× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইশারা ভাষা

বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে যাক

আহসান হাবিব

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৩৫ পিএম

বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে যাক

মানুষে মানুষে যোগাযোগ স্থাপনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ভাষা। যারা কথা বলতে কিংবা শুনতে পায় না তাদের জন্য তৈরি হয়েছে ইশারা ভাষা। দেশে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। ভাব প্রকাশের প্রতিবন্ধকতার কারণে এই মানুষগুলো সমাজের মূলধারার সঙ্গে মিশতে পারে না, বঞ্চিত হচ্ছে প্রাপ্ত অধিকার থেকে। ইশারা ভাষা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে যথেষ্ট উদ্যোগ। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কিছু বাধা থেকেই যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত...


অন্যান্য ভাষার মতোই যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় ভাষা– ইশারা ভাষা। হাত, হাতের আঙুলের ভঙ্গি এবং চোখ-মুখের অর্থবহ নির্যাসই হলো ইশারা ভাষা বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। অনেকে একে সাংকেতিক ভাষাও বলেন। শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষই মূলত এ ভাষায় যোগাযোগ করেন।

ইশারা ভাষার সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো, এ ভাষা চোখে দেখা যায়। যোগাযোগ স্থাপনে ব্যবহৃত আর অন্য কোনো ভাষাই আমরা দেখতে পাই না। এটাই এ ভাষার সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা, যা সবাইকে মুগ্ধ করে প্রতিনিয়ত।

আমাদের দেশের শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষ সচরাচর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন ভাষার কারণে। বলা চলে, এরা ইশারা ভাষা জানেন না বলেই বিচ্ছিন্ন এবং বঞ্চিত হচ্ছেন স্বাভাবিক মানুষ যে সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন, তা থেকে। স্বাভাবিক একজন মানুষ এবং শ্রবণ বা বাক প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে দূরত্ব বলি বা পার্থক্য বলি, সেটা হলো শুধুই ভাষাগত। অথচ ইশারা ভাষার মতো মনোমুগ্ধকর সুন্দর ভাষাটি শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করতে পারে খুব সহজে।


ইশারা ভাষা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৩ সেপ্টেম্বরকে ইন্টারন্যাশনাল সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ডে বা আন্তর্জাতিক ইশারা ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর প্রধানতম কারণ শুধুই ভাষাগত পার্থক্যের জন্য শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের মানবাধিকর যেন লঙ্ঘিত না হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর যোগাযোগের একমাত্র ভাষা ইশারা ভাষা।

বলা বাহুল্য, পৃথিবীতে মানুষের মুখের ভাষা সৃষ্টির আগেই সৃষ্টি হয়েছিল ইশারা ভাষার। তবে ১৭ শতাব্দীতে প্রথম ইশারা ভাষার বর্ণ বা লেটার সৃষ্টি হয় পশ্চিমা বিশ্বে। বর্তমানে বিশ্বের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা। মার্কিন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ এবং ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজকে (ASL & BSL) মৌলিক ধরে বিভিন্ন দেশে সৃষ্টি হয়েছে আলাদা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা।

বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কানে শুনতে পান না, কথাও বলতে পারেন না। তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ইশারা ভাষা। আমাদের দেশের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা বাংলা ইশারা ভাষায় মনের ভাব আদানপ্রদান করেন। দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত থাকায় ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের একটা বড় প্রভাব রয়েছে বাংলা ইশারা ভাষার ওপর। বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তর জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এ ভাষা এবং এ ভাষার মানুষ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রতিবন্ধী মানুষ ও ইশারা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিকে ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ United nations Convention on the rights of the persons with Disabilities (UNCRPD) অনুসমর্থন করে স্বাক্ষর করেছে এবং পরে ইউএনসিআরপিডির আলোকে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ পাস করে বাংলাদেশ সরকার। এ আইনে ইশারা ভাষা এবং এ ভাষার মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবারের সঙ্গে থাকা, সমান আইনি সুবিধা ও কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়ার কথা রয়েছে। আইনে থাকলেও বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই এর সফল প্রয়োগ দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ তারা ইশারাভাষী অর্থাৎ ভাষাগত পার্থক্য। যদিও এ বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের আন্তরিকতা প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার।

ইশারা ভাষা সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে সঠিক ধারণার অভাব রয়েছে। এটা যে একটি পরিপূর্ণ ভাষা তা অনেকেরই জানা নেই। এ ভাষার মানুষকে আমরা ‘বোবা-কালা’ ইত্যাদি নামের সিলমোহর দিয়ে সমাজ থেকে আলাদা করে দিয়েছি। অধিকাংশ মানুষের ধারণা, তারা কিছু বোঝে না বা পারে না। অথচ তারা সব বোঝে, সব পারে; এমনকি অনেকাংশ স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও ভালো। তাদের ভাষা আমরা বুঝি না, বলা উচিত বুঝতে চাই না। আমাদের এ অপারগতা বা ব্যর্থতার কারণে বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষ। কিন্তু আমরা কখনও কি ভেবেছি, ভাষাগত পার্থক্যই যদি সমস্যার কারণ হতো তাহলে পৃথিবীতে হয়তো এত ভাষার অস্তিত্ব থাকত না। ভাষার জন্য কেউ জীবন দিত না। সবাই একটি ভাষাকেই বেছে নিত। আধুনিক যুগের এই সময়ে এসে বলতে চাই, মানুষে মানুষে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।


বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান কেয়া কসমেটিক্স এবং কেয়া নিট কম্পোজিট ১ হাজার ২০০-এর অধিক শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীর কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। বরং মালিক পক্ষকে সন্তুষ্টই বলা যায়, যদি তা না হতো, তাহলে দুই যুগের বেশি সময় ধরে উৎপাদন ঠিক রেখে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীরা এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারতেন না।

ইশারা ভাষা বিশ্বের শ্রবণ ও বাক প্রতিববন্ধীদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম। ইশারা ভাষার মাধ্যমেই তাদের সমাজের মূলধারায় যুক্ত করা সম্ভব। ইশারা ভাষার মাধ্যমেই তাদের অধিকার নিশ্চিত হবে। আপনার শিশুর সঙ্গেও ইশারা ভাষার মাধ্যমে আপনার সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব। শিশুদের শব্দভান্ডার বৃদ্ধি করতে ইশারা ভাষা দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এ ভাষা ও এ ভাষার মানুষের প্রতি সাধারণের ধারণা বদলে এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে বেশি বেশি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পোস্টার-লিফলেট ও ভিডিও ডকুমেন্টেশন সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়াও সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইশারা ভাষার দোভাষীর ব্যবস্থা থাকলে একদিকে যেমন ইশারা ভাষার প্রচার পাবে, অন্যদিকে এ ভাষার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া নাটক, থিয়েটার, টেলিভিশনসহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইশারা ভাষায় আয়োজন করা। এ ভাষাকে ভালোবাসলেই একটি বিশাল জনগোষ্ঠী সমাজের মূলধারায় ফিরে আসবে, মুক্তি পাবে আজন্ম বৈষম্য থেকে।

ইশারা ভাষা দিবসের প্রাক্কালে পৃথিবীর সব শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য রইল ইশারা ভাষার শুভেচ্ছা।


লেখক : ইশারা ভাষা সংবাদ উপস্থাপক বাংলাদেশ টেলিভিশন ও ইশারা ভাষা প্রশিক্ষক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা