সাধন সরকার
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৫৬ পিএম
রাষ্ট্রের হাজারো উন্নয়নের ভীড়ে বিভিন্ন উদ্যানে বাস করা ভাসমান ছিন্নমূল শিশুদের কথা ভাবার সময় কোথায় ছবি : অনিন্দ্য কবির অভীক
এই শহরে পথশিশুর সংখ্যা কত? সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে রয়েছে সংখ্যার বিস্তর ফারাক। ভাসমান ছিন্নমূল এই শিশুদের অধিকাংশই থেকেও যেন নেই। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাও পূরণ হয় না কখনও। ভাসমান এসব শিশুর বিরাট একটা অংশের বাস রাজধানীর বিভিন্ন পার্ক কিংবা উদ্যানে। কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত কেউবা জড়াচ্ছে বিভিন্ন অপরাধে। মাদকাসক্তও হয়ে থাকে অনেকে। এসব শিশুর কথা ভাবার কেউ নেই যেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত...
পাতলা গড়নের ছেলেটির পুষ্টির অভাব দৃশ্যমান। বয়স ১০-এর ঘরে। এ বয়সে তার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতার জাঁতাকলে তার জীবন কাটছে ওসমানী উদ্যানে। ভবিষ্যৎ তার জন্য কী নিয়ে অপেক্ষায় আছে, সে জানে না। ওর মতো অনেক শিশুর বসবাস ওসমানী উদ্যানে। এসব অভিভাবকহীন শিশুর শৈশব কাটছে সীমাহীন উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায়। উদ্যানের আধুনিকায়নের কাজ চলছে। প্রবেশের প্রধান ফটকে লেখা- ‘সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’। কিন্তু সচিবালয় ও নগর ভবনের সামনের ফুটপাথ থেকে টিনের বেড়ার ফাঁক গলে উদ্যানে সর্বসাধারণকে হামেশাই প্রবেশ করতে দেখা গেল, রীতিমতো অরক্ষিত! উদ্যানে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল ফাঁকা জায়গায় আয়োজন করে দুই গ্রুপের ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। এক পাশে বড়রা, অন্য পাশে ছোটরা। সবুজ উদ্যানে বিক্ষিপ্তভাবে ময়লা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল আভা পার্কের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্তবয়স্কদের ছোট ছোট জটলা, হাবভাব দেখে মনে হলো নিষিদ্ধ কোনো কিছু সেবন করছে! আশপাশ দেখে বোঝা গেল কেউ কেউ সত্যিই এসেছেন বিনোদন নিতে ও সময় কাটাতে। বিকাল ৩টায় উদ্যানে লোকসমাগম কোনো অংশে কম নয়।
অভিভাবকহীন বিপ্লব
বিপ্লব মনের সুখে ক্রিকেট খেলছে। বয়স ১০ বছরের একটু বেশি। তার সঙ্গে সখ্য গড়ার চেষ্টা করি- তুমি থাক কোথায়? তোমার বাবা-মা কোথায়? প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে থাকে বিপ্লব। বল কুড়িয়ে এনে জবাব দিলো, ‘বাপ নাই। মা দেশে। বরিশালে। বাড়ি থেকে বন্ধুর সাথে পালাইছি।’ খানিক পর আবার বলতে শুরু করে, ‘এহানে ভিক্ষা করে খাই। দেশে যাইতে মন চায় না। এহানেই থাহি। এই পোলাপানের লগে। আমার জন্মই তো গুলিস্তান পার্কে। মা দেশে চইলা গ্যাছে। আমি আবার এহানেই চলে আইছি!’ বিপ্লব ওর মা ও ছোট বোনের নামও বলল। মায়ের নাম পারভীন। বোনের নাম আয়েশা। খেলা নিয়ে প্রশ্ন করতেই সে মনের আনন্দে কথা বলা শুরু করল, ‘ফুটবল খ্যালতে মন চায়। কিন্তু পাই না। তাই ক্রিকেট খেলি।’
পড়াশোনার বিষয়ে জানা গেল, বিপ্লব স্কুলে যায় না। স্কুলে যেতে ওর ভালো লাগে না। কথা বলতে বলতে ওর বন্ধু মিলন ওকে ব্যাটিং করার জন্য ডাকতেই একগাল হাসি নিয়ে ব্যাটিংয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
দোকানদার ছোট্ট মুন্নি
উদ্যানের সরু রাস্তার ওপর পান-সিগারেট-চকলেট বিক্রি করছে মুন্নি। বয়স ৭-এর মতো। দুজন লোক সিগারেট ও পান কিনলে টাকার হিসাব করতে পাশে বসে থাকা বাবার সাহায্য নিল। বোঝা গেল মুন্নি এখনও স্কুলের বারান্দায় পা দেয়নি! পাশে বসা আরও দুই বোন। রুবিনা (৪) ও রাজিয়া (৩)। বোনেরা আপন মনে নিজেদের মতো খেলছে। লেখাপড়া ও বাসার কথা জিজ্ঞেস করতেই মুখে মুচকি হাসি নিয়ে বলল, ‘আমি স্কুলে যাই না। আমরা পাশের একটি বস্তিতে থাকি। এহানে দোহানদারি করি।’ পাশের গাছ থেকে জাম পাড়তে দেখা গেল দুজনকে। জাম পেয়ে মুন্নির দুই ভাইবোনের আনন্দ দেখে কে!
মুন্নিদের অন্য দিকের রাস্তায় ছোট্ট দুই ছেলেসন্তান নিয়ে মা-বাবা দিব্যি শুয়ে আছে। মা সজাগ থাকলেও দিনদুপুরে বাবা ঘুমাচ্ছে! বাচ্চারা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। ওর মা ওদের নাম ধরে ডাকছে। আবেদ (৪) ও জাবেদ (৩)। ডাকতেই একগাল হাসি নিয়ে আবেদ কাছে এগিয়ে এলো। চেহারায় অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। চোখ কিছুটা ভেতরে ঢোকানো। খানিক পর কিশোরের একটি গ্রুপ ব্যাট-বল নিয়ে হাজির। রাস্তার ওপর ক্রিকেট খেলবে। বাধ্য হয়েই আবেদদের ওখান থেকে সরতে হলো। আবেদের বাবা যেন তখনও ঘুমে টলোমলো!
মনে প্রশ্ন জাগল, রাষ্ট্রের এত এত উন্নয়ন, তার মধ্যে এই বিপ্লব, মুন্নি, আবেদরা কোথায় আছে, কী করছে তার খোঁজ কে রাখে?
ঢাকার বিভিন্ন পার্ক-উদ্যানে কত শত ছিন্নমূল পরিবার কিংবা কতজন ভবঘুরে ছেলে-মেয়ে বসবাস করছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। গ্রামের হতদরিদ্র পরিবার কিংবা জলবায়ু উদ্বাস্তুরা যখন সবকিছু হারিয়ে শহরে চলে আসে তখন রেললাইনের পাশে কিংবা পার্ক-উদ্যানে তাদের দেখা মেলে। ইতিহাস বলছে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ঢাকা শহরের পার্ক-উদ্যানে ছিন্নমূল মানুষের বাস। রমনা, ওসমানী, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনেক শিশুর দেখা মিলবে যারা স্কুলে যায় না। বহু শিশু ছোট্ট বয়সে সংসার চালাতে কাজে লেগে পড়েছে। অনেক শিশু আবার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।
ড্যান্ডির কবলে উদ্যানের শিশুরা
পার্ক থেকে বের হওয়ার সময় চোখ গেল কিশোরদের এক জটলার দিকে। ওরা মুখে পলিথিন লাগিয়ে কী যেন টানছে। ওসমানী উদ্যান থেকে ড্যান্ডি টানতে টানতে বের হয়ে গোলাপশাহ মাজারের সামনে গোলচত্বরে অবস্থান নিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পার্কের শিশুদের নেশার এ উপকরণটির নাম ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যান্ড্রাইট আঠা। তবে ‘ড্যান্ডি’ নামেই বেশি পরিচিত। পার্কের শিশুরা মূলত আশপাশের রঙের দোকান থেকে এক ধরনের সল্যুশন কেনে। এ সল্যুশন সাধারণত চামড়া ও ফোম জাতীয় দ্রব্যে ব্যবহার করা হয়। সচরাচর এ সল্যুশন হলো মূলত জুতা তৈরির গাম। প্রথমে এ গাম একটি পলিথিনে ভরে। এরপর কিছুক্ষণ ঝাঁকিয়ে নাক ও মুখের সাহায্যে তারা শ্বাস নেয়। এতেই এক ধরনের নেশা তৈরি হয়। এভাবেই দিনের পর দিন পার্কের শিশুরা ক্রমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পচা ও উচ্ছিষ্ট খাবার অনেক সময় ড্যান্ডির মতো পলিথিনে ভরে শ্বাস নেয়। শুধু উদ্যান বা পার্কের শিশুরা নয়, পথশিশুর বড় একটি অংশই ড্যান্ডি সেবনে আসক্ত বলে জানা যায়।
পার্ক ও উদ্যানের এসব শিশুর খোঁজ কেউ রাখে না। এদের পরিচয় টোকাই বা পথশিশু হিসেবে! উদ্যানকে বলা হয় নগরের ফুসফুস। এই অভিভাবকহীন কোমল শিশুরা বিশুদ্ধ ফুসফুসের মধ্যে থাকলেও ওদের ফুসফুসে ঢুকছে কেবল ড্যান্ডির বিষাক্ত বাতাস আর মাদক! শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছে ওসমানী উদ্যান ঘিরে। তবু উদ্যানের ছিন্নমূল শিশুদের জীবনে কোনো উন্নয়ন আসে না!
পার্ক-উদ্যানে ছিন্নমূল শিশুর হিসাব নেই
বাংলাদেশে পথশিশুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পেতে যেখানে হিমশিম খেতে হয় সেখানে পার্ক-উদ্যানের ছিন্নমূল শিশুর আলাদা পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ঢাকা শহরে ৩০টির বেশি পার্ক-উদ্যান রয়েছে। বড় বড় পার্ক-উদ্যানে ছিন্নমূল শিশুর বাস। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা যায়, ঢাকা শহরের পার্ক-উদ্যানগুলোয় হাজারের বেশি ছিন্নমূল শিশুর আবাস। তাদের জীবনযাপন উদ্যানকেন্দ্রিক। এই বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ নানা সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। বেসরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি পথশিশু; যার অর্ধেকের বাস ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) হিসাবমতে, ঢাকা শহরে ৫ লাখের বেশি পথশিশু রয়েছে। এদের বসবাসের জায়গা খোলা আকাশ, পার্ক, ফুটপাত, রেলস্টেশন, ফেরিঘাট, লঞ্চটার্মিনাল কিংবা বাসস্টেশন। যদিও ঢাকায় পথশিশুদের জন্য দুটি ড্রপ-ইন-সেন্টার ও রাতে থাকার একটি রাত্রিনিবাস রয়েছে। কিন্তু সেগুলোও শিশুবান্ধব নয়। জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ এবং শিশু আইন ২০১৩-এর মতো আইন থাকলেও পার্ক-উদ্যানের শিশুদের জীবনে তার কোনো প্রতিফলন নেই। আন্তর্জাতিক শিশু সনদে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিধান রয়েছে। কিন্তু কোনো আইনই যেন পার্ক-উদ্যানের তথা পথশিশুদের জীবনের পরিবর্তন করতে পারছে না! ক্রমবর্ধমান হারে পার্ক-উদ্যানের ছিন্নমূল শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দিনরাত নেশায় বুঁদ হয়ে এসব পথশিশু জড়িয়ে পড়ছে চুরিসহ নানা অপরাধে।
ভাসমান শিশুদের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ওসমানী উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা একজন বলেন, ‘এরা পার্কেই থাকে। অনেকবার তাড়িয়ে দিয়েছি তবু আবার আসে। অনেকে ভিক্ষা ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত। এরা এতিম।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা পার্কের উন্নয়ন কাজ চলমানের কথা বলে কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
পার্ক ও উদ্যানের শিশুদের জীবনযাপন সম্পর্কে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মহসিন রেজা বলেন, ‘পার্ক-উদ্যানের ছিন্নমূল শিশুদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হলে এনজিওদের ভূমিকা রাখতে হবে। সরকারের প্রকল্প যথেষ্ট নয়। শিশুদের অধিকার পূরণের দায়িত্ব সবার। তাদের পুনর্বাসন করতে হবে।’