× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাঁশের মাদুরে চিত্রশিল্প

বনমালী পালের একার লড়াই

ইমরান উজ-জামান

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:৫৫ এএম

বাঁশের মাদুরে ছবি আঁকায় মগ্ন বর্ষীয়ান লোকশিল্পী বনমালী পাল	ছবি : লেখক

বাঁশের মাদুরে ছবি আঁকায় মগ্ন বর্ষীয়ান লোকশিল্পী বনমালী পাল ছবি : লেখক

বাংলাদেশের লোকশিল্পের ইতিহাস হাজার বছরের। নানা মাত্রার, নানা ধরনের এই শিল্পের অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। অনেকের একক প্রচেষ্টায় কিছু শিল্প টিকে আছে নিভুনিভু প্রদীপের মতো। তেমনি এক লোকজ শিল্প বাঁশের মাদুরে চিত্রাঙ্কন। এ কাজের একমাত্র শিল্পী বনমালী পাল। কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকা বর্ষীয়ান এই শিল্পীকে নিয়ে লেখা...


পদুয়ার বাজার থেকে সিএনজিতে জেলখানাবাড়ী। বাঁ পাশে নেমে রাস্তা পার হয়ে বিপরীতে একটা রাস্তার মুখ আছে। এ রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে রেললাইন, রেললাইন পার হয়ে গেলে কিছু দোকান আর ডান পাশে পালবাড়ী রোড। ঐতিহাসিক বিজয়পুর গ্রাম। আর এখানেই আছে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি লি.।

১৯৬১ সালে ড. আখতার হামিদ খানের গড়া ‘বিজয়পুর রুদ্রপাল সমিতি’। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে হয়ে ওঠে ‘বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমিতি লি.’। বিজয়পুর রুদ্রপাল সমিতির সৃষ্টি এবং ১৯৭২ সালের পুনর্জন্মের দুই অগ্রসৈনিক তরণীকুমার পাল ও বনমালী পাল। তরণীকুমার পাল গত হয়েছেন কিছুকাল হলো। বনমালী পাল বেঁচে আছেন। এখনও তার শিল্পচর্চা চলছেই।

সারি সারি মাটির ঘর পার হয়ে দক্ষিণ বিজয়পুরে শিল্পীর বাড়ি ঘুরে এলাম এক বৃষ্টিস্নাত দুপুরে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ শিল্পীর ঘরে প্রবেশমুখেই প্রমাণ মেলে শিল্পের নানা মাধ্যমে তার কাজের। দরজার পাশেই রাখা আছে মাটির পটারির ওপর রঙের কাজ করা কিছু নিদর্শন। ঘরের ভেতরে শিল্পীর বিভিন্ন সময়ের তোলা ছবি। ছবি দেখেই বোঝা যায়, জীবনের প্রতিটি ভাগে কতটা আধুনিক মানুষ ছিলেন তিনি। ঘর মাড়িয়ে বারান্দায় তার কাজ করার সামগ্রী। এক পাশে ইজেল, মাটিতে সারি সারি রঙের কৌটা আর তুলি। পাশেই সারি সারি রাখা আছে বাঁশের ম্যাটে আঁকা ঘরবাড়ি, খেজুর গাছ।

বনমালী পালের আঁকা বাঁশের মাদুরের আর্টশিল্প

কথা হলো বনমালী পালের সঙ্গে- ‘দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লা এলেন। জনসভায় ভাষণ দিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর একটা মনুমেন্ট মডেল তৈরি করে তাঁকে দিলাম। বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন, এখানে একটি মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি ছিল, তার কী খবর?’

তারা জানালেন, বিজয়পুরের মৃৎশিল্প পল্লী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঞ্জাবিরা পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ অনুদানের ব্যবস্থা করলেন। সে সময় ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো। এ টাকায় আবার নতুন করে তৈরি হলো বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতি।

বনমালী পাল স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘একদিন হামিদ স্যার (ড. আখতার হামিদ খান) এলেন। সাইকেলে করে, মাথায় টুপি। আমাদের বোঝালেন, সমবায়ের মাধ্যমে কাজ করলে লাভবান হওয়া যায়। নিজেই আমাদের গ্রামে সমবায়ের পদ্ধতি চালু করে দিয়ে গেলেন।’ একসময় কুমিল্লার বিজয়পুরের মূল শিল্পী হয়ে ওঠেন বনমালী পাল ও তরণী পাল। তাদের হাত ধরে শিল্পে পরিপক্বতা লাভ করে বিজয়পুরের মৃৎশিল্প।

বনমালী পাল অতীতে ফিরে গেছেন যেন, ‘তরণীকুমার পাল আমার বন্ধু। সে ছিল মডেলার, আমি ডিজাইনার। আমি কাগজে ডিজাইন আঁকি, তরণী আমার আঁকা থেকে মাটি দিয়ে মডেল তৈরি করে। সেগুলো কর্মচারীদের হাতে হাজার হাজার পিস তৈরি হয়ে বাজারে যায়। সে সময় করা আমার ডিজাইনগুলোর মধ্যে বাংলার কৃষক, পল্লীগ্রাম, গ্রাম বাংলার নানা দৃশ্য। বাজারের কথা চিন্তা করে আমরা তখন এসব চিত্র মাটিতে তুলে ধরার চেষ্টা করতাম। নতুন ডিজাইন ও ভাবনা যুক্ত হওয়ায় একসময় আমাদের তৈরি মাটির জিনিস খুব বাজার পায়। এই বাজার পাওয়ার পেছনেও কুমিল্লা বার্ড-এর প্রতিষ্ঠাদা হামিদ স্যার। তিনি আশপাশ এলাকায় কয়েকটি মেলার ব্যবস্থা করে দিলেন। চলল বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের অগ্রগতি। পরিচিতি পেল সারা দেশে। বিদেশিরাও একসময় অর্ডার করতে শুরু করে এখানকার মৃৎপণ্য। বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়। আমাদের পণ্য এখনও বিদেশে যায়। এই ছোট মাটির হাঁড়িগুলো মালয়েশিয়া যাবে।’

বনমালী পালের তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে গ্রাম-বাংলার নানা দৃশ্য

বাঁশের মাদুরে আঁকা শিল্প সে সময় আরও দুয়েকজন করলেও বনমালী পালের বাড়িতে লাইন লেগে থাকত। তিনি নিজে মেলায় বিক্রি করতেন না। যারা মেলা করতেন, তারা এসে মাদুর দিয়ে যেতেন। আঁকার কাজ শেষ হলে নিয়ে যেতেন। এখন আর আগের দিনের মতো এত কাজ হয় না। তবে একজন নিয়মিত মাদুর দিয়ে আঁকিয়ে নিয়ে যান।

বনমালী পাল আবারও ডুব দেন তার অতীত জীবনে, ‘সে সময় কুমিল্লা-ত্রিপুরার সব স্টুডিও ব্যাকড্রপ নকশার কাজ করার ডাক পড়ত। ঢাকায়ও কাজ করেছি।’ 

ঘটনাচক্রে চলে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিজয়পুরের পালপাড়া পুরোটাই পুড়িয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনীর কুমিল্লার দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন বোখারি শিবনারায়ণ ও বনমালী পালকে খুঁজতে থাকেন। কারণ, শিবনারায়ণ চক্রবর্তী কুমিল্লার সেরা আঁকিয়ে, বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর বনমালী পাল বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছেন। বিজয়পুরের ধ্বংসযজ্ঞে সহায়সম্বল হারিয়ে তারা চলে গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। না হলে তাদের দুজনকেই হত্যা করা হতো।

বনমালী পাল বাংলাদেশের লোকশিল্পের অন্যতম শিল্পী ও বিসিক ‘নকশাকেন্দ্রে’র জনক কামরুল হাসানের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানালেন, ‘পাকিস্তান আমলে শিল্পী কামরুল হাসান কুমিল্লার জাহানারা ইন্ডাস্ট্রিতে এবং বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানায় এসেছিলেন। তখন তার সঙ্গে দেখা। তিনি ডিজাইন সেন্টারের চিফ ডিজাইনার। আমাকে আর তরণী পালকে খুব পছন্দ করলেন। আমার আর্ট তার খুব পছন্দ হয়েছিল, বিশেষ করে মাদুর আর্ট। আমরা দুজন ওনার ঢাকার হাতিরপুলের বাসায় গেছি, খাওয়াদাওয়া করেছি। আমাকে ডিজাইন সেন্টারে  চাকরি দিয়েছিলেন। ঢাকার রায়েরবাজারে হিন্দুদের ওপর পাকিস্তানের অত্যাচারে ভীত হয়ে চাকরিটা করিনি।’


আর্ট বিষয় তো বটেই, পুথিগত শিক্ষার ক্ষেত্রেও কোনোরকমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বনমালী পালের। তবে রঙের আঁচড় ঠিকই রপ্ত করতে পেরেছেন। শম্ভুলাল সিনহা ছিলেন তার ওস্তাদ। 

স্মৃতিচারণায় বনমালী পাল বলেন, তার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল কুমিল্লার বিখ্যাত কমার্শিয়াল আর্টিস্ট নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কুমিল্লা ও আশপাশ এলাকার ব্যানার, পোস্টার আঁকিয়ের পথিকৃৎ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার আঁকা ছবি বিখ্যাত ছিল। বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ছবি, যার গলায় বিভিন্ন তাজা রঙের বড় বড় ফুলের মালা। তার পরে আমার নাম আসে। বিশেষ করে সে সময় কুমিল্লার স্টুডিও ব্যাকড্রপ মানেই বনমালী পাল।

কুমিল্লার কালিকাপুরের বাঁশের মাদুর বনমালীর হাতে হয়ে ওঠে শিল্প। অন্যরকম এক শিল্পের পথিকৃৎ বনমালী পাল। রঙের আঁচড়ে, বাঁশের ম্যাটে বা মাদুরে যে শিল্প তৈরি হয় তা তাদের ভাষায় মাদুরশিল্প। এ মাদুরশিল্পের সারা দেশে একমাত্র জীবিত শিল্পী এখন বনমালী পাল। অশীতিপর বনমালী পালের বিশেষত্বই এ মাদুর আর্টশিল্প। একসময় দেশের বিভিন্ন লোকমেলায় অহরহ দেখা মিললেও এখন কদাচিৎ চোখে পড়ে। এ শিল্পের একমাত্র উদাহরণ কুমিল্লার মাদুর আর্ট শিল্প। তা-ও যতদিন বনমালী পাল বেঁচে আছেন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা