শত দেশের শত গল্প
রেজাউল বাহার
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:২৬ পিএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:২৩ পিএম
প্রথম বাংলাদেশি দম্পতি হিসেবে ১০০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলকে পৌঁছালেন রেজাউল বাহার ও শারমীন শাহারিয়াত। ২১ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে ভ্রমণের সেঞ্চুরি উদ্যাপন করেন এ দম্পতি। শত দেশের শত গল্প প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর পাঠকের জন্য তুলে ধরেছেন রেজাউল বাহার। আজ থাকছে ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, সাইপ্রাস, তিউনিসিয়া, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, কিউবা, থাইল্যান্ড, লিখটেনস্টাইন ও গ্রিনল্যান্ড নিয়ে নবম পর্ব।
২ সহস্রাধিক বছরের ঘটনা। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশে ঘটে গেছে অনেক কিছু। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু এখনকার ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের জেরুজালেম। তিনটি ধর্মের মধ্যমণি এ জেরুজালেম। মনে করা হয় এ শহরের খুব কাছেই ইব্রাহিম (আ.) তার ছেলেকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন। শহরের একটু বাইরেই জন্ম হয় যিশুখ্রিস্টের। এ শহরের পথ ধরে হেঁটে গেছেন তিনি, এখানেই তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। ইসলামের নবীদের শহর এ জেরুজালেম। আল-আকসা মসজিদ, যা পরিচিত টেম্পল মাউন্ট নামে।
ইসলামে মক্কা-মদিনার পরই জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ পবিত্রতম স্থান। মক্কার আগে এ মসজিদের দিকে ফিরেই প্রার্থনা করত মুসলমানরা। ইহুদিদের বেলায় আল-আকসা মসজিদের কম্পাউন্ড টেম্পল মাউন্ট নাম পরিচিত, তাদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। এখানেই তাদের দুটি টেম্পল ছিল, যা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখনও শোকে জর্জরিত থাকে ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা। তাদের বিশ্বাস, শেষ টেম্পল এখানেই তৈরি হবে।
মানুষে মানুষে ধর্ম নিয়ে শত সহস্র বছরের বিবাদ-যুদ্ধ। এখনও শেষ হয়নি। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা অনেকটা শেষ হওয়ার নয়। যুদ্ধ চলছে প্রতিনিয়ত। জেরুজালেমের ঐতিহাসিক পুরোনো শহর এখন দেয়ালে ঘেরা। কিছু গেট আছে, যেখানে অস্ত্রধারী নিরাপত্তাকর্মীরা সজাগ সব সময়। এ কম্পাউন্ডের মধ্যেই আছে তিনটি ভাগ। যুইশ কোয়ার্টার, খ্রিস্টান কোয়ার্টার আর মুসলিম কোয়ার্টার। ভেতরে আল-আকসা মসজিদও দেয়ালে ঘেরা। মসজিদের কম্পাউন্ড আছে মুসলমানদের দখলে। যে-কেউ নিয়ম মেনে কম্পাউন্ডে ঢুকতে পারবে। শুধু মুসলমানরা ঢুকতে পারবে মসজিদের ভেতরের অংশে। কম্পাউন্ডের পশ্চিমের দেয়ালটা বেশ উঁচু। দেয়ালের ওপাশে ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা দিনরাত প্রার্থনায় ব্যস্ত। পৃথিবীটা অনেক বড়। এত ক্ষুদ্র এক জায়গায় এতগুলো ধর্মের সীমাহীন টান।
উজবেকিস্তানের তাশখন্দ এয়ারপোর্টে যখন নামলাম রাত ২টা বাজে। ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি চব্বিশ ঘণ্টার বেশি। নিউইয়র্ক থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে তাশখন্দ। নির্ঝঞ্ঝাট এয়ারপোর্ট, মানুষের কোলাহল কমে গেছে, ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস সবই বেশ ঝটপট। উজবেকিস্তানের সমরখন্দে ঘুমিয়ে আছে এক পৈশাচিক দানব। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে সে বীর, নাম তৈমুর লং। ৬০০ বছর আগে তার তাণ্ডবলীলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ মানুষ মারা যায়। শুধু ভারতবর্ষে এসে মানুষ মারেন ১ লাখ। দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি আগুন লাগিয়ে দেন নিরীহ উটের পিঠে। কেন? কারণ দিল্লির বাহিনীর ছিল হাতি। তৈমুরের উট। উটের পিঠে আগুন চাপিয়ে হাতিকে দিশাহারা করেছিলেন তিনি।
যা কিছু দেখা হয়নি তার সংস্পর্শই অপার্থিব। সেই অপার্থিবের ছোঁয়া আজ কিরগিজস্তানে। মানুষ নিজের প্রয়োজনে পশুপাখি ব্যবহার করছে আদিকাল থেকে। ঈগলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিকার করা হয় প্রাণী। নিজের চোখে এ শিকার দেখাটা ছিল কিরগিজস্তান ভ্রমণের সবচেয়ে বড় পাওয়া। ক্ষণিকের এ অপার্থিব দেখার জন্য বছর ধরে জীবনযুদ্ধ করা যায়, একদিন তো চোখ বন্ধ হবেই। ঈগলের মতো ক্ষণিকের নয়, চিরতরে। কী লাভ কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে, আয় অপার্থিব দেখে যা।
পরিকল্পনা করলাম উত্তর গোলার্ধে সুমেরুর ভেতরের দিকে যাব। কোনো স্থল নেই পৃথিবীতে উত্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে। শীতে সাগর জমে হয় বরফের দেশ। গ্রীষ্মে গলতে থাকে কিছুটা, চক্র চলে এভাবেই। আমাদের গ্রিনল্যান্ড ভ্রমণের সময় ঠিক হলো জুলাইয়ে। এ সময়টায় সুমেরু বৃত্তে সূর্যাস্ত হয় না। চব্বিশ ঘণ্টা, দিনের পর দিন আকাশে সূর্য।
মাঝে মাঝে মনে হয় অনেকটা পথ চলে এসেছি। কখনও মনে হয় পৃথিবীটা আর একটু বড় হলে ভালো হতো! আবার মনের গভীরে জেগে ওঠে সেই প্রশ্ন- কতটা সময় বাকি আছে?
ভ্রমণ নিয়ে তৃষ্ণা আমার মেটেনি। এ তৃষ্ণা মেটার নয়। এ জগৎ দেখার এক নেশা চেপে বসেছে আমাকে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে।
এক দুই তিন করে শ। মানুষের তৈরি অদৃশ্য সীমানা পেরোলেই নতুন দেশ। আসলে সীমানা বলে কি কিছু আছে?
ছবি : লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে