মহুয়া রউফ
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৩৩ পিএম
নিকারাগুয়ার বিখ্যাত বন পিনাস ব্লাঙ্কাস ম্যাসিফে লেখক ও লেখকের ডাচ বন্ধু কাসা ছবি : লেখকের সৌজন্যে
নিকারাগুয়ার শহর মাতাগাল্পা, যা অনেকের কাছে অনন্ত ‘বসন্তের শহর’ নামে পরিচিত। সেখানে আছে আরেক আমাজন পিনাস ব্লাঙ্কাস ম্যাসিফ। পৃথিবীর আরেক আমাজন দেখতে যাচ্ছি আমরা। সেখানে সকাল-বিকাল বৃষ্টি হয়।পথ সর্বদা কাদাযুক্ত। সাপের ভয় প্রকট। পৃথিবী বিখ্যাত সাপের আবাসস্থলও এই অরণ্য। লিখেছেন মহুয়া রউফ
অক্টোবর ২০১৬। আমি বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব এনটর্পের ছাত্র। ইউনিভার্সিটি থেকেই একটি গবেষণার কাজে ভিন মহাদেশের ভিন দেশ নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়ায় এসেছি। আমরা দুজন এসেছি। আমার সঙ্গে আমার ডাচ বন্ধু কাসা।
মানাগুয়ায় প্রথম কয়েকদিন থাকার ব্যবস্থা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিয়ারের বাসায়। দুদিন যেতেই পিয়ার বললেন, আমাদের দেশটা ঘুরে দেখো। পিয়ারের প্রস্তাবে আমি হতবাক! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দায়িত্ব-কর্তব্যের ফর্দ ধরিয়ে না দিয়ে বলছে কি না দেশ ঘুরে দেখতে! তিনি আরও বললেন, এই সামনের শনি-রবিবার তোমরা যেতে পারো মাতাগাল্পা। আমরা এ শহরের আরও দুটি আবেদনময়ী নাম রেখেছি- ‘উত্তরের মুক্তা’ ও ‘অনন্ত বসন্তের শহর’। সেখানে আছে আরেক আমাজন- পিনাস ব্লাঙ্কাস ম্যাসিফ।
আমি তো এক নাচুনে বুড়ি আর আমার প্রফেসর পিয়ার দিলেন কি না ঢোলের বারি! আমি কাসার দিকে তাকালাম। তার চোখে-মুখেও সম্মতি। শুনেছি ইউরোপিয়ানদের নাকি স্প্যানিশ ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রতি বিশেষ আগ্রহ। আমরা মাতাগাল্পা যাচ্ছি। শনিবারের সকাল। মন ভালো করে দেওয়া মিষ্টি রোদ। চারদিকে ছোট ছোট একতলা-দোতলা ঘরবাড়ি। সুউচ্চ দালান এ দেশে হয় না, কারণ এ দেশ দাঁড়িয়ে আছে এক ভলকানো চেইনের ওপর। সকাল সকাল বাসস্টেশন পৌঁছালাম। ছুটির সকাল বলে লোকের খুব একটা ভিড়ভাট্টা নাই। বাসে চড়ে বসলাম। না, জাপানি লাক্সারি বাস নয়, আটপৌরে সাদাসিধে কিন্তু মজবুত বাস। রাজধানী মানাগুয়া থেকে মাতাগাল্পার দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার।
শহর ছাড়িয়ে দেশের সীমান্তের দিকে চলছে গাড়ি। গাড়ি পাহাড়ের ওপর উঠে যাচ্ছে। দূর তটরেখায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়। গাড়ি পঙ্খীরাজের মতো আটপৌরে ধুলো উড়িয়ে ছুটছে সম্মুখে উঁচু পাহাড়ে। গাড়িতে যাত্রীর আসন থেকে আমি আমার দৃষ্টি বরাবর বহু দূরের একেবারে দিগন্তের যে পাহাড় দেখছি, কিছুক্ষণ পর টের পাচ্ছি আমাদের গাড়িই সে পাহাড় ডিঙাচ্ছে।
