শরতের টাঙ্গুয়ার হাওর
ইসতিয়াক আহমেদ
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৫৮ পিএম
আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৫৯ পিএম
নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল নামে বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর; যার মূলত দুটি রূপ নিয়েই কথা হয় সব সময়। একটি বর্ষায় ভেজা রূপ। আরেকটি শীতের শেষে বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেতে ছেয়ে যাওয়া রক্তলাল শিমুল ফুলের রূপ। কিন্তু এ দুই রূপের মাঝেই রয়েছে হাওরের আরেক মাতাল করা রূপ; যার কথা মূলত কেউ বলে না কখনোই। শরতের টাঙ্গুয়ার হাওর। পরিষ্কার নীল আকাশ, স্বচ্ছ নীল পানি আর সবুজাভ প্রকৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে প্রতি মুহূর্তে। এ যাত্রায় আমরা পুরো এক বাস ঘুরুঞ্চি বেরিয়ে পড়েছিলাম বাংলার এ রূপ গিলতে। রাত ১১টায় রওনা দিয়ে জ্যাম কাটিয়ে সুনামগঞ্জে যখন পৌঁছালাম তখন সকাল ৯টা।
এ যাত্রায় শরতের টাঙ্গুয়া ঘোরার সাথী টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম বড় ও সেরা হাউসবোট ‘মনপুরা’। আট কেবিনের এ বোটে প্রতিটি কেবিন ডোর লকসুবিধাসম্পন্ন। রয়েছে অ্যাটাচড্ ওয়াশরুম সংবলিত দুটি কেবিন। এ হাউসবোটে হাই কমোড ও লো কমোড মিলিয়ে রয়েছে মোট চারটি ওয়াশরুম। সেই সঙ্গে আছে সুবিশাল লাউঞ্জ; যেখানে ফ্রেন্ড অ্যান্ড ফ্যামিলি নিয়ে আড্ডা দিতে পারবেন ভরপুর।
মনপুরা হাউসবোটের ছাদ যেন এক সুন্দর সাজানো বাগান। গাছে ঘেরা। বসে আড্ডা আর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই হাওরের রূপ গেলার সব আয়োজন আছে এ বোটে। হাউসবোটে উঠেই সকালের নাশতা চিকেন আখনি বিরানি, সঙ্গে ডিম ভাজা, সালাদ, আচার দিয়ে সেরে নিলাম। ভরপুর ব্রেকফাস্ট শেষে উঠে পড়লাম আমরা হাউসবোটের ছাদে। ধোঁয়াওঠা চা, শীতলঠান্ডা বাতাস আর হাওরের রূপ সব মিলেমিশে যেন একাকার। শরতের হাওরের রূপে বিমোহিত হয়ে গলা ছেড়ে গান ধরল কেউ কেউ। যথারীতি ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম আমরা ওয়াচ টাওয়ারে। টাঙ্গুয়ার হাওর ট্রিপের জলকেলি করার সব থেকে বেস্ট প্লেস এ ওয়াচ টাওয়ার। হালকা স্ন্যাক্সের আয়োজন ছিল পানিতে নামার আগেই। ওয়াচ টাওয়ার ঘুরে ছুটলাম আবার টেকেরঘাটের পথে। দুপুরের খাবারের আয়োজনে ছিল বড় হাওরের মাছ, দেশি মুরগির মাংস, সবজি, ডাল, সালাদ। মনপুরা হাউসবোটে রয়েছে প্রায় ২৪ ঘণ্টা ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা। তাই লাইট, ফ্যান বা ডিভাইস চার্জ নিয়ে নেই কোনো টেনশন। টেকেরঘাট পৌঁছেই চলে গেলাম বিছানাকান্দির লাইট ভার্সন লাকমাছড়া ঘুরতে। টেকেরঘাটের খুব কাছেই লাকমাছড়া। জাফলং আর বিছানাকান্দির মতোই জলরাশি আর পাহাড়ে ঘেরা জায়গাটি। বিশাল আকারের সব পাথর পাবেন এলাকাজুড়ে। চারপাশে মেঘালয় পর্বতের সারি। ধাপে ধাপে নেমে আসা পাহাড়। সেই সঙ্গে পাহাড়ের কোলজুড়ে সাদা ঝরনার পানি নেমে আসার স্বচ্ছ ছড়া। সেখান থেকে ঘুরে এসে চলে গেলাম শহীদ সিরাজ লেকে শেষ বিকাল কাটাতে; যা কি না বিখ্যাত নীলাদ্রি লেক নামেই বেশি পরিচিত।
শরতের পরিষ্কার আকাশ সঙ্গে বাহারি রঙের মেঘের মেলা, সবুজ প্রকৃতি, সুউচ্চ পাহাড়ের অদ্ভুত মুগ্ধতায় যে আপনি হারিয়ে যাবেন সেই গ্যারান্টি দিতেই পারি। দিনের আলো নিভে এলে আমরা ফিরলাম বোটে, সন্ধ্যায় ছিল চায়ের সঙ্গে নুডলসের আয়োজন। রাতে হাওরের হাঁস, বড় মাছ ভাজা, ডাল, সবজি সালাদ, ঠান্ডা কোকের আয়োজন। ভোর হতেই নৌকা চলা শুরু করল যাদুকাটার পথে। মনপুরার ছাদে বসে চা-বিস্কুটের সঙ্গে ভোরের হালকা রোদ, ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাসে হাওরের মাঝে ছুটে চলা, যা কোটি টাকার অনুভূতি। আর তাইতো শুধু শীত বা বর্ষা নয়, শরতেও ঘুরে বেড়ানো উচিত টাঙ্গুয়ার হাওরে।
একদম স্বচ্ছ ও নীলাভ যাদুকাটা নদী আপনাকে মুগ্ধ করবেই। ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে এ স্থান দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এ নদী। দেশের খনিশিল্পে এ নদীর রয়েছে ব্যাপক অবদান। সকালের নাশতা খিচুড়ি, ডিম, সালাদ, আচার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম বারেক টিলার রুপ গিলতে। বারেক টিলা ভারত-বাংলাদেশের সীমানাঘেঁষা সেই স্থান, যেখানে পাবেন মেঘালয়ের পাহাড়, ঝরনা আর যাদুকাটা নদীর বার্ডস আই ভিউ। এরপর নৌকায় ফিরেই ছিল দেশি ফলের আয়োজন। মনপুরার বিস্তীর্ণ লাউঞ্জে ইতোমধ্যে জমে গেছে ভরপুর গানের আসর। শরতের টাঙ্গুয়ার রূপে বিমোহিত সবাই গলা ছেড়ে ধরেছে গান। দুপুরে ছিল দেশি মুরগির মাংস, হাওরের ছোট মাছ, ভর্তা, ডাল, সবজির আরেক ভরপুর আয়োজন। শরতের পরিষ্কার আকাশ, স্বচ্ছ পানি আর সবুজাভ প্রকৃতিকে বিদায় দিয়ে এবার পালা ইটপাথরের জঙ্গলে ফেরার। দেশবাসী ট্যুরে যান, ট্রেকিংয়ে যান। যেখানে মন চায় যান। যেভাবে মন চায় যান। কিন্তু প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছুই করবেন না দয়া করে। সময় পেলেই বেরিয়ে পড়ুন, ঘুরতে থাকুন, জানতে থাকুন, জানাতে থাকুন। কিপ রোমিং।