টিএইচ মাহির
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:২৭ পিএম
আদিম যুগ থেকেই মানুষ পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য ইশারা ভাষা ব্যবহার করে আসছে
মানুষের মনের ভাব বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম ভাষা। কণ্ঠ, জিব, মুখ ব্যবহার করে মানুষ কথা বলতে পারে। কিন্তু যারা কথা বলতে পারে না তারা কীভাবে মনের ভাব বিনিময় করে? যারা কথা বলতে পারে না বা বধির তারা ব্যবহার করে সাংকেতিক ভাষা। ইশারা ভাষার মাধ্যমে বধির ও বোবা মানুষ মনের ভাব বিনিময় করে। একে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজও বলা হয়। হাত, আঙুলসহ দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাহায্যে এ ভাষা ব্যবহার করা হয়। মুখের অভিব্যক্তি, কাঁধের ওঠানামাও এ ভাষায় যোগাযোগে ভূমিকা রাখে।
সাংকেতিক ভাষার ইতিহাস পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে। তবে আদিম যুগ থেকেই মানুষ পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য ইশারা ভাষা ব্যবহার করে আসছে বলে ধারণা করা হয়। তবে মার্জিত ইশারা ভাষার বর্ণমালার আবির্ভাব বেশি পুরোনো নয়, পঞ্চদশ শতকে স্প্যানিশ সন্ন্যাসী পেড্রো পন্স ডি লিওন প্রথম এ ভাষার বর্ণমালা তৈরি করেছিলেন। যদিও তা পুরোপুরি বোবা ও বধিরদের জন্য ছিল না। ১৬২০ সালে জুয়ান পাবলো বোনেট মাদ্রিদে Reducción de las letras y arte para enseñar a hablar a los mudos নামে একটি সাংকেতিক ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের বই প্রকাশ করেন। ফরাসি চার্লস-মিচেল দে ল’পেই অষ্টাদশ শতকে তার ইশারা ভাষার বর্ণমালা প্রকাশ করেছিলেন, যা বর্তমান সময়ে ফ্রান্স এবং উত্তর আমেরিকার অনেকাংশে অপরিবর্তিত রয়েছে।
বিভিন্ন দেশের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সাংকেতিক ভাষা বা ইশারা ভাষা আছে। এ ভাষাগুলো উদ্ভব হয় কথ্যভাষা থেকে। ইশারা ও কথ্য ভাষার সম্পর্ক দেশ এবং সেখানকার ভাষার ওপর নির্ভর করে। বিভিন্ন দেশের মতোই ভিন্ন ভিন্ন থাকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজও। যেমন ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (BSL) মার্কিন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (ASL) থেকে ভিন্ন। মার্কিন ইশারা ভাষা আবার উদ্ভব হয়েছিল ফ্রেন্স ইশারা ভাষা বা FSL থেকে। ফ্রেন্স ইশারা ভাষা নিয়ে অষ্টাদশ শতকে কাজ করেছিলেন শিক্ষাবিদ চার্লস-মিশেল। এ ভাষাকে LSF বা Langue des Signes Françaiseও বলা হয়। তবে মার্কিন এবং ব্রিটিশ ইশারা ভাষা থেকে তৈরি হয়েছে অনেক দেশের ইশারা ভাষা।
আমাদের দেশের মূক ও বধির মানুষ বাংলা ইশারা ভাষা ব্যবহার করে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের আলোকে চালু হয় বাংলা ইশারা ভাষা। জাতীয় বধির সংস্থা এ দেশে সর্বপ্রথম বাংলা ইশারা ভাষা ও বিধান প্রণয়ন করে। জাতীয় বধির সংস্থা ১৯৯৪ সালে এ ভাষার জন্য ছবিসহ একটি ডিকশনারি প্রকাশ করে। তা ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এ ভাষা শেখানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম করে থাকে। বাংলা ইশারা ভাষার শেখার জন্য কোর্সও আছে। তা ছাড়া জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা বাংলাদেশের শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংস্থাগুলোর উন্নয়নে কাজ করে। ২০০৯ সাল থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় বাংলা ইশারা ভাষা দিবস। তবে ২০১৮ সাল থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক ইশার ভাষা দিবস বা International day of sign languages।
ইশারা ভাষার মূলভিত্তি মুখের অভিব্যক্তি, মাথার নড়াচড়া, হাতের চিহ্ন। এখানে অনেক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় দৃশ্যমান সাদৃশ্যের সঙ্গে। যেমন হরিণ বোঝাতে মাথার উভয় পাশে হাত উঁচু করে আঙুল ছড়ানো থাকবে। ‘খাও’ বোঝাতে হাতের আঙুল একত্র করে মুখের সামনে এনে বোঝানো হয়। যেমনটা খাওয়ার সময় মানুষ হাত ব্যবহার করে। ইংরেজি বর্ণমালার জন্য মার্কিন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের নির্দিষ্ট চিহ্ন আছে। যেমন A বর্ণটি বোঝাতে হাত মুঠো করে সামনে ধরা হয়। তবে বাক্যে ব্যবহারের জন্য ক্রিয়াপদ, সর্বনাম বোঝাতে চিহ্ন ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজেরও শিষ্টাচার, নির্দিষ্ট ব্যাকরণ আছে; যা মানুষের মনের ভাব প্রকাশে আরও সাহায্য করে।