× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মতপ্রকাশে নারী কতটা স্বাধীন

তানিয়া আক্তার

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৩ ১১:৪৮ এএম

মতপ্রকাশে নারী কতটা স্বাধীন

বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনে সবক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থায় নারীর মতামতকে কতটা গ্রাহ্য করা হয়, এ বিষয়ে প্রশ্ন আছে। আদৌ কি নারীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে? থাকলেও সেটা কতটা কার্যকর। না থাকলে কেন নেই, এ নিয়ে কথা বলাও যেন বারণ। মতপ্রকাশের দিক থেকে নারীর স্বাধীনতা বিষয়ে লেখা...

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা সায়মা রহমান। তিন সন্তানের জননী সায়মা মাস্টার্স পাস করেছেন হিসাববিজ্ঞানে। চাকরি বা ব্যবসা শুরু করতে চাইলেও সন্তানদের কথা মাথায় রেখে আদর্শ স্ত্রীর মতোই ঘরে থেকে সংসার সামলেছেন। সায়মার স্বামী তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর্থিক অনটন নেই বললেই চলে। স্বামী-সন্তান নিয়ে আপাতসুখের সংসার হলেও সায়মার মনের গভীরে যে দুঃখ তাকে দিনরাত পোড়ায়, তা হলো নিজে কিছু করতে না পারা এবং পরিবারের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণে অক্ষমতা। সায়মার ভাষ্য, স্বামীর অবর্তমানে তাকে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে স্বামীর মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হয়। রান্না এবং সন্তান পালন ছাড়া নিজের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই সংসারে। সন্তানরাও বুঝে গেছে মায়ের মতামতের কোনো মূল্য নেই। তারা এখন বলে, তুমি কী বুঝবে বা তোমাকে বলে কী লাভ? বাবাকেই বলি!

দেশের অন্যতম প্রধান একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আসমা আফরোজ (ছদ্মনাম)। সায়মার মতো নিজে কিছু করতে না পারার কষ্ট তার নেই। তার কষ্ট, নিজস্ব মতামতের দাম নেই সংসারে। স্বামী তার চেয়ে কম বেতনে চাকরি করেন, তাই এক ধরনের হীনম্মন্যতা থেকেই এমনটা করে থাকেন বলেই আসমার ভাবনা। কিন্তু সন্তানদের স্কুলে ভর্তি, আসবাব কেনার বিষয়, কোথাও ঘুরতে যাওয়া বা পোশাক কেনার মতো ছোটখাটো বিষয়েও স্বামীর নির্দেশের বাইরে গেলে কথা শুনতে হয় তাকে। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছে দুজনের মধ্যে। আসমা তার পরিবারকে এ বিষয়ে জানালে, সেখান থেকেও স্বামীর আদেশের বাইরে উচ্চবাচ্চ্য না করার পরামর্শ এসেছে। অশান্তি থেকে বাঁচার জন্য আসমা পারিবারিক বিষয়ে স্বামীর কথার বাইরে তেমন কোনো কথাই বলে না।


একবিংশ শতকে এসে আমরা যখন জোর গলায় বলছি, নারীর স্বাধীনতা, নারীর সমঅধিকার; তখন আমরা ভুলে যাই এখনও সমাজে এবং পরিবারে নিজের মতামত জানাতে কতটা হিমশিম খায় নারী। অপ্রকাশ্য এ নীরব ব্যাধির কবলে আজ আমাদের নারীসমাজ।

ওপরের দুই কেস স্টাডির আসমা বা সায়মার মতোই নীরব কষ্টে ভোগেন এ সমাজের অধিকাংশ নারী। কারণ পরিবারের বিভিন্ন বিষয় বা নিজের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তগ্রহণে তাদের মতামত উপেক্ষাই করা হয়। ‘তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক সমীক্ষার আয়োজন করে বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন।

জরিপে অংশগ্রহণ করেন সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি ১ হাজার ১৪ জন তরুণী। অধিকাংশেরই ভাষ্য, একজন তরুণী পরিবার ও সমাজে পুরুষের মতোই সমান গুরুত্ব পাওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু ২২.২৯ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন, তাদের মতামত পরিবারে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু নারী হওয়ার দরুন মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার মুখোমুখি হতে হয় ৪৬.২৫ শতাংশ নারীকে। এ সমীক্ষায় উঠে এসেছে, নারীর প্রতি প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকেই।

নারীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এখন পর্যন্ত নেই কোনো সমীক্ষা বা পর্যালোচনা। তবে স্বল্পপরিসরে হলেও আঁচল ফাউন্ডেশনের এ সমীক্ষা প্রমাণ করে, সমাজে নারীর মতামতের গুরুত্ব তৈরি হয়নি যথার্থভাবে। এ বিষয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘এ সময়ে নারীরা যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেন তখনও দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের নারীরা নানাবিধ কারণে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবার প্রতিষ্ঠিত নারীদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে এখনও যথাযথভাবে প্রস্তুত নয়। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য।’

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান এবং নারী অধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নারীরা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে চান। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও নারীরা কী অর্জন করতে পেরেছেন সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা? নারী অধিকার নিশ্চিতে কেন আমরা পিছিয়ে আছি? এর প্রধান কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বলেই মনে করি। সমাজ তথা পরিবারে ও রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতা এবং অংশগ্রহণ বাড়ছে না পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে সবল নয় বলে। পরিবারের ক্ষমতা, মর্যাদা ও সিদ্ধান্তগ্রহণÑ এ তিন চাবিকাঠি এখনও পুরুষের হাতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারে নারী একটু একটু করে ক্ষমতায়িত হচ্ছে, সিদ্ধান্তগ্রহণে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। কিন্তু সেটাও অপ্রতুল বলেই মনে করি।’

নারীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি শহরাঞ্চলের চাইতে গ্রাম তথা দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে আরও ভয়াবহ। অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য, শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক নানা আচারের প্রভাবে পরিবারের নারী সদস্যদের মতামত সর্বদাই থাকে উপেক্ষিত। পরিবারেই এ চর্চা শুরু হয় বলে সমাজের অন্যান্য স্তরেও নারীর মতামতের কোনো গুরুত্ব থাকে না।


মতপ্রকাশে নারীর স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভুলে গেলে চলবে না, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশজুড়ে ৫০৩টি ধর্ষণ ঘটেছে, যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ নারীকে। এ সময়ে পারিবারিক সহিংসতা ঘটেছে ৪৩৫টি। আর পারিবারিক কলহ থেকে স্বামীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে ১৮৩ নারীকে। এ ছাড়া শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনাও হাজারের কাছাকাছি, ৯২০টি। যার মধ্যে ১২১ কন্যাশিশু রয়েছে যারা হয়েছে ধর্ষণের শিকার। আইন ও সালিশ কেন্দ্র সূত্রে প্রাপ্ত এসব ঘটনার বাইরেও এমন অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না বা থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।

প্রশ্ন হতে পারে, আমাদের সমাজে নারীই যেখানে নিরাপদ নয়, সেখানে মতপ্রকাশের মতো অর্বাচীন বিষয়ে কথা বলা কতটা প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক তো বটেই। কারণ পরিবারে ও সমাজে যখন একজন নারী নিজের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হবে, নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে, নিজেকে আর্থিক কাজে নিয়োজিত করতে পারবে, তখনই নির্যাতনের মতো ব্যাধি কমে আসবে।

কেননা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে এখনও ‘কোমল’, ‘পেলব’ আর ‘ভোগের বস্তু’ হিসেবে দেখতে ভালোবাসে একটা বড় অংশ। এ অবস্থায় নারী যখন তার নিজের কথা নিজে বলবে, অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হবে তখনই ধীরে ধীরে সমাজ থেকে এ ব্যাধি দূর হবে। আর তখনই প্রতিষ্ঠা পাবে সাম্যের সমাজ, নারী-পুরুষের সমতার সমাজ।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা