× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কর্মক্ষেত্রে নারী কতটা নিরাপদ?

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৫৪ পিএম

কর্মক্ষেত্রে নারী কতটা নিরাপদ?

 বিভিন্ন পেশায় কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। দেশের জিডিপিতেও নারী  শ্রমের অবদান কম নয়। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও কর্মস্থলে তারা কতটা  নিরাপত্তা পেয়ে থাকে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাস্তবতার নিরিখে বিস্তারিত...

মাস্টার্স পাস করে সম্প্রতি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন সামিয়া। ইন্টারভিউ বোর্ডের এক সদস্য কেমন একটা হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে কাজ শেষ করতে রাত হতে পারে। পারবেন তো?’ সামিয়া একদমই গায়ে মাখেননি এসব। দুয়েকদিন তো রাত হতেই পারে। এ আর এমন কী! জয়েনিংয়ের দিন সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। কিছু মানুষ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। কেউ আবার অহেতুক গল্পও জুড়ে দিয়েছিল। অন্য ডেস্কে তেমন কেউ না থাকলেও সামিয়ার ডেস্কে এ-ও এসে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মুখ ফুটে বলতেই হয়, ‘এখন আসেন। আমি একটু ব্যস্ত’। আবার বসের রুমে গেলে বসিয়ে রাখেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাঝে মাঝে ফাইল নেওয়ার সময় বসের হাতে হাত লেগে যায়। এমন কেন হয়, সামিয়া বুঝে উঠতে পারেন না। তার ভয় হয়। নতুন চাকরি। ভাবছিলেন, এ ব্যাপারগুলো শুধু কি তার বেলায়ই হচ্ছে। নাকি এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য ভাবনার অবসান ঘটতে বেশিদিন লাগে না। বস একবার বলেই বসলেন, সারাক্ষণ এত কী কাজ! চলেন একটু বেড়িয়ে আসি। আমার একটা সুন্দর বাগানবাড়ি আছে। সামিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। অনেক কষ্টে চাকরি জুটিয়েছেন। বাসায় বৃদ্ধ মা-বাবা, আছে ছোট ভাইবোনও। কী করবেন ভেবে পান না।

মুনার কথাই শোনা যাক। সহকর্মীরা যখন তখন বিরক্ত করে। কাজ বেশি করলেও বসের কথা শুনতে হয়। নারী বলেই এমন কি না জানেন না তিনি। 

প্রমোশনের ক্ষেত্রে নারী কর্মজীবীরা সঠিক মূল্যায়ন কমই পান। আট বছর চাকরি করার পর মাত্র একটি প্রমোশন হয় কেয়ার। অথচ একই সময়ে অন্য যারা যোগ দিয়েছেন তাদের তিনবারও প্রমোশন হয়েছে। তার কথায় রাজ্যের আক্ষেপ। প্রতিবাদ করেন না কেন? তিনি বলেন, প্রতিবাদ? তাহলে তো চাকরিই থাকবে না!


গার্মেন্ট কর্মী রাশেদা। সুপারভাইজার কাজ দেখানোর নামে শরীরে হাত দেন। আশপাশের পুরুষ সহকর্মীরা তা দেখে দাঁত বের করে হাসেন। রাশেদার মন খারাপ হয়। রাশেদার কথা, ‘অভাবের সংসার। সব মেনেই কাজ করি। কিছু বললে চাকরিই চলে যাবে।’ অন্যদের থেকে রাশেদা বেতন কম পান। একই কাজ করে পুরুষ সহকর্মী বেতন বেশি পান। কিন্তু তার বেলায় নিয়ম যেন ভিন্ন। 

কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে মুখরোচক কথা হলেও বাস্তবে তা আশাপ্রদ নয় মোটেই। যে হারে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ার কথা ছিল। সে হারে বাড়েনি। বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সেশনের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। তার মধ্যে কাজ করে ৬ কোটি ৮ লাখ। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ। তবে বিবিএসের তথ্যানুযায়ী ৩৩ দশমিক ৫ ভাগ। জানা যায়, ১৯৭৪ সালে সদ্যস্বাধীন দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান ছিল মাত্র ৪ ভাগ। এ হার ১৯৮০ সালের দিকে হয় ৮ ভাগ এবং ২০০০ সালে এটি বেড়ে হয় ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১০ সালে বেড়ে হয়েছে ৩৬ ভাগ। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। ২০২০ সালের এক গবেষণায় এমন তথ্য দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য যোগ করলে জিডিপিতে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ ভাগ।

