শত দেশের শত গল্প
রেজাউল বাহার
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:১২ পিএম
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৪৯ পিএম
সাত মহাদেশের শততম দেশ ভ্রমণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন রেজাউল ও শারমীন দম্পতি। শত দেশের শত গল্প প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর পাঠকের জন্য তুলে ধরেছেন রেজাউল বাহার। আজ থাকছে জর্ডান, ইকুয়েডর, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, মন্টিনিগ্রো, জর্জিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ভ্রমণ নিয়ে ষষ্ঠ পর্ব...
আমি তো মঙ্গলগ্রহে যেতে পারব না। যেকোনো অর্থে এটাই ছিল আমার মঙ্গলযাত্রা। ওয়াদি রাম, জর্ডান। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের সবচেয়ে ভালোলাগার দেশ জর্ডান। জনমানবহীন, লালচে পাহাড়, দূরে ওই তাঁবুতে রাত্রিনিবাস। নির্ঘুম রাত এত সুন্দর হয়? আমি স্থির হয়ে শুয়ে থাকি, তারারা এপাশ-ওপাশ করে নিয়ে যায় আমাদের নক্ষত্রের কাছে, আসে ভোর।
খুব শিগগির কোনো এক ভোরে আমি তুমি থাকব না। নতুন মঙ্গলযাত্রায় আসবে নতুন। নতুন করে দেখবে। চিরদিন না থাকার মূল কারণ, একটা সময় পরে আমাদের আর দেওয়ার কিছু থাকে না। নতুন আসে, নতুন করে ভাবে, নতুন করে দেখে সব। বিবর্তন থেকে পরিবর্তনের মূল কারণ এখানেই।
তারা বলে, ইকুয়েডরের গ্যালাপাগোসের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা যাবে না। এখন থেকে শুধু অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে চার দিনের ভ্রমণে শারমীন আর আমি ইকুয়েডর যাই। আমরা গ্যালাপাগোসে গিয়েছি ইকুয়েডরের মূল ভূখণ্ড থেকে। দ্বীপের নাম বাল্ট্রা। এটি কমার্শিয়াল এয়ারপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জনবসতি নেই। মূলত গ্যালাপাগোসের প্রায় সব কটি দ্বীপই জনবসতিশূন্য। সংরক্ষিত আছে প্রাকৃতিকভাবে। এয়ারপোর্টে নেমে রেজিস্ট্রেশন ফি ২০ ডলার এবং গ্যালাপাগোস জাতীয় উদ্যানের জন্য ১০০ ডলার ফি দিতে হয়। বাসে চেপে যেতে হয় সমুদ্রঘাটে। মোটরবোটে পাড়ি দিতে হয় ছোট্ট ক্যানেল। ওপাশটিতেই সান্তা ক্রুজ দ্বীপ। এখানেই জনবসতি। থাকতে হবে এখানেই হোটেলে বা লজে, সেখান থেকে বোটে করে দেখতে হবে বিভিন্ন দ্বীপ।
সান্তা ক্রুজ দ্বীপে আছে শতাব্দী পেরোনো স্থলে থাকা দৈত্যবৎ কচ্ছপ। এদের জীবৎকাল প্রায় ১৫০ বছর। আমাদের গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ দেখা হয়েছিল মোটরচালিত ক্যাটামারান বোটে। আটটি কেবিন। ১৬ জন পর্যটক। ক্রু আছেন সাতজন। চার দিন ভেসে বেড়িয়েছি প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে গ্যালাপাগোসের এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে। প্রাণের বিবর্তন স্পষ্ট এখানে। কিছু দ্বীপ পাখির স্বর্গরাজ্য। এদের ডিম পাড়ার জন্য গাছে নীড় বাঁধার প্রয়োজন পড়ে না। এরা বাসা বাঁধে মাটিতে, পাথরে। কারণ শিকারি বলে নেই অন্য কোনো প্রাণী। আমরা অনেকটা গা-ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছি অথচ ভয় নেই এদের, উড়ে যাচ্ছে না। পর্যটকরা এদের কাছে হুমকি নয়। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। পাখিদের নিজস্ব ভূমে এত কাছ থেকে এদের কখনও দেখিনি।
বিরল প্রজাতির গুইসাপ ইগুয়ানার দুটি শ্রেণি বসবাস করে এখানে। প্রাণের বিবর্তনের পথ ধরে আজ আমরা এখানে। ১৬০ বছর আগে, একজন মানুষ মাত্র ২২ বছর বয়সে এ দ্বীপপুঞ্জে এসে যা দেখলেন, ভাবলেন, সব বদলে দিল আমাদের জানা স্বর্গের গল্পগুলোকে। আমরা তো স্বর্গ থেকে আসিনি। স্বর্গেই আছি।
কাজাখস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে মাটি থেকে ৬ হাজার ৬০০ ফুট উঁচুতে কাইন্ডি লেক। ১৯১১ সালে ভূমিকম্পের কারণে জন্ম হয় এ হ্রদের। এখানেও হ্রদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে অসংখ্য মৃত কাণ্ড মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও সবুজের কোনো চিহ্ন নেই। অথচ জলের নিচের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে শ্যাওলা আর লিচেনের মধ্যে ডালপালা বিস্তার করেছে গাছগুলো। জলের নিচে এমন অরণ্য দেখতে ডাইভেও নামে বহু মানুষ।
জর্জিয়ায় মাত্র চার দিনের ট্রিপে আমরা অনেক স্থান ঘুরে দেখেছি। ছোট্ট একটি দেশ ব্ল্যাক সির পাশে, ককাস মাউন্টেন রেঞ্জ, অদ্ভুতসুন্দর তিবলিসি শহর। জর্জিয়া মাস্ট ভিজিট দেশের মধ্যে একটি। থাকা-খাওয়া, ঘোরা সবই বেশ নাগালের মধ্যে।
২০১৮ সালের ক্রোয়েশিয়া-বসনিয়া ট্রিপের স্মৃতি রোমন্থন করছি। হোটেলে সকালের নাশতার পরপরই বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি চারদিকে কুয়াশা, ল্যাম্পপোস্টগুলোর আলো অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। কাল রাতেই নিউইয়র্ক থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে জাগরেবে (ক্রোয়েশিয়া) আসা। এয়ারপোর্ট থেকেই গাড়ি ভাড়া, আমার পছন্দের ম্যাচবক্স টাইপ গাড়ি মিনিকুপার। একটু পরই আমি আর শাম্মী বের হব বসনিয়ার শহর মস্তরের উদ্দেশে। রেস্ট, লাঞ্চ আর কফিবিরতি নিয়ে আনুমানিক ৮-১০ ঘণ্টা ড্রাইভ। বলকান মাউন্টেন রেঞ্জ ধরে রোড ট্রিপ এখানেই শুরু।
জাগরেবের থেকে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই বসনিয়ার উত্তরাংশের বর্ডার। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বর্ডার ক্রসিং শেষ। আমাদের নর্থ আমেরিকার পাসপোর্ট থাকার কারণে ভিসার প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশে বসনিয়ার কোনো এম্বাসি নেই। ভিসার জন্য সম্ভবত ইন্ডিয়ায় বসনিয়ান এম্বাসিতেই যেতে হবে। বর্ডার ক্রস থেকে মস্তার পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ি, কিছুটা ন্যারো, সাবধানে ড্রাইভিং জরুরি। বসনিয়ার ১৯৯০-এর যুদ্ধের কারণেই হয়তো এখনও অর্থনীতি দুর্বল, থাকা-খাওয়া বেশ সস্তা। মস্তরে রাত থেকে সকালটা শহরে হাঁটাহাঁটি, দুপুরে মস্তার থেকে ঘণ্টাখানেক দূরে ক্রাভিকা ওয়াটারফল।
সেখান থেকেই পরের দেশ মন্টিনিগ্রোর উদ্দেশে যাত্রা। যে দেশে একটা বড় শহরে রিজন্যাবল একটা মিল/লাঞ্চের জন্য লাগে ২ ইউরো, যার ভ্যালি মাউন্টেন আর নদী মনে হয় অনন্ত পথ, সেই বসনিয়ায় ঘুরে আসাটা অনিবার্য।
ছোটবেলায় বইতে পেলের গল্প ছিল। মাঝে মাঝে মনে হয় ফুটবলই জীবন, ফুটবলই সব। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ব্রাজিলের ফুটবলের ভক্ত। কিন্তু শুধু ফুটবল নয়, ব্রাজিলের রিও শহরে গিয়ে দেখলাম কোথায় যেন বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক মিল। পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট, মানুষের আড্ডা, দোকানপাট, যানজট সব কেমন যেন ঢাকা শহরের মতো।
রিওতে আমাদের পাঁচ দিনের ভ্রমণ, বেশিরভাগ সময় কাটানো হয়েছে রিওর কোপাকাবানা বিচের আশপাশে। শহরের এ অংশটা ট্যুরিস্টদের জন্য নিরাপদ। রিওতে বিচ মানেই মানুষ আর মানুষ। শহরজুড়ে ছোটবড় পাহাড়, ঘন জনবসতি।
পাহাড়ের ওপরই রিওর মূল আকর্ষণ যিশুখ্রিস্টের মূর্তি। মুভি বা ডকুমেন্টারিতে যিশুর এ মূর্তি যতটা বড় মনে হয়, ঠিক ততটা বড় সামনাসামনি মনে হয় না। সন্ধ্যায় সূর্যাস্তে পাহাড় থেকে সমুদ্রঘেঁষা রিও শহর এক অদ্ভুত শিল্পীর আঁকা ছবি মনে হয়।
এয়ারপোর্ট থেকে উবার বা ট্যাক্সি, আমাদের আগে থেকেই ট্রান্সপোর্টেশন ঠিক করা ছিল। ইংরেজি খুব কম মানুষই বলে বা বোঝে, কাজেই কিছুটা প্রিপারেশন আগে থেকেই নেওয়া ভালো।
আমাদের দুজনের বাজিল ভ্রমণের সারসংক্ষেপ
ছবি : লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে