশ করে, আপনার ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ করে, পাশাপাশি তা ঠেকানোর জন্য বিনিময়ে যদি আপনার কাছে অর্থ দাবি করে সে ক্ষেত্রে আপনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এ ছাড়া বিনা অনুমতিতে কারও ব্যক্তিগত তথ্য, অডিও বা ভিডিও পাবলিকলি প্রচার করলে সেটাও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনে দণ্ডনীয়। কোনো ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া কোনো মানহানিকর কোনো কিছুই অনলাইনে প্রকাশ করা অপরাধ।
হ্যাকিং : অনলাইনে ডাটা বা তথ্য অনুমতিবিহীন চুরি, ধ্বংস বা ক্ষতিসাধনের প্রক্রিয়াকেই বলা হয় হ্যাকিং। এতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি ও প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। এ ছাড়া কেউ যদি দূর থেকে কিংবা গোপনে আপনার সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা অনলাইন আইডিতে অনধিকার প্রবেশ বা হ্যাক করে অথবা আপনার ব্যক্তিগত ছবি আর কথোপকথন অনলাইনে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, পাশাপাশি তা ঠেকানোর জন্য বিনিময়ে আপনার কাছে অর্থ দাবি করে সে ক্ষেত্রেও পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের সহায়তা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বুলিং : কেউ যদি অনলাইনে আপনাকে অহেতুক জ্বালাতন, সম্মানহানির চেষ্টা অথবা যেকোনো উপায়েই উত্ত্যক্ত করে তাহলে তা সাইবার বুলিং হিসেবে স্বীকৃত। সে ক্ষেত্রে আপনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
সাইবার অপরাধের রকমফের
প্রতিকার
প্রতিটি সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে থানায় এজাহারের মাধ্যমে মামলা অথবা সরাসরি সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রমাণগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ করে সেগুলো প্রিন্ট করে রাখতে হবে। স্ক্রিন ভিডিও এবং লিঙ্কসহ প্রমাণ জোগাড় করে থানায় মামলা করতে হবে। আর কোনো কারণে যদি থানা মামলা না নেয় তখন আইনজীবীর সহায়তা নিয়ে সরাসরি সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে।
নেটদুনিয়ায় বসবাসে ভিসা হিসেবে দরকার হয় ইন্টারনেট এবং তাতে যুক্ত হওয়ার জন্য একটি ডিভাইস। পাসপোর্টটা সেখানে খুবই দুর্বল। এ দুনিয়ায় ব্যক্তির পরিচয় যাচাইয়ের পদ্ধতিটা টেকসই নয়। আছে মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার সুযোগ। সেই সুযোগে বয়সের তুলনায় জ্যামিতিক হারে এ দুনিয়ায় বাড়ছে অপরাধের মাত্রা।
সিসিএ ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান প্রতিবেদনের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ডিজিটাল অবকাঠামো ও প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সাইবার হুমকি এবং আক্রমণের জন্য ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সাইবার দুর্বৃত্তরা দেশের ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি, ব্যবসা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ করে বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে, যার ফলে আর্থিক ক্ষতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার ওপর হুমকি তৈরি হতে পারে।
তবে আশার কথা, সাইবার অপরাধের অবাধ সুযোগ থাকলেও ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট এক ঘষায় মুছে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। তাই সাইবার অপরাধ বাড়লেও তা শনাক্ত করা সম্ভব। তবে ফাঁদে পড়ার আগে সচেতন হতে হবে নিজেকেও। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তথ্য পাবলিকলি প্রচার না করা, আইডির নিরাপত্তায় টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেসি ব্যবহার, ফিসিং থেকে এড়াতে অপরিচিত কোনো লিঙ্কে ক্লিক করা ও পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার থেকে বিরত থাকলে ৭৫ শতাংশ নিরাপদ থাকা সম্ভব।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিবাংলাটেক. নিউজ