আরফাতুন নাবিলা
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৩ ১৩:১৪ পিএম
সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওরে হোক কিংবা রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে, এমন কিছু হাউসবোট রয়েছে যেগুলো প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। দেশের দৃষ্টিনন্দন ৫টি হাউসবোট নিয়ে লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা
‘আমার মন বসে না শহরে, ইট-পাথরের নগরে, তাইতো আইলাম হাওরে...’ মূল গানের কথায় অবশ্য হাওরের জায়গায় সাগর কথাটা বলা আছে। হাওরপ্রেমী হওয়ায় আমি শব্দটা একটু বদলে দিলাম। তবে গানের কথায় যাই বলা হোক না কেন, এটা সত্যি যে, এই ইট-পাথরের নগরের ব্যস্ততা থেকে ছুটি পাওয়ার জন্য আমরা সবাই উদগ্রীব থাকি। কিন্তু ছুটি নিয়ে কোথায় যাওয়া যায়? এই বর্ষায় ছুটি কাটানোর সবচেয়ে উপভোগ্য জায়গা হতে পারে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর অথবা রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে অথবা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে চলে যেতে পারেন এই জায়গাগুলোতে। কেন এই ভ্রমণের কথা বলছি?
আপনি যখন হাউসবোটে উঠে ভ্রমণ শুরু করবেন, তখন চারপাশের বিস্তৃত জলরাশি দেখে মুহূর্তেই সব ক্লান্তি ভুলে যাবেন। কিছু সময় পর পর আপনার চোখে পড়বে চিরায়ত গ্রামবাংলার দৃশ্য। অল্প বয়সিরা পানিতে সাঁতার কাটছে, বাড়ির মহিলারা কাপড় ধুচ্ছেন, জেলেরা মাছ ধরছেন, আবার আপনাকে দূর থেকে দেখে বাচ্চারা আনন্দের সঙ্গে হাত নাড়াচ্ছে। তাদের দেখে অল্প সময়ের মধ্যেই ভুলে যাবেন শহরের ক্লান্তি আপনাকে কতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
বোটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, আপনি যে কদিনের জন্য বোটে থাকবেন পুরোটা সময় পানিতেই থাকবেন। বোট চলতে থাকবে, এরই মধ্যে চলবে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা দেওয়া। সারা দিন যেভাবেই আপনি সময় কাটান না কেন, রাতের বেলা বোটের ছাদে শুয়ে আকাশের তারা দেখে আপনাকে মোহাচ্ছন্ন হতেই হবে! সেই সঙ্গে যদি শুরু হয় বৃষ্টি তাহলে তো কথাই নেই! বৃষ্টিতে ভিজতেও যে ভালো লাগে, সেই ভালো লাগা আপনি পাবেন এই হাউসবোটের ছাদে বসেই! হাউসবোটে থাকলে কেমন লাগবে সেই কথা তো বললাম। কিন্তু বোটের সন্ধান কীভাবে পাবেন? আপনাদের সুবিধার জন্য হ্রদ ও হাওর মিলিয়ে আজ পাঁচটি হাউসবোটের কথা জানাব আমি।
বর্ষা হাউসবোট
সুবিশাল হাওরের মাঝে ভেসে থাকার আনন্দ উপভোগ করতে আপনি বেছে নিতে পারেন হাওরের হাউসবোট বর্ষাÑ Serenity of rain and boat। এই বোটের যাত্রা হয়েছে চলতি বছরের রোজার ঈদের পর। সময় অল্প হলেও নান্দনিক নকশায় তৈরি বর্ষা এরই মধ্যে মানুষের আস্থা অর্জন করে নিয়েছে। এই বোটে মোট ৬টি কেবিন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চারটি ওপেন কেবিন এবং দুটি ডোর লক অ্যাটাচ ওয়াশরুমসহ কেবিন। দুটি কমন ওয়াশরুম রয়েছে। বর্ষার ট্রিপগুলো সাধারণত দুই দিন এক রাতের হয়ে থাকে। একটি সম্পূর্ণ প্যাকেজের জন্য ট্যুর ফি ৫০০০-৭৫০০ টাকা অবধি হয়ে থাকে।
যা পাওয়া যাবে
যেসব স্পটে যাওয়া হয় : ওয়াচ টাওয়ার, টাঙ্গুয়ার হাওর, শিমুল বাগান, নীলাদ্রি লেক, যাদুকাটা নদী ও বারিক্কা টিলা।
এই হাউসবোট থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্ষার একজন স্বত্বাধিকারী শরিফ হোসেন আসিফ বলেন, ‘সাপ্তাহিক দিনগুলোতে আমরা বেশ ভালো সাড়া পাই। বাকি দিনগুলোতে অতিথিরা তুলনামূলক কম আসেন। এর মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সবই তখন খোলা থাকে। সব মিলিয়ে হয়তো চাইলেও আসা সম্ভব হয় না। তবে এখন আগের চেয়ে কিছুটা সাড়া বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে দেখা যাচ্ছে ছুটি নিয়ে হলেও পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে চলে আসছেন। কমবেশি পুরো সপ্তাহেই এখন আমাদের বোটে অতিথিরা থাকেন।’ যোগাযোগ: ০১৮৮৮৬৭৯৩০২
বেহুলা হাউসবোট
হাওরে সাধারণত যে হাউসবোটগুলো আছে, সেগুলোর স্বত্বাধিকারী পুরুষ। প্রচলিত এধারা ভেঙেছে Behula- The Houseboat। এই হাউসবোটের স্বত্বাধিকারী ও পরিচালনাকারী সবাই নারী। আলাদা করে তাই তাদের সাধুবাদ দিতেই হয়। যেখানে অতিথিদের সামাল দেওয়া নিয়ে সব বোটেই কিছু না কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় সেখানে তারা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কাজটি করে যাচ্ছেন।
সুবিধা ও খরচ
বেহুলার সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয়টি হচ্ছে তারা নিজেদের খুব বেশি চাকচিক্যপূর্ণভাবে তৈরি করেনি। বরং ইকোফ্রেন্ডলি ব্যাপারটাকে তারা অনেকটাই গুরুত্ব দিয়েছে। কড়া আলোকসজ্জা, ব্লুটুথ স্পিকার বা আলোর চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে নরম আলো, বই বা পুরোনো লুডো। যার
কারণে বেহুলাতে এলে মনে হবে আপনি যেন নিজের ঘরেই আছেন। ছাদে শুয়ে আকাশ দেখতে, পানিতে ভেসে ভেসে আশপাশের দৃশ্য দেখতে, খাবার খেতে বেশ আরাম লাগে। ও হ্যাঁ, খাবারের মধ্যে আপনারা পাবেন হাওরের তাজা মাছ, সবজি ও ফলমূল। সেই সঙ্গে আয়েশ করে চা পান করতেও বেশ ভালো লাগবে। এই বোটে মোট ৮টি কেবিন রয়েছে। আছে সিঙ্গেল ও কাপল প্যাকেজ। জনপ্রতি খরচ পড়বে ৪৫০০ থেকে ৬৫০০ টাকা পর্যন্ত। পাচ্ছেন সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা, লাইফ জ্যাকেট ইত্যাদি। রাতের বেলা বেহুলার ছাদে থাকে নিরিবিলি এক পরিবেশ।
হাওরের বুকে রাতের সৌন্দর্য বেশ ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবেন বেহুলার ছাদে শুয়ে। যান্ত্রিক জীবনের একঘেয়েমি ছেড়ে হাওরের জল, জঙ্গল ও বাতাসকে দুই দিনের জন্য সঙ্গী করে ঘুরেই আসতে পারেন বেহুলা থেকে। যোগাযোগ : ০১৮৮৬৭৬৫৬৪৩
রংগিলা বাড়ই
শহুরে ক্লান্তি ছাপিয়ে যারা কিছুটা সময় প্রশান্তিতে কাটাতে চান তারা বেছে নিতে পারেন রংগিলা বাড়ইকে। আরামদায়ক, বিলাসবহুল ও আকর্ষণীয় এই হাউসবোটে যে যে সুবিধা পাবেনÑ মোট ৮টি অ্যাটাচ ওয়াশরুমসহ রুম, প্রতিটি রুমে বড় আয়নাসহ ড্রেসিং টেবিল, গরম কমানোর জন্য ৬ লেয়ারের ছাদ। সুরমা নদী, টাঙ্গুয়ার হাওর, ওয়াচ টাওয়ার, বারিক্কা টিলা, নীলাদ্রি লেক, লাকমাছড়া, যাদুকাটা নদী ও শিমুল বাগানÑ এই স্পটগুলো ঘুরে দেখা যাবে রংগিলা বাড়ইতে করে। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রতিবেলায় খাবারের সুবিধা। রংগিলা বাড়ইতে ঢুকতেই একটি সুদৃশ্য দোলনা রয়েছে। আপনি যদি মনে করেন ঘরে বা ছাদে কোথাও বসতে চাচ্ছেন না, তাহলে দোলনায় বসেই বেশখানিকটা সময় অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবেন। যোগাযোগ : ০১৭১৩৩৮৮৪৯২
টাঙ্গুয়ার অভিযাত্রিক
হাওরে হাউসবোটের যাত্রা হয়েছিল টাঙ্গুয়ার অভিযাত্রিকের হাত ধরেই। চারপাশে সবুজ পাহাড়, বিস্তৃত জলরাশির মাঝে পুরোটা সময় উপভোগ করার যে উপলব্ধি সেটার শুরু হয়েছিল তাদের মাধ্যমেই। দূর থেকে দেখলে বেশ আলাদাভাবেই এই বোটটি নজরকাড়ে। অভিযাত্রিকের আরও ৪টি বোট আছে। লাক্সারিয়াস এই বোটগুলোতে আছে আটটি করে কেবিন, কমন ও অ্যাটাচ ওয়াশরুমের সুবিধা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ, লাইফ জ্যাকেট, বয়াসহ ৪ বেলার খাবার পাবেন। প্রফেশনাল বাবুর্চি দিয়ে হাউসবোটে রান্না করা দেশীয় যেকোনো খাবারের স্বাদ আপনার মুখে লেগে থাকবে।
অন্যান্য বোটের মতো এই হাউসবোটে করেই হাওরের আশপাশের সব এলাকায় ঘুরে আসতে পারবেন। বোট থেকে নেমে নীলাদ্রি লেকের সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে কায়াকিংও করতে পারেন, ঘুরে আসতে পারেন শিমুল বাগানও। এ সময় বাগানে ফুল না থাকলেও চারপাশের সবুজ গাছপালা আপনার মন ভরিয়ে তুলবেই। ওয়াচ টাওয়ারে গেলে মনে হবে রাতারগুলে চলে এসেছেন। সেখানে পানিতে নেমে গোসল করতে পারবেন। গোসল না করলেও ছোট নৌকায় করে বেশ কিছুক্ষণ আশপাশে ঘুরে আসতে পারবেন। যোগাযোগ : ০১৮৪১৫০০৮৪৩
প্রমোদিনী বোট লাইফ
রাঙামাটির কাপ্তাই লেকে প্রথমবারের মতো বিলাসবহুল প্রাইভেট হাউস বোটিং অভিজ্ঞতা চালু করেছে প্রমোদিনী বোট লাইফ। প্রমোদিনী ও অভিযাত্রিক ট্যুরিজম লিমিটেডের একটি যৌথ উদ্যোগ এটি। বর্তমানে তাদের বোট সংখ্যা ৪টি। ৮-১০ জনের ধারণক্ষমতা রয়েছে বোটগুলোতে। এগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক সুবিধা, আধুনিক টয়লেট ও শোয়ার রুম, ফ্যান ও চার্জিং পয়েন্টসহ ডাবল বেডের কেবিন, একটি প্রশস্ত জানালা ও বড় লাউঞ্জ আছে। এই বোটের খরচ শুরু হয় জনপ্রতি ৬০০০ টাকা থেকে। প্রমোদিনীর ট্যুর প্যাকেজে বেশ কিছু অফার রয়েছে। যেমনÑ স্থানীয় আদিবাসী গ্রাম ও বাজার পরিদর্শন, আদিবাসী খাবারের সন্ধান ইত্যাদি। বোট থেকে ঘুরে আসার সুযোগ রয়েছে ঝুলন্ত ব্রিজ, পলওয়েল পার্কে। রাঙামাটি পর্যটনের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান। এখানে মানুষ কেরালা বা কাশ্মিরের ঢাল লেকের হাউস বোটিংয়ের মতো অভিজ্ঞতা পাবে। তাই আপনি যদি লেকের পানিতে থেকে আশপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে চান, পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে দারুণ কিছু সময় কাটিয়ে আসতেই পারেন প্রমোদিনী থেকে। যোগাযোগ : ০১৮৩৩৩৩৪৩০৫
জেনে নিন