নাজমুল করিম ফারুক
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৩৫ পিএম
রাংপানির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বড় বড় পাথর
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সারি সারি পাহাড়ঘেরা সিলেটের জৈন্তাপুর। এসব পাহাড় থেকে বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ি পানি উজানের মতো নেমে আসে বাংলাদেশে। আর এই পানিপ্রবাহে সৃষ্টি হয়েছে অনেক নদী কিংবা ছড়াপথ। যেমন বিছানাকান্দি, সাদাপাথর, জাফলং, পান্থমাই, সংগ্রামপুঞ্জির মতো দর্শনীয় স্থান। তবে এগুলোর মতো আরেকটি পর্যটন স্পটের সন্ধান পাওয়া গেছে জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুর গ্রামসংলগ্ন মোকামপুঞ্জির কাছে, যার নাম রাংপানি।
অনেক দিন ধরে একটা প্ল্যান মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সিলেটের লালাখাল থেকে সীমান্ত পথে হেঁটে জাফলং যাওয়া। দিনক্ষণ ঠিক করা হয়ে গেছে। ১৫ আগস্ট, ছুটির দিন। আগের দিন সুনামগঞ্জের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দর্শন করে সন্ধ্যার মধ্যে সিলেট ফিরে আসি। পরদিন ভোরে মাজার গেটে। জাফলংয়ের গাড়ি ধরে লালাখাল বাসস্টেশন। অটোরিকশাতে চড়ে আমরা ছয়জন রওনা হলাম লালাখালের নৌকাঘাটে। পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা তখন ১১টা। তার ওপর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি।
পানিতে কানায় কানায় ভর্তি সারি নদী। লালাখালের একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য হলো এখানে সারি ও গোয়াইন নদী মিলিত হয়েছে। দুটি নদীর পানির রং ভিন্ন। ট্রলারের মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে মাথায় ভাঁজ পড়ল। তারা জানিয়ে দিলেন সম্ভব না। অনেকগুলো খাল ও ছোট ছোট নদী পড়বে। যেগুলো সাঁতার কেটে যেতে হবে। আমাদের মধ্যে তাসকিনুর পূর্ণ ও ইমন ইশতিয়াক সাঁতার জানে না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলোÑ রাংপানিতে যাব। যত বাধাই থাকুক। বাধা বলতে আমরা যতটুকু জানি সেখানে স্থানীয় লোকজন সাধারণ পর্যটকদের যেতে নিরুৎসাহিত করেন। কারণটা অবশ্যই অজানা। কিন্তু আমরাও কারণটা বের করতে চাই।
ফের লালাখাল বাসস্টেশন এসে জাফলংয়ের বাস ধরি। জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে শ্রীপুর বাজার পার হয়ে ছোট মোকামপুঞ্জি স্টেশনে নেমে পড়ি। এই স্টেশনে ছোট্ট একটি যাত্রীছাউনি রয়েছে। স্থানীয় কয়েকজনকে রাংপানি যাওয়ার রাস্তার কথা বললেও চেনেন না বলে জানান। যাক, আমরা তো নাছোড়বান্দা। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম মোকামপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। এক ধারে সবুজ চা বাগান, আরেক ধারে স্বচ্ছ সবুজ গাছগাছালি ঘেরা বসতি। মোকামপুঞ্জি গ্রামে প্রবেশের দুটি গেট। গেটের সামনে খেলা করতে ছিল ৭-৮ বছরের তিন ছেলে। তাদের রাংপানির কথা জিজ্ঞাসা করতেই তারা বলল, আমরা নিয়ে যাব। যেই কথা সেই কাজ। বামদিকে লোহার গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম মোকামপুঞ্জি গ্রামে।
গেটের একটি নামফলকে লেখাÑ ‘মোকামপুঞ্জি খাসিয়া আদিবাসী, আমাদের পেশা সুপারি আর পান’। সতর্কমূলক একটি দেয়ালচিত্র তাতে লেখা- ‘রাত ৮টার পর পুঞ্জির মধ্যে বহিরাগত প্রবেশ বা থাকা নিষেধ’। ভেতরে প্রবেশ করে লেখার সঙ্গে পরিবেশের মিল পেলাম। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় সারি সারি সুপারিগাছ; সুপারিগাছের গোড়া থেকে আকাশ অবধি লতায় জড়ানো পান। গাছগুলো জুড়ে বিভিন্ন সাইজের পান শোভা পাচ্ছে। অনেকে আবার এগুলো পরিচর্যা করছেন। আদিবাসীদের পরিবেশের সঙ্গে কখন যেন মনটা মিলিয়ে গেল টেরই পেলাম না। গ্রামের একপ্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে অন্যপ্রান্তে গিয়ে যখন হাজির, তখন চোখ ছালাফালা।
বিশাল জলরাশির এক পাশে আরেক বিছানাকান্দি, আরেক সাদা পাথর! সামনে অগ্রসর হতেই স্থানীয় অনেকে সেখানে যেতে বারণ করেন। কারণ হিসেবে উপস্থাপন করেন রাংপানি মূলত ভারতের এরিয়া। তাই সেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ। অনেকে আবার ছবি তুলতে নিষেধ করেন। আমরা ছবি তুলে তা যদি প্রচার করি তাহলে তাদের পাথর বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবেÑ এমন সব অজুহাত। কিন্তু আমাদের গন্তব্যে যাওয়া চাই। কখনও কোমর, কখনও বুকসমান পানি অতিবাহিত করে অবশেষে রাংপানির রাজ্যে নিজেদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করলাম। মেঘালয় পাহাড় থেকে ঝরনা হয়ে ধেয়ে আসছে পানির ঢল, সেই সঙ্গে নিয়ে আসছে পাথর। পাথর উত্তোলন করে নৌকায় ভর্তি করতে ব্যস্ত স্থানীয় লোকজন।
মেঘালয় জৈন্তা পাহাড়ের রংহংকং জলপ্রপাত থেকে স্বচ্ছ জলের রাংপানির উৎপত্তি। আশি ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকাই চলচ্চিত্রের একাধিক ছবির শুটি হয়েছে এখানে। বিশেষ করে শাবনাজ-নাঈম জুটির প্রথম ছবি চাঁদনীর জনপ্রিয় গান ‘ও আমার জান, তোর বাঁশি যেন জাদু জানে রে’-এর বেশ কিছু দৃশ্য এখানে ধারণ করা। রাংপানির দূরের পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়া প্রাকৃতিক ঝরনাটি আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। মন চাই ছিল ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু বিধিবাম। সেটা মেঘালয় রাজ্যের অনেক ভেতরে। শেষ পর্যন্ত রাংপানির দর্শন নিয়ে সেই দূরের ঝরনা স্পর্শের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ফিরতে হয়েছে। ততক্ষণে ক্ষুধার রাজ্য গদ্যময় হয়ে উঠেছে।
কীভাবে যাবেন
দেশের যেকোনো স্থান থেকে সিলেটে আসতে হবে। শহর থেকে সিলেট-তামাবিল সড়কে বাস, লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় অথবা ব্যক্তিগত গাড়িতে সরাসরি যাওয়া যায় জৈন্তাপুরের শ্রীপুরে। শ্রীপুরের চা বাগানের উল্টোদিকে ধরে সরু পথ পাড়ি দিলেই মোকামপুঞ্জি। খাসিয়াদের মোকামপুঞ্জির ভেতর দিয়ে গেলেই পেয়ে যাবেন রাংপানি নদী।
কোথায় খাবেন
সিলেট-তামাবিল সড়কের জৈন্তাপুর বাজার, জাফলং মামার বাজারে বেশ কিছু মধ্যম মানের খাবারের হোটেল পাবেন। দুপুরের খাবার সেখানে সেরে নিতে পারেন। বর্তমানে জাফলং জিরো পয়েন্টেও বেশ কিছু খাবারের হোটেল রয়েছে।