কালো মানুষের আলো
আমিরুল আবেদিন
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৩৩ পিএম
গ্র্যানভিল টি উডস
আধুনিক বিজ্ঞান কিংবা উদ্ভাবনেও রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের দারুণ অবদান। গ্র্যানভিল টি উডস- তড়িৎ প্রকৌশল নিয়ে কাজের পাশাপাশি যার রয়েছে ৪৫টি উদ্ভাবন। ‘ব্ল্যাক এডিসন’ হিসেবে পরিচিত এই মানুষটির জীবনও আনন্দদায়ক ছিল না...
পুরো নাম গ্র্যানভিল টি উডস। তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রকৌশল বাদেও তড়িৎক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা ও আবিষ্কারধর্মী কাজের জন্য সতেরো শতকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। রাতারাতি কৃষ্ণাঙ্গ মহলে ‘ব্ল্যাক এডিসন’ বলে পরিচিতি পান। মনে হতে পারে কালোদের এডিসন নামটি ভীষণ সম্মানের। কিন্তু এ নামটিই তার জন্য বেদনাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ জীবনের সিংহভাগ সময় এবং অর্জিত অর্থ মামলার লড়াইয়ে ব্যয় করতে হয়েছিল তাকে।
১৮৮৪ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত তার ২৭টি আবিষ্কারের প্যাটেন্টকে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটেন্ট অফিস। তার আবিষ্কারের অধিকাংশই রেল খাতের সঙ্গে জড়িত। উডস সর্বপ্রথম ইনডাকশন টেলিগ্রাফ নামে একটি কমিউনিকেশন সিস্টেম তৈরি করেন। ওই সময় রেলকর্মীদের যোগাযোগ করার সুবিধা ছিল কম। ফলে একই স্টেশনে দুটি ট্রেন যাত্রা করলে সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কাও ছিল অনেক। ইনডাকশন টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের পর যোগাযোগের এ সংকট দূর হয়।
এ যন্ত্রে রেলগাড়ির নিচে একটি কয়েল লাগিয়ে রাখা হতো। রেল চলার সময় কয়েলটি ঘুরত এবং ঘূর্ণনের ফলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হতো। ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হওয়ায় টেলিগ্রাফ থেকে বার্তা সহজে পৌঁছে যেত। এ আবিষ্কারের পর উডস প্যাটেন্ট জমা দেওয়ার সময় পেলেন না। বসন্তে আক্রান্ত হন তিনি। ততদিনে এই উদ্ভাবন অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
লুসিয়াস ফেলপ্স নামে এক ব্যক্তি সায়েন্টিফিক আমেরিকান জার্নালে আবিষ্কার নিজের বলে দাবি করেন। উডস এ নিবন্ধ পড়ে দ্রুতই ডিজাইন শেষ করে প্যাটেন্টের আবেদন করেন। পাশাপাশি প্রথমে কে আবিষ্কার করেছেন তা তদন্তেরও আবেদন করেন আদালতে। উডস নোট, স্কেচ আর টুকিটাকি তথ্য রেখেছিলেন। ১৮৮৭ সালে প্যাটেন্টটি তার নামে করা হয়। পরে ৪৫টি আবিষ্কারের মধ্যে অন্তত ডজনখানেক আবিষ্কারের প্যাটেন্টের স্বত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
মার্জিত বাচনভঙ্গি ও পোশাকে সুরুচির পরিচয় দেওয়া উডস সহজেই মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতেন। ওই সময় কৃষ্ণাঙ্গরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ পেত না। তড়িৎ প্রকৌশলের মতো জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করবে কোনো কালো মানুষ, তা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পর্যায়ে ছিল অবিশ্বাস্য ব্যাপার। উডসের মতো স্বশিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ এ কারণে অনেকেরই বিস্ময় আদায় করে নিত।
এডিসন, আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল, জর্জ ওয়েস্টিংহাউসের মতো আবিষ্কারকের পাশে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করে ফেলছিলেন উডস। কিন্তু কালো হওয়ার অপরাধে সারা জীবন মেধার স্বীকৃতি ও প্যাটেন্টের স্বত্ব আদায়ের লড়াই করতে গিয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন।
উডসের মৃত্যুর সময়টিও বিবর্ণ। তার মৃত্যুর পর সামাজিক বৈষম্যের ছত্রছায়াই তাকে দীর্ঘদিন কালের অতলগহ্বরে দাবিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ‘ব্ল্যাক এডিসন’ নামটি আবার পরিচিতি পায়। উডসের জীবনী লেখার সময় রেভন ফোস বলেছিলেন, ‘উডসের জীবন আমেরিকান স্বপ্নের ধারে কাছেও ছিল না। বরং তার জীবন আমেরিকান স্বপ্নের এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। যদিও আগামী ভবিষ্যতে আমেরিকান স্বপ্নের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠবেন।’