জীবন কথা
জাকির আজাদ
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৩ ১৩:০৮ পিএম
জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে গোমতী নদীতে নৌকা পারাপার করেন রাশিদা মাঝি
প্রাচীন জনপদ কুমিল্লার বুকে চিরে বয়ে গেছে গোমতী নদী। নদীপাড়ে বসবাস করেন এক নারী রাশিদা। নদী তাকে বাঁচার তাগিদে বানিয়েছে মাঝি। ‘নারী মাঝি’ পেশার সঙ্গে লিঙ্গের বৈপরীত্য থাকলেও বাস্তবতা হলো গোমতীপাড়ের মানুষ সবাই চেনে রাশিদা মাঝিকে।
স্বামীর অসুস্থতা তাকে নিয়ে এসেছে এই পেশায়। নদীর উত্তর পাশে রত্নাবতী গ্রামে স্বামীর বাড়ি। সচ্ছলতা না থাকলেও শান্তি ছিল তিন ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে রাশিদার সংসারে। কিন্তু অভাব তাকে কর্মজীবী নারী করে তুলেছে। ছেলেমেয়েরা কর্মক্ষম হয়ে ওঠেনি বলে সংসারের ভার তার কাঁধে। কোথাও যখন কোনো কাজের সুরাহা হচ্ছিল না, তখন এলাকার এক বৃদ্ধের পরামর্শে নৌকা চালানো শুরু করেন। বৈঠার বদলে রশি টেনে নৌকায় যাত্রী পারাপার করেন। জনপ্রতি ১০ টাকা। এতে যা আয় হয় তাতে চলে তার সংসার। দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। তবে শুক্রবার হয় ৫০০ টাকা।
চার বছর ধরে কাজটি করছেন রাশিদা। প্রতি মাসে নৌকার মালিককে জমা দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। গোমতী নদীর উত্তর পাশের পাকা সড়কটি বেহাল বহু বছর। বাগানবাড়ি, ভূবনগর, রসুলপুর, সত্তরখালির মানুষকে রাজগঞ্জ বাজার, অফিস-আদালত বা কাপ্তানবাজার পাক্কার মাথা যেতে চানপুর ব্রিজ হয়ে যেতে হয়। লোহার তৈরি সরু এ ব্রিজে যানজট লেগে থাকে সব সময়। যাতায়াত ভাড়া লাগে ৩০ টাকা। খেয়াঘাটে ১০ টাকা দিয়ে নৌকা পারাপারে সময় বাঁচে, টাকাও সাশ্রয় হয়।
গত চার বছরে বহু মানুষ পার করেছেন রাশিদা; কিন্তু সংসারের অভাব ও দুঃখটা পার করতে পারেননি আজও। কথা হয় তার সঙ্গে।
- কেমন লাগে মাঝির কাজ করতে?
- কামের কুনো দুষ অয় না বাজান, না করলে মাইনষে ভালা কয় না, ভিক্কার চাইয়া ভালা।
- লোকজন কিছু বলে না, আপনি যে নারী হয়ে নৌকা চালান?
- কারু টাইম নাই, হগ্গলের খালি জলদি যাও। তই মাঝেমধ্যে ইলাকার বাইরের কেউ জিগায় নানা কতা। আমি হেই কতার জবাব দেই না সব সময়।
- স্বামীর কি অসুখ, চিকিৎসা করাননি? আগে কী করত?
- অনেক করছি, জমাইন্না টেহা হগল খতম করছি রোগ ধরাই পড়ে না। আগে অটো চালাইত।
- সারা দিনের পরিশ্রমে ক্লান্তি আসে না?
- জিরাইলে কি হইব? দুই মাইয়া বিয়া দেওন লাগব না? পোলাডা লেহাপড়া করতে চায় না। একটু সাহায্যও করে না। কেবল পোলাপাইনের লগে ঘুরে।
- অন্য কিছু করেতে চেয়েছেন কখনো?
- কিছু টেহা পাইলে নৌকা বহন ছাইড়া তরকারির ব্যবসা করতাম। নৌকা টাইন্না আর জোর পাই না।
- একটা ইচ্ছার কথা বলেন তো?
- জুগালি বাপের ঘরে হইছিলাম, কেলাস ফোর তক পড়ছি। ইচ্ছা আছিল লেহাপড়া কইরা গ্রামের মেম্বার হওনের। কই আর হইল।
শেষ বিকালের নরম আলোয় রাশিদার মুখে মলিনতা লক্ষ করছিলাম আর হতাশায় নির্লিপ্ত চোখ। সেই হতাশার দৃশ্যটা মুছে যাওয়ার আগেই পার হয়ে যায় ঘাট।