পৌঁছলাম মাতাগাল্পা শহরের কেন্দ্রে। রাজধানী থেকে সব মিলিয়ে চার ঘণ্টা সময় লাগল। এখন আর বাসে যাওয়া যাবে না। শহরে নেমেই এটি স্পষ্ট হলো এখানে কলোনি ছিলÑ স্প্যানিশ কলোনি। এখন আর নেই, ছেড়ে গেছে। এ শহরে জন্মেছেন কবি রুবেন দা। আমার বন্ধু কাসা অল্প-বিস্তর স্প্যানিশ শিখে ফেলেছে। আমি দুটি শব্দ রপ্ত করেছি। ‘ওলা’ অর্থাৎ ‘হাই’ এবং ‘গ্রাসিয়াস’ অর্থাৎ ‘ধন্যবাদ’। এ দেশে আসছি অবধি যখন যার কাছ থেকে সামান্যতম সেবাও নিচ্ছি ‘গ্রাসিয়াস’ বলতে কার্পণ্য করছি না।
মাতাগাল্পা থেকে মাইক্রো নিলাম। আরও ৭০ কিলোমিটার দূরে সেই বৃষ্টি বনাঞ্চলে নিয়ে যাবে এই গাড়ি। ঘণ্টা দেড়েক পর আমাদের গাড়ি আমাদের দুজনকে নামিয়ে দিল এক গহিন অরণ্যে। হাঁটছি আগে থেকে বুকিং করা ইকো রিসোর্টের দিকে। রাত্রিযাপন হবে যেখানে। ইকো রিসোর্টটি একেবারেই এই বৃষ্টি বনের মধ্যখানে। শিশির ভেজা পথ। অস্বচ্ছ আকাশ। এলোমেলো বাতাসের পাচ্ছি সাড়া। ইন্টারনেট তো দূরের কথা, মোবাইল নেটওয়ার্কও অসহায়। চারদিকে ঘন অরণ্যে নোঙর ফেলেছে আমার মন।
আমি মানুষটা নিতান্তই সাধারণ, কিন্তু বৈচিত্র্যও বুঝি মাঝেমধ্যে আমার ওপর ভর করে। ইকো রিসোর্টে পৌঁছেই কাঁধের ব্যাগ রেখে হাত-মুখ ধুতে গেছি সেখানে আরেক বিস্ময়। এক ভিন্ন রকমের শৌচাগার! শৌচাগারে চারটা দেয়াল হওয়ার কথা। না, এখানে তিন দেয়াল, একদিক পুরোটাই উন্মুক্ত। প্রথমদিকে খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করলেও খেয়াল করে দেখলাম ওপাশটায় কেবল গাছগাছালি। কোনোখানে বসতি নেই। সন্ধ্যায় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালের নাশতা রিসোর্টেই সারলাম। সকালে পিনাস ব্লাঙ্কাসের আরও উঁচুতে ওঠার প্রস্তুতি হিসেবে গাইড বলল হাঁটু অবধি বুট জুতা পরে নিতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আমরা ১ হাজার মিটার উচ্চতায় আছি। আমাদের হাইকিং হবে ৮০০ মিটারে মতো। হোটেলেই রাখা আছে হাঁটু অবধি উঁচু-লম্বা বুট জুতা।
‘এটা কেন পরতে হবে?’ কাসাকে জানতে চাইলাম।
কাসা বলল, ‘বোসাওয়াস বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হলো আমাজনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম রেইনফরেস্ট। এরই একটি বিশেষ অংশ পিনাস ব্লাঙ্কাস ম্যাসিফ। তুমি পৃথিবীর আরেক আমাজন দেখতে যাচ্ছ। সেথায় সকাল-বিকাল মৃদু বৃষ্টি হয়। পথ সর্বদা কাদাযুক্ত। সাপের ভয় প্রকট। পৃথিবী বিখ্যাত সাপের আবাসস্থলও এই অরণ্য। এই জুতা নিরাপত্তা দেবে।’
আমরা আটজনের একটি দল। যাত্রা শুরু হয় একটা স্থানীয় প্রথা মেনে। পাহাড়ের গায়ে আছে এক টুকরা পাথর। এ পাথর ছুঁয়ে এক রকম অনুমতি নিতে হয়। আমরা তাই করলাম। যাত্রা শুরু হলো। এই অঞ্চলটির বিশেষত্ব সুন্দর বৃষ্টি বন, জলপ্রপাত, চমৎকার দৃশ্যপট এবং আকর্ষণীয় গ্রামীণ সম্প্রদায়। তখনও আমি বুঝিনি এ রকম বৃষ্টি বনে হাইকিং কত কঠিন। এ কুমারী অরণ্যের বিশেষ আকর্ষণ পাহাড়ের আরও উঁচুতে অবিশ্বাস্য এক জলপ্রপাত, নাম যার আরকোইরিস (Arcoiris) জলপ্রপাত। এ দলে সবায় তরুণ, আমিই কেবল চালশের কাছাকাছি।
রাস্তা এবড়ো-খেবড়ো। আমি অন্যদের তুলনায় খানিকটা দুর্বল। আমি বারবার পিছিয়ে পড়ছি এই জোরসে হাঁটাতে। ভিন দেশি বন্ধুরা খানিক এগিয়ে থামে, আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমার মন কৃতজ্ঞতায় নত হয়। পেছলে পড়তে গিয়ে গাছের ডাল ধরলাম। সে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে কে জানত! ডাল ভেঙে পাহাড়ের আরেক ঢালে গিয়ে পড়লাম। অভিযাত্রী দলে দুজন পুরুষ আছে। দায়িত্ব নিয়ে আমায় টেনে তুলল। এ যাত্রায় রক্ষা পেলাম।
আরও খানিক ওপরে গিয়ে এমন একটা জায়গায় আটকে গেলাম যেখানে এক সরু পথ। সে সরু পথ আটকে রেখেছে বেশ কিছু নানা আকৃতির গাছ। সামনে যাওয়ার রাস্তা এই একটাই। একটি প্রাকৃতিক ছাঁচ যেন! সে ছাঁচ এ শরীর ঢুকিয়ে দিতে হবে। আর কোনো উপায় নেই। এক একজন করে শরীর বাঁকিয়ে সেখান দিয়ে পার হচ্ছে। আমিও অসহায়। শরীর বাঁকিয়ে সেই সংকীর্ণ পথে ঢুকে পড়লাম। মনে হচ্ছে শরীরের হাড়-মাংস বুঝি প্রেশার কুকারে ঢুকিয়ে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে বেশ কয়েকটি চিত্তাকর্ষক জলপ্রপাত সমস্ত পাহাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সাপের মতো আবেদনময়ী তারা। একটা ঝরনার পাশে বসে পড়লাম ক্লান্তিতে।
চোখ ধাঁধানো সবুজের বিস্ময় সর্বত্র। অচেনা প্রকৃতির মাঝে আমি নতুন। সবুজের এই মৌন মিছিলে আমি এক ক্ষুদ্র নগণ্য। আমাদের জসিম উদ্দিন যেমনটি বলেছিলেন, গাছের ছায়ায় লতায়পাতায় উদাসী বনের বায়! ভাবছি এ অরণ্য প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যের নির্যাস পেতে যে অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন, আমার তা আছে তো? এ সবুজ আমায় গ্রহণ করবে তো? আর্দ্র এবং পিচ্ছিল সরু পথ বেয়ে এই বৃষ্টি বনের পাহাড়ে উঠছি, এই মেঘ অরণ্যে সর্বক্ষণ হাল্কা মেজাজে বৃষ্টি পড়ছে, রেইন ফরেস্টে যা হয় সাধারণত। দুরন্ত সবুজ গাছগুলো এতটাই ভেজা এবং পিচ্ছিল যে, এদের ধরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা দায়।
আরকোইরিস জলপ্রপাত অবধি পৌঁছে গেছি। আকাশে রংধনু উঠেছে। সে রঙ ছড়িয়ে পড়েছে ‘আরকোইরিস’ জলপ্রপাতে। জীবনে কোনো দিন যে আমি তেমন একটা উঁচু পাহাড়ে উঠিনি, সেই আমি ঠিক চূড়ায় উঠেছি। মনে হয়েছিল এটাই আমার হিমালয় কিংবা আল্পস জয়। জীবনে যত ঝরনা দেখেছি সিলেটে কিংবা সুইজারল্যান্ডে, সবটাই পাহাড়ের পাদদেশ থেকে দেখেছি, কিন্তু ‘আরকোইরিস’কে দেখছি পাহাড়ের চূডায় ওঠে। আমি ওর নাম দিয়েছি অভিমানী আরকোইরিস, নয়তো সে পাহাড়ের মাঝে লুকিয়ে আছে কেন।
আশপাশের গাছগাছালি থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। শরীর ভিজে একাকার। আমরা ছবি তুলতে গিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের চিৎকার চেঁচামেচিতে মেতেছি। হঠাৎ সবাই দমে গেলাম! এ কী দেখছি! দুটি বাচ্চা সাপ আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে! হিম হয়ে গেল শরীর। আমি আর কাসা দুজন দুজনকে শক্ত করে ধরে আছি!