সিরাজুল ইসলাম আবেদ
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৩ ১১:৪৪ এএম
ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ কর্মসূচিতে ফটোসেশনে স্বেচ্ছাসেবীরা।
আমাদের গন্তব্য ছিল সেন্টমার্টিন দ্বীপ। ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ বাধ্য করে কক্সবাজার যেতে। সাগরের লঘুচাপ যে এত দ্রুত নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ঘূণিঝড়ে রূপ নেবে, তা ছিল আমাদের ধারণারও বাইরে। ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজক ‘কেওক্রাডং বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে আমাদের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা থেকে ১৬ নভেম্বর রাতে। প্রায় ৪০ জনের টিমের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আয়োজকদের সঙ্গে আমরা কিছু পেশাজীবীও যুক্ত হয়ে যাই। উদ্দেশ্য সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করা। কেওক্রাডং বাংলাদেশ ২০০৫ সাল থেকে কাজটি করে আসছে।
পথমাঝে খবর এলো, বঙ্গোপসাগরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের নৌ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের নির্ধারিত জাহাজটিও চলবে না। দলনেতা মুনতাসির মামুনের সিদ্ধান্তে রাত সাড়ে ৪টায় আমরা পৌঁছালাম কক্সবাজার। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝোড়ো বাতাস, বৃষ্টির মধ্যেই ১৭ ও ১৮ নভেম্বর কক্সবাজারের ইনানী ও লাবণী বিচ থেকে সংগ্রহ করা হলো বস্তা বস্তা প্লাস্টিক বর্জ্য। তরুণ্যে উজ্বল সবুজ স্বেচ্ছাসেবকরা উৎসব আমেজে সৈকত থেকে কুড়িয়ে আনল বস্তা-বস্তা প্লাস্টিক বর্জ্য। সিগারেটের ফিল্টার, ছোট চামচ, স্ট্র, পানি বা জুসের বোতল, বিভিন্ন রকম খাবারের প্যাকেট, প্লাস্টিক পাইপ থেকে শুরু করে একান্ত ব্যক্তিগত ব্যবহার্য বস্তু- কী নেই! বস্তায় ভরে সেগুলো নিয়ে আসা হলো হোটেল প্রাঙ্গণে। প্রকার ভেদে সটিং করে আলাদা করা হলো। সে এক কর্মযজ্ঞ।
বর্জ্য কুড়ানোর সময়, লাবণী সৈকত থেকে সুগন্ধা সৈকতের দিকে একটু এগোতেই দেখা গেল, একটি ভবণের সংস্কারকাজ চলছে। ভবণের সব বর্জ্য ফেলার জন্য তারা পেছনের সৈকতকেই বেছে নিয়েছে। ইট-সিমেন্টের সঙ্গে ফেলা হচ্ছিল, পিভিসি বোর্ড, পাইপ, এয়ারকুলারের পাইপলাইনের প্রোটেকশন কভার ইত্যাদি। শ্রমিকরা প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলছেন অন্যদিকে সঙ্গে থাকা মোজহারুল হক মঞ্জু ভাই রাগে গজগজ করতে করতে সেসব কুড়িয়ে বস্তায় ভরছিলেন। সেখানকার সব প্লাস্টিক বর্জ্য বস্তায় ভরে ফেরার পথে স্মৃতিচারণা শুরু করলেন, ১৯৭৭ সালে প্রথম দেখা কক্সবাজার। ‘তখন বিচ ছিল আরও উত্তরে। পাহাড়ের নিচ থেকে ছির সাগর। এসব বিল্ডিং কিছুই ছিল না। চারদিকে নীরবতা ভাঙত সাগরের ঢেউ।’ কথা বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
দীর্ঘশ্বাস না ফেলে আর উপাই কী? যখন আমাদের হাতে এসে প্রতিনিয়ত জমা হয় এই প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে ভয়াবহ সব পরিসংখ্যান। আমাদের আন্তঃসীমান্ত নদীপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণ প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে তা নিয়ে গবেষণা করেছে একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ‘দ্য ট্র্যাজিক টেলস অব আওয়ার রিভারস : প্রসপেক্টস টু প্রবলেম’ শিরোনামে ওই গবেষণায় তারা দেখেছেন, দেশের ১৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ৩৪৫ টন একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে এসে পড়ছে। সেই হিসেবে বছরে প্রায় ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৭৯ টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির এক সূত্রে জানা যায়, ১৯৫০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির আরেক প্রতিবেদন বলছে ১৯৫০ সালে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়, যা ২০১৫ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৪৮ মিলিয়ন টন। আর্থডের সূত্রমতে পৃথিবীর জনসংখ্যার মোট ওজনের সমান প্লাস্টিক প্রতিবছর উৎপাদিত হয়।
১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় কেওক্রাডংয়ের আয়োজকরা প্রজেক্টরে দেখাচ্ছিলেন, সাগর উপকূলে এখন পর্যন্ত তারা কী ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য পেয়েছেন। সেখানে প্লাস্টিকের বোতল রয়েছে, রয়েছে চিপসসহ বিভিন্ন খাবারের প্যাকেট। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে সিগারেটের ফিল্টার। প্রথম দিন যা আমাদের চোখেই পড়েনি! পরদিন সৈকতে নেমে অবশ্য ভালোভাবেই ধাক্কা খেতে হয়েছে। সাগরের বালুর মধ্যে এত ফিল্টার লুকিয়ে আছে! অথচ আমরা লক্ষ্যই করিনি। তাহলে উপায় কী?
মুস্তাফিজ মামুন বলছিলেন সচেতনতার কথা। একমাত্র সচেতনতাই পারে প্লাস্টিকের এই মৃত্যুফাঁদ থেকে আমাদের বাঁচাতে। বাংলাদেশই প্রথম আইনগতভাবে পলিথিন নিষিদ্ধ করে। প্লাস্টিক দূষণ রোধে দশ বছর মেয়াদি এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৯২টি মামলা দায়ের হয়েছে। এত কিছুর পরও কমানো যাচ্ছে না প্লাস্টিক দূষণ। আর তাই, কী পরিমাণ প্লাস্টিক সাগর সৈকত থেকে তোলা হলো তার চেয়ে এখন জরুরি আমরা কতজনকে সচেতন করতে পারলাম সেটা। দৈনন্দিন কাজের ভেতরে এককালীন প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বর্জন, নিদেনপক্ষে যত্রতত্র না ফেলে সেটাকে সঠিক স্থানে ফেলার অভ্যাস করাতে পারাটাই জরুরি।
মুনতাসির বলছিলেন, ‘আমরা আসলে কাউকে পরিবর্তন করতে পারি না যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ নিজে থেকে নিজের মধ্যে এই পরিবর্তন না নিয়ে আসতে চায়। আমরা আশা করি সবাই হয়তো করে। কিন্তু জোর গলায় কি বলতে পারব? না পারব না। কিন্তু আমি নিশ্চিত যারা একবারের জন্যও এই কাজ করেছেন তারা হয়তো সারা জীবন মনে রাখবেন ফেলে দেওয়া কোনো বর্জ্যকে তুলে নিয়ে আসাটা কতটা শক্ত।
এই কাজ যে আগে হতো না তা নয়। যেমন রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্য তো সিটি করপোরেশন আছে বা স্থানীয় সরকারের লোকবল আছে। কিন্তু আমরা যা করি বা শুরু করেছিলাম সেটা একেবারেই সমুদ্রকেন্দ্রিক। ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সারা পৃথিবীর উপকূলে কী ধরনের আবর্জনা পাওয়া যায় তার একটা পরিসংখ্যান দাঁড় করানো। বাংলাদেশে এই কাজটা খুব সম্ভবত আমরাই ২০০৫ সাল থেকে করে আসছি। এখনও চলছে।
ঢাকা ফেরার পথে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মঞ্জুর-ই-ইলাহি তূর্যকে জিজ্ঞেস করি কেমন লাগল এ দুই দিনের কার্যক্রম। একটু হেসে বলল, সেন্টমার্টিন যেতে না পেরে প্রথমে খারাপ লাগছিল কিন্তু এই দুই দিনে যা করলাম এবং শিখলাম সেটা সারা জীবন মনে থাকবে।’ প্রায় একই রকম কথা বললেন সুমাইতা ইসলাম- ‘আমাদের শুরুটা ছিল পিকনিক মুডে। কিন্তু দুই দিন বিচে যেটা করলাম এবং দেখলাম সেটা বিস্ময়কর। সিগারেটের ফিল্টার যে আমাদের পরিবেশের এতটা ক্ষতি করছে এখানে না এলে হয়তো জানাই হতো না।’
মুনতাসির মামুনকে প্রশ্ন করেছিলাম কেওক্রাডং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে। জবাবে বললেন, ‘চলতে থাকা। আমরা যা করছি সেটা আমরা সবাই করতে পারি। এর জন্য কোনো পারদর্শিতার প্রয়োজন হয় না। আপনি-আমি যে কেউ যেকোনো জায়গায় যেকোনো দিন এই কাজ করতে পারি। আমরা আশা করি হয়তো কোনো একদিন অনেকে আমরা নিজ নিজ উদ্যোগে কাজটা করতে থাকব। থামব না।’ আমাদেরও প্রত্যাশা প্লাস্টিক বর্জ্যের বিরুদ্ধে এই যাত্রা চলমান থাকুক। আমাদের সঙ্গে থাকা এই সবজুপ্রাণ তরুণেরা একদিন ঠিকই সবুজ পৃথিবী গড়বে।