ইসতিয়াক আহমেদ
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৩৪ পিএম
ইতিহাস ও ঐতিহ্যঘেরা মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর
আবার বেরিয়ে পড়েছি আমরা। এ যাত্রায় আমরা ছুটছি ইতিহাস ও ঐতিহ্যঘেরা জেলা মুন্সীগঞ্জের পথে। ঢাকা থেকে গিয়ে এক বেলা ঘুরে আসার মতো জায়গা এই মুন্সীগঞ্জ। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈতৃক বসতবাড়ি ঘিরে জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘর কমপ্লেক্সটিকে সাজানো হয়েছে।
প্রায় ৩০ একর আয়তনের এই বাড়িতে বিভিন্ন পশুপাখির ম্যুরাল, কৃত্রিম পাহাড়-ঝরনা, শান বাঁধানো পুকুরঘাট এবং দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য ত্রিকোনাকৃতির ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘরে জগদীশ চন্দ্র বসুর পোর্ট্রেট, বিভিন্ন গবেষণাপত্র, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলপ্রাপ্তিতে লেখা চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঠানো চিঠি এবং ১৭টি দুর্লভ ছবি প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এসেছি যখন, তখন বিখ্যাত ভাগ্যকুলের মিষ্টি না খেলে কি চলে। তাই পথ ধরলাম ভাগ্যকুল বাজারের।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল বাজার সুস্বাদু মিষ্টি ও ঘোলের জন্য সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে সুপরিচিত। আদি ও আসল স্বাদের সন্দেশ, ছানা, চমচমের মতো বিভিন্ন মিষ্টান্ন খেতে চাইলে ভাগ্যকুল এক স্বর্গীয় স্থান। রকমারি মিষ্টির বাহার নিয়ে ভাগ্যকুলের বিভিন্ন মিষ্টান্নভান্ডারগুলো যেন আপ্যায়নের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। এদের মধ্যে গোবিন্দ মিষ্টান্নভান্ডার এবং চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্নভান্ডার অতুলনীয় স্বাদের মিষ্টি ও ঘোলের জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। ঘোল খেয়েই ছুটলাম ভাগ্যকুল জমিদারবাড়ি, যা কি না বর্তমানে বিক্রমপুর জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।
জমিদার যদুনাথ রায় আনুমানিক ১৯০০ সালে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল গ্রামে ভাগ্যকুল জমিদারবাড়ি নির্মাণ করেন। যদুনাথ রায় মূলত ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি বরিশাল থেকে লবণ, সুপারি, শাড়ি ইত্যাদি পণ্য আমদানি করে মুর্শিদাবাদে রপ্তানি করতেন। ভবনের সামনে রয়েছে ৮টি থাম, যা মূলত গ্রিক স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। মূল ভবনের ভেতরের দেয়ালে ময়ূর, সাপ ও বিভিন্ন ফুল-পাখির নকশা অঙ্কিত রয়েছে। বাড়ির সব জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে মূল ভবন আর তার মাঝখানে উঠোনের অবস্থান। বাড়ির একতলা থেকে দোতলায় চলাচলের জন্য আছে একটি কাঠের সিঁড়ি। যদুনাথ সাহা তাঁর ৫ ছেলেমেয়ের জন্য পৃথক পৃথক বাড়ি নির্মাণ করে দেন। বাড়িগুলো স্থানীয় মানুষের কাছে কোকিলপেয়ারি জমিদারবাড়ি, উকিল বাড়ি, জজ বাড়ি এবং ভাগ্যকুল জমিদারবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। জমিদার যদুনাথ রায়ের এ বাড়ির স্মৃতি রক্ষার্থে প্রায় সাড়ে ১৩ একর জায়গাজুড়ে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও সরকারি অর্থায়নে ২০১৪ সালে নির্মাণ করা হয়েছে জাদুঘর, গেস্টহাউস, থিমপার্ক।
তিনতলা ভবনের এ জাদুঘরে প্রবেশ করতেই দুই পাশে দুটি বড় মাটির পাতিলের দেখা পাবেন। নিচতলার বাম পাশের গ্যালারিটি যদুনাথ রায়ের নামে। এ গ্যালারিতে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, রাঘুরামপুর, নাটেশ্বরসহ বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া পোড়ামাটির নল, মাটির পাত্র, পোড়ামাটির খেলনাসহ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। নিচতলার ডান পাশের গ্যালারিটি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে। এ গ্যালারিতে আছে বিক্রমপুরের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার ছবিসহ বিভিন্ন নিদর্শন।দ্বিতীয়তলার বাম পাশের মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি, ইতিহাস, দলিল, বই ও বিভিন্ন নমুনা। আর ডান পাশের গ্যালারিতে আছে বিক্রমপুরে জন্ম নেওয়া মনীষীদের জীবন ও কর্মের বৃত্তান্ত।
আরও আছে কাগজ আবিষ্কারের আগে প্রাচীন আমলে যে ভূর্জ গাছের বাকলে লেখা হতো সেই ভূর্জ গাছের বাকল, তালপাতায় লেখা পুঁথি, কাঠের সিন্দুক, আদি আমলের মুদ্রা, তাঁতের চরকা, পোড়ামাটির মূর্তি, সিরামিকের থালাসহ প্রাচীন আমলে স্থানীয় মানুষদের ব্যবহার্য বিভিন্ন নিদর্শন। বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের বাকি ছয় দিন জাদুঘরটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার গোলাপ শাহ মাজারের কাছ থেকে ঢাকা-দোহার রুটে চলাচলকারী বাসে চড়ে রাড়িখাল তিন দোকানের সামনে নেমে রিকশা ভাড়া করে জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স যাওয়া যায়, সেখান থেকে রিকশা বা অটোতে সহজেই যেতে পারবেন ভাগ্যকুল বাজার ও ভাগ্যকুল জমিদারবাড়ি।