অন্যসব শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ নড়বড়ে হলেও পোশাকশিল্পে চালকের অবস্থানে আছে তারা। বলা যায়, পোশাক খাতের নিয়ন্ত্রক নারী শ্রমিক। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি পোশাক শিল্প খাত থেকে আসে। মোট পোশাককর্মীর প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী। 

এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নারী ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। এ খাতে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের শিল্প খাতে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ ভাগ। তবে এখানেও যে তারা অন্যায়-অবিচারের শিকার হন না তা কিন্তু নয়। ৭৪ শতাংশ নারী পোশাকশ্রমিক কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য হন। তৈরি পোশাকশিল্পে নারী বেশী নির্যাতিত। শতকরা ৮৪ দশমিক সাতজনকে কারখানার ভেতর মৌখিক নির্যাতন ও গালাগালের শিকার হতে হয়। শতকরা ৭১ দশমিক তিনজনের ওপর মানসিক নির্যাতন করা হয়। শতকরা ২০ জন শারীরিক নির্যাতন অর্থাৎ তারা মারধরের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন শতকরা ১২ দশমিক সাতজন। কর্মজীবী নারী ও কেয়ার বাংলাদেশের সদ্যসমাপ্ত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

নির্মাণশ্রমিকের কাজে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বাড়িঘর যেখানেই নির্মাণ হচ্ছে, তাদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে। ইট ভাঙা, ইট ওঠানো, বালু আর সুরকি আনা-নেওয়ার মতো কঠিন কাজ তারা করেন। কংকালসার দেহ, মলিন মুখ নিয়ে কর্মরত থাকেন। একটুও ফাঁকি দেন না। পুরুষের চেয়ে শারীরিক শক্তিতে তারা পিছিয়ে, বোঝাই যায় না। মমতাজ বেগমের হাতে কয়েকটি ১০০ টাকার নোট। নির্মাণশ্রমিক তিনি। কত মজুরি পান- বলতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন ৩০০ টাকা। কাছেই একজন পুরুষ শ্রমিককে ৫০০ টাকা মজুরি নিয়ে চলে যেতে দেখলাম। মমতাজ বেগমের হাহাকারভরা দীর্ঘশ্বাসের কারণটা বুঝতে আর বাকি রইল না। কাজ একই, মানুষভেদে দুই রকম মজুরি। 

কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। ২০০৯ সালে হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্রে যৌনহয়রানি রোধে যে নির্দেশনা দেন, তাতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌনহয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা এবং তার নিষ্পত্তির ব্যবস্থার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তা অনুসরণ করছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৮৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ওই কমিটির ব্যাপারেই জানেন না। 


নারীর নিরাপত্তায় কঠোর আইন রয়েছে। তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের সমতা থাকিবে।’

সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’ 

১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন পাস হয়। আইনটি বাতিলক্রমে ২০০০ সালে নতুন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটি শক্তিশালী করতে ২০০৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন প্রণয়ন করা হয়।

অর্থাৎ সংবিধান ও আইনের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত থাকলে নারীর প্রতি কোনোরকম অবমাননাকর আচরণ, বৈষম্য বা বৈষম্যমূলক আচরণ করার সুযোগ নেই। এমনকি নারীর উন্নয়নের স্বার্থে বিশেষ বিবেচনায় উদ্যোগ নিলেও তা সংবিধান সমর্থন করে, কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও এখনও নারীরা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

কর্মক্ষেত্রে নারীর সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সরকারি যে বিধিমালা আছে তার বাস্তবায়ন যেমন প্রয়োজন, তেমন পুরুষের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। কোথাও নারী নির্যাতিত হলে যেন সঠিক বিচার পায়, সেজন্য নারীবান্ধব আইনের দরকার। এমনটাই বলছিলেন নারী অধিকার কর্মী জাহানারা বেগম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অদিতি সবুর বলেন, ‘ইনফরমাল সেক্টরে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। ইনফরমাল সেক্টরের যেসব কাজে নারী পার্টিকুলারলি হ্যারাজমেন্টের শিকার হন, পলিসিতে সেখানে তারা যাদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন তাদের অ্যাকাউন্টেবিলিটির ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর নারী যে যে সেক্টরে কাজ করে সেখানে তার নিরাপত্তা, সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েও কাজ করতে হবে।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা