× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যাদুকাটা প্রচ্ছদ

বহুরূপী নারকেল...

টি এইচ মাহির

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩ ১২:০৪ পিএম

আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৩ ১২:০৪ পিএম

বহুরূপী নারকেল...

বহুগুণের এক ফল নারকেল। গাছ থেকে ফল- প্রায় প্রতিটি অংশই দারুণ কাজের ও উপকারী। মানব সভ্যতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে নারকেল। কোনো এক সাগরপাড় থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া নারকেল নিয়ে এবারের আয়োজন... 


আমাদের অতি পরিচিত এক ফল নারকেল। গ্রামে গঞ্জে সারি সারি নারকেল গাছের দৃশ্য দেখে আমরা অভ্যস্ত। উপকূলীয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে দেখা যায় সারি সারি নারকেল গাছের অপরূপ দৃশ্য। নারকেল গাছ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপকারী। খাদ্য, জ্বালানি, তেল, প্রসাধনী, ভেষজ ওষুধ, দালান, নির্মাণসামগ্রীতে লাগে এই উদ্ভিদের উপাদান। বাংলায় নারকেল শব্দটি তৎসম, যার দ্বারা শাঁস-জলে ভরা কঠিন আবরণযুক্ত ফল বোঝায়। নারকেলের ইংরেজি Coconut, যেখানে Coco শব্দের অর্থ মাথা বা খুলি এবং Nut অর্থ বাদাম। Coconut শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ থেকে। স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা Coconut নাম দিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। আরবরা নাম দিয়েছিলেন ‘জাওজহাত আল-হিন্দ’, মানে ‘ভারতের আখরোট’। পাম জাতীয় উদ্ভিদটি ‘কোকোস’ গণ-এর একমাত্র জীবিত প্রজাতি।

নারকেলের ইতিহাস 

ভারতের বিভিন্ন লোককাহিনীতে পামজাতীয় এ উদ্ভিদের কথা রয়েছে। ভারতে একে ‘কল্পবৃক্ষ’ ( কারণ এ গাছ জীবনের সব প্রয়োজনীয়তা সরবরাহ করে) হিসেবে প্রশংসা করা হয়। এটি মালয়দের কাছে ‘পোকোক সেরিবু গুনা’ (হাজারো ব্যবহারের গাছ) আর ফিলিপিন্সে একে বলা হয় ‘জীবনের গাছ’ বা ‘স্বর্গের গাছ’। ইন্দোনেশিয়ায় নারকেল গাছ ‘তিন প্রজন্মের গাছ’ হিসেবে পরিচিত। নামগুলোর পেছনে মানুষের জীবনজীবিকা জড়িয়ে আছে। কেননা নারকেল গাছের প্রতিটি অংশ মানুষের কাজে লাগে। কোকোস প্রজাতির নারকেলের প্রধান দুটি জাত রয়েছে, একটি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং অন্যটি দক্ষিণ আমেরিকান। 

নারকেলের উৎপত্তির কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে মধ্য ইন্দো-প্যাসিফিক, পশ্চিম-দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মেলানেশিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চল; যেখানে নারকেলের জেনেটিক বৈচিত্র্য দেখা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় গোত্রই একমাত্র, যারা পরিষ্কার জেনেটিক এবং ফেনোটাইপিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। মানুষের বিচরণের ফলে এটি ছড়িয়ে পড়েছে দেশান্তরে। অস্ট্রোনেশিয়ান ভ্রমণকারীরা নারকেল নিয়ে যায় এবং সেখানে রোপণ করে। যার চমৎকার উদাহরণ মাদাগাস্কার দ্বীপ।

 খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২০০০ থেকে ১৫০০ অব্দে অস্ট্রোনেশিয়ান নাবিকদের দ্বারা বসতি স্থাপন করা দ্বীপ মাদাগাস্কার। দ্বীপটির নারকেলের জিনগত বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় নারকেলগুলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে এসেছে; যা ইন্দো-আটলান্টিক প্রজাতির সঙ্গে প্রজননে সংমিশ্রণ হয়েছে। আবার অস্ট্রোনেশিয়ান নাবিকরা নারকেলের প্রসার ঘটিয়েছেন আমেরিকায়। গবেষকরা অস্ট্রোনেশিয়ান এলাকায় নারকেলের উদ্ভব বলে ধারণা করেন। প্রশান্ত মহাসাগর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলোয় সম্ভবত নারকেল প্রথম চাষ হয়েছিল। মানে ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন অস্ট্রোনেশিয়ান এলাকায়।

বিভিন্ন প্রাচীন পুথি ও সাহিত্যে নারকেলের বিচরণ পাওয়া যায়। রামায়ণ এবং শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে নারকেলের উপস্থিতি ছিল। আরব্য রজনির বিখ্যাত সিন্দবাদেও নারকেল বিক্রির ঘটনা আছে। ভেনিসিয়ান অভিযাত্রী মার্কো পোলো ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিসরে নারকেল গাছ দেখেন এবং এ নারকেলকে ‘ফেরাউনের বাদাম’ বলে অভিহিত করেন।


নারকেল ফল, বীজ নাকি বাদাম 

Coconut শব্দটি মাথায় এলেই নারকেল সম্পর্কে বলা যায়, এটি একটি বাদাম। কেননা শব্দটির শেষাংশে Nut আছে। কিন্তু নারকেল শুধু বাদাম নয়, এটি একই সঙ্গে ফল ও বীজ। বোটানিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে একটি নারকেল তন্তু ও বীজযুক্ত ড্রুপ। ড্রুপ মূলত এমন ফল, যার মাংসল অংশ শক্ত আবরণ দিয়ে মোড়ানো, ভেতরে একটি বীজ থাকে। একটি ড্রুপে তিনটি স্তর: এক্সোকার্প- বাইরের সবচেয়ে ‘কঠিন’ স্তর, মেসোকার্প- ‘মাংসল’ মধ্যম অংশ এবং এন্ডোকার্প- বীজের চারপাশে শক্ত স্তর। 

নারকেলকে বীজ বলা যেতে পারে, কারণ এর তিনটি কালো ছিদ্র থেকে অঙ্কুর জন্ম নেয়। অন্য ড্রুপগুলোয় যেমন খোসার ভেতরে বীজ থাকে; এখানে তেমনটা থাকে না। তাই সংজ্ঞা অনুসারে নারকেল বীজ হিসেবে বিবেচিত হয়। সবশেষে এটি একটি বাদামও বটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নারকেলকে গাছের বাদাম বলে মনে করে। ইতিহাসের পাতায় বিভিন্ন সময় এটি বাদাম হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। আগেই বলেছি, নারকেল বীজযুক্ত ফল। অর্থাৎ নারকেল একই সঙ্গে ফল, বীজ ও বাদাম।

বহুগুণের নারকেল 

নারকেল গাছকে বলা হয় জীবনের গাছ। কেননা এর ফল, কাণ্ড সবই কাজে লাগে মানুষের। প্রথমত নারকেলের সুস্বাদু শাঁস দিয়ে নানা স্বাদের পিঠা, মিষ্টি ও চকলেট তৈরি হয়। নারকেলের সুস্বাদু রেসিপিও আছে বিভিন্ন দেশে। নারকেল থেকে তৈরি হয় তেল। এ ছাড়া নারকেলের পানিও অত্যন্ত পুষ্টিকর। নারকেল ফাইবার এবং ভিটামিন সি, ই, বি১, বি৩, বি৫ ও বি৬সমৃদ্ধ। এতে লোহা, তামা, সেলেনিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, জিঙ্কসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। ক্রীড়াবিদরা প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইটিক বৈশিষ্ট্যের জন্য নারকেলের পানি পান করে থাকেন।

নারকেল শুধু খাবার হিসেবে নয়, প্রসাধনী শিল্পেও গুরুত্বপূর্ণ। সাবান, শ্যাম্পু এবং অন্যান্য প্রসাধনসামগ্রী তৈরিতে নারকেলের ব্যবহার রয়েছে। নারকেলের তেল বের করার পর এর খইল পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার নারকেল ঘর তৈরিতেও কাজে লাগে। শুকনো পাতা কুঁড়েঘরে ব্যবহার করা হয়। নারকেলের ছোবড়া থেকে শক্ত দড়ি, ব্রাশ, জাজিম, পাপোশ তৈরি হয়। নারকেলের ছোবড়া গদি বা সোফা তৈরিতে কাজে লাগে। গাছের কাণ্ড খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। নারকেল যখন কচি ডাব থাকে তখনও এর পানি অত্যন্ত সুস্বাদু ও উপকারী। উপকূলীয় অঞ্চলে সারি সারি নারকেল গাছের উপকারিতা তো সবারই জানা।


নারকেলের উপকথা 

নারকেল নিয়ে প্রচলিত আছে বিভিন্ন লোককথা। ফিলিপিন্সের এক লোককথায় আছে, এক মা তার সন্তানদের অনেক ভালোবাসতেন। তিনি তাদের জন্য প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করতেন। একদিন তিনি মৃত্যুশয্যায় পতিত হন। তার সন্তানরা তাকে জিজ্ঞেস করে তিনি মারা গেলে তারা কীভাবে খাবার সংগ্রহ করবে। মা বললেন, তিনি মারা গেলে তার কবরের ওপর একটি গাছ উঠবে, যা তাদের খাবার জোগাবে। যথারীতি মা মারা যান এবং তাকে কবর দেওয়া হয়। কিছুদিন পর সেই কবর থেকে নারকেল গাছ ওঠে; যা দেখে সন্তানরা বিস্মিত হয়। তারা গাছ থেকে নারকেল পেড়ে পানি খায় এবং দেখতে পায় ভেতরে শাঁস; যা দিয়ে রান্না হয় সুস্বাদু মাংস। 

নারকেল গাছের উদ্ভব নিয়ে আরেকটি উপকথা প্রচলিত আছে; যেখানে এক যুবককে ভালোবাসার কারণে এক যুবতীকে তার মা জাদুকর দিয়ে কেঁচো বানিয়ে দেন। সেই কেঁচোটি যুবকের কাছে যায় এবং বলে তাকে যেন মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। যুবক তাকে মাটিতে কবর দেয় এবং যুবতীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে। একদিন সে ওই কবরে দেখতে পায় অঙ্কুর ফলেছে। উদ্ভিদটির যত্ন নিতে থাকে। ধীরে ধীরে সেটি বড় হয়ে নারকেল গাছ হয়ে ওঠে। গাছটি যখন ফল দেয় সে আরও অবাক হয়। কেননা নারকেলের তিনটি কালো ছিদ্র একটি মুখের মতো দেখা যেত। খোলস খুললে মনে হয় তার প্রিয়তমার মুখ।

নারকেল নিয়ে শ্রীলঙ্কা ও ভারতে বিভিন্ন উপকথা ছড়িয়ে আছে। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীও আছে নারকেল নিয়ে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে নারকেল পবিত্র ফল। নারকেলকে বলা হয় ‘শ্রীফল’। নারকেল গাছকে বলা হয় ‘কল্পবৃক্ষ’। 

পর্তুগিজ উপকথায় (El Cuco) এল কুকো নামক এক প্রেতাত্মার সন্ধান পাওয়া যায়; যার চেহারা ছিল নারকেলের মতো। অর্থাৎ দুটো চোখ ও মুখ; যা নারকেলের অঙ্কুর বের হওয়ার সেই তিন ছিদ্র। মায়েরা তাদের বাচ্চাদের এই প্রেতাত্মার ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতেন। 


নারকেল কি চলতে পারে 

প্রশ্ন করতে পারেন, নারকেল এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ল কীভাবে? নারকেল কি তবে চলতে পারে? 

অনেকের মতে, সমুদ্রপথে নারকেল ছড়িয়ে থাকতে পারে। যেহেতু বেশিরভাগ নারকেল গাছ সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চলেই দেখা যায়। গবেষকদের মতে, নারকেল পানিতে ১২০ দিন পর্যন্ত অক্ষত থাকতে পারে। আবার ১০ থেকে ২০ মিটার উচ্চতা থেকে মাটিতে পড়ার পরে কেবল লাফিয়ে ও গড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে মূল গাছ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত যেতে পারে। নারকেল দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়েও অঙ্কুরোদ্‌গম করতে সক্ষম। নারকেল সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার অনেক প্রমাণ রয়েছে। আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলে ভারতীয় জাতের নারকেলের দেখাও মিলেছে। 

তবে নারকেল ছড়িয়ে পড়ার পেছনে পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের অবদান আছে। তাদের হাত ধরে নারকেল ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। নারকেল ভেসে ভেসে যেমন ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি জেনেটিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে বিভিন্ন মহাদেশে। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী কেনেথ এম. ওলসেন মনে করেন, মানুষের ভ্রমণের সঙ্গে নারকেলের ইতিহাস ব্যাপকভাবে জড়িত।

নারকেলের মজার মজার ইতিহাসের সঙ্গে আছে মজার সব তথ্য। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর ২ সেপ্টেম্বর নারকেল ফল সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পালিত হয় বিশ্ব নারকেল দিবস। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় নারকেলের উৎপাদন, বিক্রয়, রপ্তানিতে সহায়তার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে গঠিত হয় Asian and Pacific Coconut Community (APCC)। বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে নারকেল জন্মে। ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম নারকেল উৎপাদনকারী দেশ, যেখানে ১৫ মিলিয়ন টন নারকেল উৎপন্ন হয়। দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে আছে ফিলিপিন্স। প্রাচীনকালে যুদ্ধক্ষেত্রে নারকেলের ফাইবারের বর্ম ব্যবহার করা হতো। আবার নারকেল মাথায় পড়েও মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও আছে; যা খুবই অল্প। পাপুয়া নিউগিনির প্রাদেশিক হাসপাতালে ২.৫% আঘাত নারকেল পড়ার কারণে বলে রিপোর্ট করা হয়েছে। যাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। 


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা