বিশ্ব নদী দিবস
সিরাজুল ইসলাম আবেদ
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৪২ পিএম
কিছুদিন আগেও নদীই ছিল আমাদের যোগাযোগের প্রধান পথ ছবি: সংগৃহীত
মানবসভ্যতার সূচনা হয় নদীকে কেন্দ্র করে। নদীতীরে চাষাবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মানুষের বসতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি। রক্তপ্রবাহের মতো যে নদী ঘিরে ছিল আমাদের দেশকে, সেই নদীকেই আমরা যেন মেরে ফেলছি প্রতিনিয়ত। বিশ্ব নদী দিবসের প্রাক্কালে বিশেষ লেখা...
নদী আমাদের প্রাকৃতিক বাস্তবতা। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সভ্যতা, শিল্প-সংস্কৃতি-কৃষ্টি এবং জীবন-জীবিকা-অর্থনীতি সবই এই নদীকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ অবস্থানগতভাবেই আমরা নদীবর্তী।
কিছুদিন আগেও নদীই ছিল আমাদের যোগাযোগের প্রধান পথ। নদীর সেচকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কৃষি এবং মিঠাপানির মাছ ঘুরিয়েছে অর্থনীতির চাকা। দিয়েছে খাদ্য, বস্ত্রের নিশ্চয়তা। সেই নদীই এখন হারিয়ে যেতে বসা দূর অতীত! নদীর অবৈধ দখল, অবৈধ ইজারা, অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ, কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যসহ মানবসৃষ্ট বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ ইত্যাদি নানাভাবে আমরা নদীকে হত্যা করে চলেছি। অনেক নদী এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকেই।
এই দখল-দূষণের প্রক্রিয়াটা শুরু হয় নদী শাসনের নামে বাঁধ তৈরির মধ্য দিয়ে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে নদীতে বাঁধ দেওয়া শুরু হয়। আশির দশকে এসে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেওয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো আমাদের নদী তথা পরিবেশের জন্য শেষ পর্যন্ত মারণফাঁদ হিসেবেই প্রতীয়মান হয়েছে।
বর্তমান শতকে দেশে শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নদীর দখল ও দূষণ বেড়েছে ব্যাপকহারে। নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রেখে দূষণ ও দখলমুক্ত রাখতে কাজ করে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ; রয়েছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। তবু দখল-দূষণ থেকে নদী রক্ষা পাচ্ছে না। নগর থেকে গ্রাম সব জায়গাতেই নদীকে আমরা ভাগাড়ে পরিণত করে সেখানে কারখানার বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা ফেলছি। শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে মাছসহ জলজ প্রাণীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে নদী শাসনের নামে অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়ায় একদিকে যেমন নদীর তীর ভাঙছে অন্যদিকে পলি জমে নাব্য হারাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ফিবছর বন্যার মতো দুর্যোগ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তও বড় ভূমিকা রেখেছে।
বর্ষায় যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর স্থানে প্রস্থ দাঁড়ায় প্রায় ১২ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে সেটা কমে আসে সাত কিলোমিটারে। তাই পরামর্শকরা সেতুটি কমপক্ষে সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে নির্মাণের পরামর্শ দেন। তা না হলে সেতুটির অবস্থান কিছুটা ভাটিতে সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলা হয় নদী শাসনকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। কিন্তু ব্যয় বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে এর কোনোটিই মানা হয়নি। দুই প্রান্তে গাইড ওয়াল দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য মাত্র চার দশমিক আট কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হয়। এতে সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয় মাত্র ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অথচ গত দুই দশকে নদীর দুই তীর ও সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট রক্ষায় এর কয়েকগুণ বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে।
২০১০ সালে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে নদী শাসনের পরিকল্পনায় যমুনার অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করা হয়। নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত সে মূল্যায়ন কার্যক্রমে যমুনা নদী শাসনের বিভিন্ন দিক উঠে আসে। ‘পারফরম্যান্স রিভিউ অব যমুনা ব্রিজ রিভার ট্রেনিং ওয়ার্কস ১৯৯৭-২০০৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যমুনার দুই তীরে নির্মিত গাইড ওয়াল সেতুটির দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার কমিয়ে দিয়েছে। এটা অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হলেও এখন এর কুফল দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া গাইড ওয়ালের গভীরতাও কম। এতে সেতুর অবস্থান ও সংযোগ সড়ক রক্ষা হলেও তীরের ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না।
বিগত শতাব্দীর আশির দশকে এলজিইডি সারা দেশে ব্যাপকভাবে রাস্তা তৈরি করে। দাতা সংস্থাগুলোও তাদের দেশের গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্র হিসেবে প্রকল্পগুলোতে ঋণ সুবিধা দেয়। সে সময় কম খরচের বাহানায় বিভিন্ন নদী ও খালে উঁচু ব্রিজের পরিবর্তে অসংখ্য কালভার্ট তৈরি হয়। ব্রিজ তৈরি করা হলেও সেগুলো নদীর প্রশস্ততার তুলনায় ছোট এবং নিচু করে তৈরি করা হয়। এই কালভার্ট বা নিচু ব্রিজ দিয়ে আটকে দেওয়া হয় আমাদের হাজার বছরের সহজ এবং সুলভ নৌ-যোগাযোগ। শুধু গতির সুবিধা নিতে গিয়ে আমরা আমাদের অমূল্য সম্পদ নদীকে অবহেলা, কখনও অস্বীকারও করেছি। শুধু এলজিইডি নয়, কখনও কখনও সড়ক বিভাগও একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
কয়েক বছর আগে সাতক্ষীরা যাওয়ার সুযোগ হয়। প্রসঙ্গক্রমে স্থানীয় পরিবেশকর্মী অধ্যক্ষ আশেক-এ-এলাহী তখন বলেছিলেন, জেলার অন্যতম নদী ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ আদি যমুনা ইজারা দেওয়ার ঘটনা। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি অসৎ কিছু সরকারি কর্মকতার যোগসাজশে নদীটিকে বদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে মোট পাঁচ খণ্ডে ইজারা নেয়। স্থানীয়দের নিয়ে পরিবেশকর্মীদের আন্দোলন এবং আইনি লড়াই শেষে নদীটি অবৈধ ইজারাদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়। কিন্তু এর মাঝে আরও কিছু ঘটনাও ঘটে। বিভিন্ন স্থানে নদী দখল হয়ে যায়। কাকশিয়ালীতে ৮০ ফুট প্রস্থের নদীতে ৩০ ফুটের স্লুইসগেট বসিয়ে নদীর টুঁটি চেপে ধরা হয়। একইভাবে সড়ক বিভাগ একাধিকবার নদীর ওপর দিয়ে ক্রস হওয়া রাস্তায় কোথাও ছোট কালভার্ট দিয়ে দায় সেরেছে, আবার কোথাও সেই প্রয়োজনও বোধ করেনি; পানির ধারা আটকে দিয়ে সরাসরি নদীর ওপর দিয়েই রাস্তা নিয়ে চলে গেছে। বর্তমানে কালীগঞ্জ থেকে শ্যামনগর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার নদী ৮০ ফুট প্রস্থ হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬০ ফুট প্রস্থে খনন করেছে। স্থানীয়দের ভাষায় যা নদীটিকে নর্দমায় পরিণত করেছে।
প্রায় একই অবস্থা ঘটে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার নদীর ক্ষেত্রেও। নদীটিকে বদ্ধ বিল দেখিয়ে অমৎস্যজীবীদের কাছে লিজ দেওয়া হয়। এলজিইডি নদীর ওপর দিয়ে সরাসরি রাস্তা তৈরি করে দখলদারদের আরও সুবিধা করে দিয়েছে। পরিবেশবিদ এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, হাইকোর্টের রায়ের পর অমৎস্যজীবীদের কাছে লিজ দেওয়া ১৪১ একর নদী উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের দখলে এখনও প্রায় দেড়শ একর নদী রয়ে গেছে। চাকিরপশার ছাড়াও তুহিন ওয়াদুদের সঙ্গে পরিদর্শনের সুযোগ হয় তার ভাষায় পৃথিবীর ‘সরুতম নদী’ সর্বমঙ্গলা। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শহরে ঘেঁষে অবৈধ দখলে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সর্বমঙ্গলা আমরা একলাফে পার হয়ে গেলাম। অবিশ্বাস্য বিষয়, দুই ফুট প্রস্থের নদীটিতে তখনও জলের ধারা ছিল।
বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা কত, তারও নেই কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান। একেক অধিদপ্তর পরিদপ্তরের কাছে একেকরকম সংখ্যা। লোকায়ত ভাষ্য অনুসারে বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা ‘তেরশ’। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে কখনও তিনশ, কখনও চারশ আবার কখনও সাতশ নদীর উল্লেখ আমরা পাই। সম্প্রতি, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন বাংলাদেশের নদীর একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে নদীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০৭টি। কমিশনের এই খসড়া তালিকায় রংপুর বিভাগে ১২১টি নদীর নাম রয়েছে। কিন্তু তুহিন ওয়াদুদ সম্প্রতি নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে আরও ১০৫টি নদীর নাম জমা দিয়েছেন। যার মধ্যে ৬৩টি নদীর ছবিসহ বর্ণনা দিয়েছেন। ১৬টি নদীর রয়েছে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। আরও ১৬টি নদীর শুধু নাম উল্লেখ করেছেন। তুহিন ওয়াদুদের দেওয়া এই তালিকা প্রমাণ করে নদী কমিশনের দেওয়া নদীর খসড়া সংখ্যা আর দেশের প্রকৃত প্রস্তাবে নদীর সংখ্যার মধ্য এখনও বেশ গরমিল। এটাও কিন্তু দখলপ্রক্রিয়াকে শক্তি জোগাবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে প্রভাবশালীরা প্রভাব খাটিয়ে নদী ও খালের জমি দখল করে বাড়ি, কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্নরকম স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এমনকি নদীর তীরবর্তী স্থানে অবৈধভাবে বসানো হয়েছে হাটবাজারও।
বছর দেড়েক আগে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছিলেন, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন সব জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে দেশের নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা করেছে। তালিকা অনুযায়ী সারা দেশে ৬৫ হাজার ১২৭ জন অবৈধ নদী দখলদার রয়েছেন। অভিযোগ আছে, নদী-খালের জমি দখলদারদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনীতির যোগসাজশেই এসব হয়েছে। সম্প্রতি, নদী কমিশন ৪৮টি নদী দখলে ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে তাদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ করলেও বিস্ময়করভাবে পরে তালিকাটি মুছে ফেলা হয়। এসব ঘটনা ক্রমেই নদীকে হারিয়ে যেতে সহায়ক হিসেবেই কাজ করবে। কোনো নদী হয় তো থেকে যাবে রূপকথার গল্প হয়েই।
একটি নৌকা ভ্রমণের গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। নওগাঁ শহর থেকে আমরা যাব রবীন্দ্রনাথের জমিদারির কাছারি বাড়ি পতিসরে। শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ছোট যমুনা নদী দিয়ে ছিল যে যাত্রা। শহর ছাড়ার আগেই চোখে পড়ল নদীর পাড়ে মাঠ পেরিয়ে সুলতানপুর জমিদারবাড়ি। যেটা বর্তমানে সুলতানপুর ক্লাব নামে পরিচিত। খানিক পরেই আমরা শৈলাগাছিতে নদীর পাড়েই আরেকটি জমিদারবাড়ি পেলাম। আরও পরে পড়ল কাশিমপুর ও মির্জাপুরের জমিদারবাড়ি। ব্রিটিশ আমলে তৈরি সব জমিদারবাড়িই নদীমুখী। আমাদের নৌকা ছোট যমুনা থেকে আত্রাই হয়ে একসময় নাগর নদে প্রবেশ করল। আঁকাবাঁকা ছোট নাগর দিয়ে যখন পতিসর পৌঁছলাম, নৌকা থেকে কাছারি বাড়ির সিংহদুয়ার দেখা যাচ্ছিল। সামনে দুটি প্রাচীন পাম ট্রি তখনও সাক্ষ্য দিচ্ছিল মাঠটিতে একসময় বাগান ছিল। রবীন্দ্রনাথ বজরা থেকে নেমে সেই বাগান পেরিয়ে কাছারি বাড়িতে প্রবেশ করতেন।
অর্থাৎ, ভ্রমণযাত্রায় প্রাচীন যতগুলো ভবন আমরা দেখেছি সবই ছিল নদীমুখী। তখন নদী ছিল প্রয়োজনের, নদী ছিল জীবন্ত, নদী ছিল স্রোতস্বিনী। যোগাযোগব্যবস্থায় যখন পরিবর্তন এলোÑ নদীপথের সংস্কার না করে আমরা সড়কপথ করলাম। ফলে আমাদের বাড়ির মুখ ঘুরে যায়। নদীর দিকে সদর দরজার পরিবর্তে টয়লেট স্থান পেয়েছে। হারিয়ে গেছে নদীর ঘাট। নদী এখন যেন ভাগাড়।
১৯৮০ সাল থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার ‘বিশ্ব নদী দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। নদীরক্ষায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়। উদ্দেশ্য মানুষকে নদীরক্ষায় সচেতন করা। নদীকে উচ্চ আদালত এরই মধ্যে ‘জীবন্ত সত্তা’ বলে রায় দিয়েছেন। আমাদের জীবনে নদী অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা জীবনাচারের মাধ্যমে ক্রমাগত নদীকে মেরে ফেলায় লিপ্ত রয়েছি। তাকে জোর করে শাসন করতে চাইছি। বেঁধে ফেলতে চাইছি। আমাদের এই আচরণ যদি চলতেই থাকে, একদিন নদী কিন্তু ঠিকই তার পথ দেখে নেবে।