× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হিমলুং অভিযান

বেঁচে ফেরার গল্প

ইকরামুল হাসান শাকিল

প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:৩৮ পিএম

আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:৪০ পিএম

হিমলুং শিখরে পতাকা হাতে লেখক

হিমলুং শিখরে পতাকা হাতে লেখক

ওইতো চূড়া দেখা যাচ্ছে। আর মাত্র ২০-২৫ মিনিটের পথ। বাতাসের গতিবেগ আরও বেড়ে গেছে। বাতাসের ধাক্কা আমি সামাল দিতে পারছি না। আমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাই সামনে এগিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। হাতের আঙুল, নাক ও ঠোঁট ঠান্ডায় অসাড় হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, মনে হচ্ছিল একটু পানি পেলে হয়তো বেঁচে যাব।

ড্যান্ডিকে বললাম আমার পানি খেতে হবে। আমি আর এগোতে পারছি না। ড্যান্ডি জানাল এই ঝড়ের মধ্যে সময় নষ্ট করা যাবে না। যেভাবেই হোক আমাদের তাড়াতাড়ি চূড়ায় উঠতে হবে এবং নেমে আসতে হবে। না হলে আমরা দুজনই মারা যাব। তিন দিন ধরে কোনো ভারী খাবার খাই না, শুধু চা, স্যুপ আর চকলেট। শরীরে কোনো শক্তি নেই, মনের জোরেই এগিয়ে চলছি।

২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর। হিমলুং বেসক্যাম্প থেকে চূড়ান্ত আরোহণের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি আমরা চারজন। প্রায় দেড় ঘণ্টায় কঠিন ও ভয়ানক পাথুরের মোড়ের গ্লেসিয়ার অতিক্রম করে খাড়া এক পাথুরে দেয়াল বেয়ে উঠে এলাম। এরপর ধীরে ধীরে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে উঠে আসি ক্যাম্প-১-এ। ক্যাম্প-১-এর উচ্চতা ১৭ হাজার ৮৮০ ফুট। বিকালের দিকে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করল। চারপাশ হোয়াইট আউট হয়ে গেল। ওপর থেকে ক্যাম্প-১-এ নেমে এলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্মি টিমের সদস্যরা। তারা ১৮ জনের টিমে মাত্র দুজন হিমলুং চূড়া আরোহণ করতে পেরেছেন। ওপরের আবহাওয়া ভালো না।

কঠিন পথ অতিক্রম করে হিমলুং চূড়ার পথে অভিযাত্রীরা                                                                        ছবি: এম এ মুহিত

২১ অক্টোবর। সকালে তাঁবু থেকে বেরিয়ে বেশ আনন্দ হলো আবহাওয়া ভালো দেখে। রোদও জানান দিল তোমরা ওপরে যেতে পারো। তাই আমরাও দেরি না করে ১৯ হাজার ৬৮৫ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-২-এর উদ্দেশে রওনা হলাম। শুরু হলো আমাদের টেকনিক্যাল ক্লাইমবিং। ছোটবড় আলগা পাথরের খাড়া চড়াই। যতই ওপরের দিকে উঠছি ততই পথটা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কোথাও পাথর ধরে ধরে আবার কোথাও দড়ি ধরে উঠছি। ওপর থেকে পাথরের টুকরো পড়ছে। পায়ের নিচের পাথরও নড়বড়ে, সরে যাচ্ছে। খুবই সতর্কতার সঙ্গে পাথুরে পথটা পেরিয়ে উঠে এলাম বরফের গ্লেসিয়ারে। পুরো গ্লেসিয়ারেই ছোটবড় অসংখ্য ক্রেভাস। ক্রেভাস হলো বরফের ফাটল। তাই খুবই সতর্কতার সঙ্গে জিগজ্যাগ করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। দুপুরের মধ্যে আমরা ক্যাম্প-২তে চলে এলাম। এখানে আবহাওয়া বেশ ভালো। এখানে আমাদের দুটি তাঁবু খাটানো হয়েছে। এক তাঁবুতে দুই শেরপা, অন্য তাঁবুতে আমরা দুজন। এখান থেকে হিমলুং পর্বতশিখরটা ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। পর্বতের যত ওপরের দিকে ওঠা যায় ঘুম তত কমে যায়।

হিমলুং বেসক্যাম্পে ডাইনিং তাঁবুতে                                                                                                            ছবি: লেখক

আজ সকালেই রোদে চারপাশ বরফে চিকচিক করছে। তবে হিমলুংয়ের ছায়ায় এখনও আমাদের এখানে রোদ এসে পৌঁছায়নি। চা, স্যুপ খেয়ে আমরা ক্যাম্প-৩-এর উদ্দেশে রওনা হলাম। আজকের পুরোটা পথ বরফের গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে। ভীষণ সুন্দর পথ তবে যতটা সুন্দর তার থেকে বেশি বিপজ্জনক। বরফের ক্রেভাস ও গভীর খাদের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কখনও আইস অ্যাক্স, কখনও দড়ির সাহায্যে যেতে হচ্ছে। প্রায় চলে এসেছি ক্যাম্প-৩তে। এখন একটা চড়াই উঠতে পারলেই ক্যাম্প-৩। এ চড়াইটা একদম খাড়া। প্রায় ১৫০ মিটার দড়িতে ঝুলে জুমারিং করে উঠতে হবে। এদিকে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করছে। বাতাস বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আমরা ক্যাম্প-৩তে উঠে এলাম। এ ক্যাম্প-৩-এর উচ্চতা প্রায় ২১ হাজার ফুট।

১৯ হাজার ৬৮৫ ফুট ওপরে অভিযাত্রীদের ক্যাম্প। এখানেই দুই রাত যাপন করেছেন অভিযাত্রীরা         ছবি: লেখক

ঝড়ের তাণ্ডবে সারা রাত মুহূর্তের জন্যও ঘুম এলো না চোখে। আসবেই বা কীভাবে? সরু এক বরফের রিজে বরফ কেটে একটু জায়গা করে সেখানেই তাঁবু খাটানো হয়েছে। এর এক পাশের নিচে কার্নিশ। নড়বড়ে এক জায়গা। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। দুপুরের পর থেকেই প্রচণ্ড তুষারঝড়। একটুও থামার লক্ষণ নেই। তাঁবুর ভেতরে আমরা চারজন। ড্যান্ডি শেরপা, ঠুন্ডু শেরপা, মুহিত ভাই ও আমি। তাঁবুর ভেতরেই বরফ গলিয়ে গরম এক মগ স্যুপ খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে শুয়ে আছি। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৩০ ডিগ্রি। ঘণ্টায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে তুষারঝড়। মনে হচ্ছে তাঁবুসহ আমাদের উড়িয়ে নেবে। সিদ্ধান্ত হলো রাত ২টার দিকে আমরা সামিটের উদ্দেশে বের হব। ঝড় থামছেই না। প্রতি মুহূর্ত রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাটছে। এই বুঝি তাঁবু উড়ে গেল।

আমাদের আগেই পরিকল্পনা ছিল সামিট পুশ রাত ২টায় করার। কিন্তু প্রচণ্ড তুষারঝড়ের কারণে আর বের হতে পারলাম না। তাই একটু গরম চা, স্যুপ দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে রাত ৪টার দিকে হিমলুং চূড়া আরোহণের উদ্দেশে বের হলাম সাজসরঞ্জাম পরে। এ যেন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি। এদিকে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। অন্যদিকে চূড়ায় আরোহণের উত্তেজনা। এখান থেকে চূড়া পর্যন্তই খাড়া চড়াই। তাই প্রায় পুরোটা পথই দড়ি লাগানো আছে। তাঁবু থেকে বেরিয়েই দড়ির সঙ্গে সেফটি ক্যারাবিনার লাগিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। প্রচণ্ড তুষারঝড়। তুষারের ঝাপটা এসে যখন মুখে লাগে মনে হয় কাঁটা এসে বিঁধছে। তখন হাত দিয়ে তুষারের সেই আঘাত ফেরাচ্ছি। সবার আগে প্রধান শেরপা ড্যান্ডি, মুহিত ভাই, আমি আর পেছনে ঠুন্ডু শেরপা। হেডলাইটের আলোয় আমরা এগিয়ে চলেছি ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। এমন সময় হঠাৎ তুষারঝড়ে প্রচণ্ড বেগে বরফের কণা মুহিত ভাইয়ের চোখে ঢুকে যায়। মুহিত ভাইয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তিনি চোখে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন না। এর পরও সামনে এগোতে লাগলেন। একটা সময় থেমে গেলেন। চোখটা কোনোভাবেই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন নিচে নেমে যাওয়ার। আমাকে তার ব্যাগ থেকে লাল-সবুজের পতাকা, ক্লাব পতাকা এবং পৃষ্ঠপোষকদের লোগো দিয়ে চূড়া আরোহণে এগিয়ে যেতে বললেন।

লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলছেন অভিযাত্রী দল

চূড়ার মাত্র ৩০০ মিটার নিচ থেকে মুহিত ভাই ঠুন্ডু শেরপাকে নিয়ে নেমে গেলেন। আর আমার হাতে তুলে দিয়ে গেলেন বাংলাদেশের সম্মানের হিমলুং চূড়া আরোহণের দায়িত্ব। মুহিত ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে সাহস দিলেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, ‘আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন।’ মন্ত্রপাঠের মতো ভাইয়ার কথাটা মনে গেঁথে ড্যান্ডি শেরপাকে নিয়ে চূড়ার আরোহণে এগিয়ে চললাম। এত তুষারঝড় হচ্ছে, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৩৫। তখনও একবারের জন্যও মনে হয়নি সামনে আমার জন্য কতটা ভয়ংকর সময় আসছে। আমি পারব না বা ফিরে আসব কি আসব না। শুধু একটাই লক্ষ্য- আমাকে চূড়ায় যেতে হবে। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যেতে হবে।

প্রায় ১০ ফুটের একটি খাড়া দেয়াল বেয়ে ২৩ অক্টোবর নেপাল সময় সকাল ১০টা ১০ মিনেটে উঠে এলাম ২৩ হাজার ৩৮০ ফুট উঁচু স্বপ্নের চূড়া হিমলুং শিখরে। চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না। ড্যান্ডিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলাম। আমি পেরেছি মুহিত ভাইয়ের আস্থা রাখতে। আমি পেরেছি আমার প্রিয় বাংলাদেশকে সম্মান দিতে, পতাকার অহংকার তুলে ধরতে। হিমলুং শিখরে প্রায় ৭ মিনিট ছিলাম। প্রচণ্ড তুষারঝড়ের কারণে বেশি সময় সেখানে থাকতে পারিনি। তাই দ্রুত নামতে লাগলাম। আমরা দুজন দুজনের সঙ্গে ছোট একটি দড়িতে বাঁধা। চূড়ার সেই দেয়াল থেকে নামছি। ড্যান্ডি আমার আগে নামছে আর আমি নামার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ ড্যান্ডি স্লিপ করে নিচের দিকে পড়তে থাকে। দড়ির টানে আমিও পড়ে যাই। তবে আমার মাথাটা আগে পড়ে ফলে আমি গড়াতে থাকি নিচের দিকে। খাদের কিনারায় এসে ড্যান্ডি নিজেকে আটকিয়ে আমাকে পা দিয়ে ঠেকালেন। তার ক্রাম্পনের কাঁটা আমার মাংসপেশিতে বিঁধে যায়। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকার গল্প নিয়ে আস্তে আস্তে ক্যাম্প-৩তে নেমে আসি। দৌড়ে এসে মুহিত ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। শিখর জয়ের আনন্দে দুজনেই শিশুদের মতো কাঁদতে লাগলাম। দেশের জন্য জীবনের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে সফলতার প্রাপ্তির কোনো পরিমাপ হয় না।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা