ফারহাত মাইশা অর্পা
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৩ ১৪:২৫ পিএম
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৩ ১৬:১১ পিএম
রোবোটিকস প্রতিযোগিতা রোবোসাব ২০২৩-এ রানারআপ হয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের তৈরি স্বয়ংক্রিয় ডুবোযান ব্র্যাকইউ ডুবুরি
বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ রোবোটিকস প্রতিযোগিতা রোবোসাব ২০২৩-এ রানারআপ হয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের তৈরি স্বয়ংক্রিয় ডুবোযান ব্র্যাকইউ ডুবুরি। একই সঙ্গে দলটি এই প্রতিযোগিতায় ইনজেনুইনিটি স্পেশাল অ্যাওয়ার্ডও জিতেছে। ব্র্যাকইউ ডুবুরি টিমের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানিয়েছেন ফারহাত মাইশা অর্পা
বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ রোবোটিকস প্রতিযোগিতা হলো রোবোসাব। এ প্রতিযোগিতার লক্ষ্য পানির নিচের পরিবেশে বাস্তবসম্মত মিশন সম্পাদনের জন্য নতুন প্রজন্মের ইঞ্জিনিয়ারদের চ্যালেঞ্জ করা এবং পানির নিচের স্বনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রতিযোগিতার স্পন্সর রোবোনেশন আর সহস্পন্সর যুক্তরাষ্ট্র নৌ গবেষণা অফিস। ইভেন্টটি তরুণ প্রকৌশলী এবং এইউভি প্রযুক্তি বিকাশকারী সংস্থাগুলোর সম্পর্ক জোরদার করতেও ভূমিকা রাখছে। এ প্রতিযোগিতাটি বিশ্বের সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত। ২০০২ সাল থেকে এটি প্রায় প্রতি গ্রীষ্মে ইউএস নেভি স্পেস অ্যান্ড নেভাল ওয়ারফেয়ার সিস্টেম সেন্টার প্যাসিফিকের সান ডিয়েগো, ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রান্সডেক অ্যানেকোইক পুলে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তবে এবারে বাংলাদেশ থেকে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ। ৩১ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগোয় অনুষ্ঠিত হয় এ প্রতিযোগিতাটি। এবারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩৪টি দল অংশ নেয় রোবট তৈরির এ প্রতিযোগিতায়।
রোবোসাব প্রতিযোগিতাটি দুটি বিভাগে বিভক্ত। রোবোসাব মাইনর বিভাগে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর যানবাহনকে একটি নিয়মাবদ্ধ রুট অনুসরণ করতে হয় বিভিন্ন বাধা এড়াতে এবং একটি লক্ষ্য অর্জন করতে। রোবোসাব মেজর বিভাগে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর যানবাহনকে আরও জটিল মিশন সম্পাদন করতে হয়। যেমন একটি সাবমেরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা, একটি মৃতদেহের সন্ধান করা বা একটি বিস্ফোরক ডিভাইস শনাক্ত করা।
পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা অংশ নেন এ প্রতিযোগিতায়। বিজয়ী দলগুলোকে প্রদান করা হয় নগদ পুরস্কার, ট্রফি এবং অন্যান্য সম্মাননা। রোবোসাব প্রতিযোগিতাটি তরুণ প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের জন্য একটি দুর্দান্ত সুযোগ এবং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে; যারা পানির নিচের পরিবেশে স্বনিয়ন্ত্রিত যানবাহনগুলোর উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী।
ব্র্যাকইউ ডুবুরি দলটির উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমান। সহ-উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন গবেষণা সহকারী সায়ন্তন রায় ও মো. নাইম হোসেন। দলটির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছেন প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী। দলনেতার দায়িত্ব পালন করছেন এটিএম মাসুম বিল্লাহ। সহদলনেতা হিসেবে রয়েছেন মো. মাহফুজুল হক। উপদলগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছেন এসএম মিনুর করিম, নাজমুল হক, শাওনক মো. ইবনে শাহরিয়ার তালুকদার, পার্থপ্রতিম সরকার, সামিয়া আবদুল্লাহ ও উমামা তাসনুভা আজিজ। দলটিতে কার্যকরী সদস্যের দায়িত্ব পালন করেছেন মাহদি উদ্দিন আহমেদ, সৌমিক হাসান শ্রান্ত, সীমান্ত শাহরিয়ার ধ্রুব, মো. মুশফিক বিল্লাহ ও মো. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী। এ ছাড়া রয়েছেন শান্ত, জোহায়ের, লামিয়া, আলিমা, ইশিকা, নকিব, ফারদিন, আনিকা, বখতিয়ার, সোমেন, জাহিন, অভিষেক, তুবা, ফারাবী, মুজাহিদ। ব্র্যাকইউ ডুবুরি দলের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম রোবোসাবে তাদের সাফল্য, পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথা। তাদের মুখ থেকেই চলুন শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
যেভাবে হলো যাত্রা
রোবোটিকস ক্লাব অব ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একটি প্রজেক্ট থেকেই ব্র্যাকইউ ডুবুরির সূচনা। রোবোটিকস ক্লাবে আমরা আমাদের চারপাশে হয়ে যাওয়া বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অনেক ধরনের প্রজেক্ট তৈরি করি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যও নতুন প্রজেক্ট উদ্ভাবনের কথা ভাবতে হয়।
২০১৮ সালের এক মর্মান্তিক লঞ্চডুবির পর উদ্ধারকাজের জটিলতা নিরসনে আমরা রোবোটিকস ক্লাবের কয়েকজন কিছু উপায় নির্ধারণ করি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ডুবুরির মাধ্যমে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে আটকানো যায়, যে ডুবুরির রোবটটি মানুষের পরিবর্তে কিছু সেন্সরের সাহায্যে অল্প সময়ে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। এই লক্ষ্যে আমরা গবেষণা করি এবং খুঁজতে থাকি পৃথিবীর আধুনিক দেশগুলোয় আন্ডারওয়াটার রোবট তৈরিতে কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
প্রাথমিকভাবে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল রিমোট কন্ট্রোল যানবাহন তৈরি করা। সে চিন্তাধারায় আমরা সফল হই এবং নতুন লক্ষ্য স্থির করি যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোনো প্রকার রিমোটের সাহায্য ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে কীভাবে দুর্গম পরিস্থিতিতেও অভিযান সফল করতে পারি। তা ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা যেমন SAUVC, ROBOSUB-এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা আমাদের কৃত্রিম ডুবুরির সক্ষমতা বিশ্বের মঞ্চে তুলে ধরতে পেরেছি।
প্রজেক্ট নিয়ে বিস্তারিত
বিভিন্ন পরিস্থিতি এবং ক্ষেত্রবিশেষ ব্যবহার-উপযোগী করতে আমরা ডুবুরিতে অনেক ধরনের সেন্সর ও মডিউল ব্যবহার করেছি। যেমন অপেক্ষাকৃত কম আলো এবং ঘোলা পানিতে ভালোভাবে দেখার জন্য লোলাইট সেন্সর ক্যামেরা ব্যবহার করেছি। স্রোতযুক্ত পানিতে চালানোর জন্য রয়েছে আটটি অত্যাধুনিক ব্রাশলেস থ্রাস্টার, যার চারটি গভীরতা নিয়ন্ত্রণে এবং চারটি এর নিজস্ব মুভমেন্টের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
ডুবুরি দিয়ে মাছ চাষ, নদীর তলদেশ পর্যবেক্ষণ, জাহাজ ও সমুদ্রের রক্ষণাবেক্ষণ, সমুদ্রের খনিজ সম্পদ আহরণ, নদী ও সমুদ্রের উদ্ধারকাজের তৎপরতা বৃদ্ধিসহ আরও নানা ধরনের কাজ করা সম্ভব। এ ছাড়া নিয়মিতভাবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন আরও প্রযুক্তির সংযোজন করে ডুবুরির কার্যক্ষমতা এবং কাজের পরিধি আরও বৃদ্ধি করতে পারি। যেমন সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে ডুবুরিতে একটি হাত যোগ করা হয়েছে; যেখানে ডুবুরির কোনো যন্ত্রাংশ বা নিমজ্জিত বস্তু বহন করতে পারে।
রোবোসাব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের বাছাই করার ধাপ নিয়ে প্রতিযোগীরা বলেন, রোবোসাবের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্বাচিত হওয়ার জন্য একটি দলকে বেশ কয়েকটি ইভেন্টের সম্মখুীন হতে হয়। যেখানে অংশগ্রহণ সবার জন্য উন্মুক্ত।
প্রধানত দুটি ইভেন্ট এ নির্বাচনের অন্তর্ভুক্ত, যা হলো-
১. স্বনিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জ : যা স্বয়ংক্রিয় কর্মক্ষমতা ও নিরাপত্তা প্রদর্শন করে।
২. ডিজাইন ও ডকুমেন্টেশন : যা প্রতিটি দলের কাজ ও নকশা উপস্থাপন করে। দল হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিটি দলের শর্ত ছিল কমপক্ষে ৭৫% বা তার বেশি সদস্য সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতে হবে। দলের বেশিরভাগ সদস্যকে অবশ্যই কলেজ বা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে হবে। এ ছাড়া দলের ২৫% বা তার কম প্রাক্তন শিক্ষার্থী; শিল্প, একাডেমিক বা সরকারি অংশীদার নিয়ে গঠিত হতে পারে।
ব্র্যাকইউ ডুবুরি কী
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ব্যবহার-উপযোগী করতে ডুবুরিতে অনেক ধরনের সেন্সর ও মডিউল ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন কম আলো এবং ঘোলা পানিতে ভালোভাবে দেখার জন্য লোলাইট সেন্সর ক্যামেরা ব্যবহার। স্রোতযুক্ত পানিতে চালানোর জন্য রয়েছে আটটি অত্যাধুনিক ব্রাশলেস থ্রাস্টার, যার চারটি গভীরতা নিয়ন্ত্রণে এবং চারটি এর নিজস্ব মুভমেন্টের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ডুবুরি দিয়ে মাছ চাষ, নদীর তলদেশ পর্যবেক্ষণ, জাহাজ ও সমুদ্রের রক্ষণাবেক্ষণ, সমুদ্রের খনিজ সম্পদ আহরণ, নদী ও সমুদ্রের উদ্ধারকাজের তৎপরতা বৃদ্ধিসহ আরও বিভিন্ন ধরনের কাজ করা সম্ভব।
বিশ্বমঞ্চে মেলে ধরার ভাবনা
ব্র্যাকইউ ডুবুরি শুধু একটি প্রকল্প নয়; এটি একটি উৎসাহদায়ক পথযাত্রা। মূলত শনসিন মাকনামা পরিচালিত ‘স্পেয়ার পার্টস’ নামক চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রোবটকে বাস্তবে রূপদান করতেই আমাদের পথযাত্রা হয়। ২০১৮ সালে সাহস অর্জন করে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে শুরু হয় আমাদের আন্ডারওয়াটার রোভার নির্মাণের প্রকল্প; যা বাংলাদেশের প্রথম আন্ডারওয়াটার স্বনিয়ন্ত্রিত রোভার। ২০১৮ সালে আমরা প্রথম SAUVC২০১৮-তে অংশ নিয়ে সপ্তম স্থান অধিকার করি, যা পরে আমাদের আরও ভালো করার অনুপ্রেরণা জোগায়। এরপর রোবোসাব প্রতিযোগিতা সম্পর্কে জানতে পারি এবং সিদ্ধান্ত নিই সেখানে অংশগ্রহণ করার। কেননা রোবোসাব বিশ্বে সবচেয়ে বড় এবং কঠিন আন্ডারওয়াটার স্বনিয়ন্ত্রিত রোভার প্রতিযোগিতা। এ মাসে ব্র্যাকইউ ডুবুরি ৪.০ রোবোসাব ২০২৩ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশে আন্ডারওয়াটার রোবোটিকসের জন্য একটি নতুন প্রতিফলক স্থাপন, যা আমরা ইতোমধ্যে করেছি। বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে ডুবুরির মতো আন্ডারওয়াটার রোবটের বিকাশ সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ডুবুরিকে সমুদ্র ও নদী বন্দরের নিরাপত্তা এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আরও সক্ষম করে তুলতে চাই। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, ‘টাইটান’ সাবমেরিনের উদ্ধারকাজের জন্য ‘ভিক্টর-৬০০০’ যানবাহনটি অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশ থেকে এমন একটি বিশ্বমানের রোবট তৈরি করা যা কোনো মৃত্যুঝুঁকি ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন উদ্ধার অভিযান সফল করতে সক্ষম হবে।