× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সাইবার অপরাধ

নারী ও অল্প বয়সিরাই যখন লক্ষ্য

সুলতানা শারমীন

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৩ ১২:১৩ পিএম

নারী ও অল্প বয়সিরাই যখন লক্ষ্য

ইন্টারনেট সহজ করেছে আমাদের জীবন। কিন্তু এর কিছু কুফলও আছে। যার মধ্যে অন্যতম সাইবার অপরাধ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যার প্রধান লক্ষ্য নারী ও অল্প বয়সিরা। কঠিন আইন থাকার পরও ভুক্তভোগীরা অধিকাংশ সময় প্রতিকার হবে না ভেবে অভিযোগ করে না। 


আসমা আক্তার (ছদ্মনাম), বয়স ২৫। ঢাকার বাসিন্দা এই তরুণীর সঙ্গে ২০২০ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় এক তরুণের সঙ্গে। বিয়ের পর দুজনের সংসার সুখেই চলছিল। দাম্পত্য জীবনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো ধারণ করতেন নিজেরাই নিজেদের মুঠোফোনে। এক বছর যেতে না যেতেই আসমা আবিষ্কার করেন তার স্বামীর রয়েছে অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার স্বামী অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতেন। ইতোমধ্যে মোটা অঙ্কের যৌতুক চাওয়া শুরু করেন তার স্বামী। কোনোভাবেই যখন আসমা তার স্বামীকে আবার সংসারে ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না, তখন সিদ্ধান্ত নেন ডিভোর্সের। শুরু হয় নতুন উৎপাত। তার স্বামী নিজেদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি, ভিডিও ও কথোপকথন কাছের মানুষদের পাঠাতে থাকেন। হুমকি দেন নেটে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার। আসমা এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা থেকে মামলা করেছেন। স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাও চলমান। কিন্তু সামাজিকভাবে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তিনি, তার কোনো প্রতিকার পাননি।

আসমার মতো দেশের হাজারো নারী প্রতিদিনই শিকার হচ্ছেন সাইবার অপরাধের। ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে হুমকিসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে নারীসহ নানা বয়সের মানুষ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বাড়ছে এ ধরনের অপরাধের মাত্রা।


সাইবার ক্রাইম কী, এ বিষয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে মানহানিকর অথবা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করা, ছবি বা ভিডিও আপলোড করা, ছদ্মনামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দেওয়া, স্ট্যাটাস দেওয়া বা শেয়ার ও লাইক দিলেও তা সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কাউকে হুমকি দেওয়া, অশালীন কিছু পাঠানো বা দেশবিরোধী কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত হলেও তা সাইবার অপরাধ। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোনো কম্পিউটার, মোবাইল বা অ্যাকাউন্ট হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে অথবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলেও তা সাইবার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ ছাড়া অনলাইনে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও তা সাইবার অপরাধ।

সাইবার অপরাধ দমনে রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৪ ধারা অনুযায়ী, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতি, অনিষ্ট সাধন যেমন ই-মেইল পাঠানো, ভাইরাস ছড়ানো, সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ বা সিস্টেমের ক্ষতি করা ইত্যাদি অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। 

এ ছাড়াও ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে এমন কোনো কাজ করেন, যার ফলে কম্পিউটার রিসোর্সের কোনো তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা এর উপযোগিতা হ্রাস পায় অথবা কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন, তবে এটি হবে হ্যাকিং অপরাধ, যার শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে এগোলো হবে অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

কঠিন আইন এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থা সাইবার অপরাধ দমনে কাজ করলেও কমছে না এর মাত্রা। বরং নিত্যদিন নতুন উপায়ে হচ্ছে এ অপরাধ। সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে একটি জরিপ চালায় সংগঠনটি। চলতি বছর পঞ্চমবারের মতো এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিক্যাফ।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সাইবার অপরাধের শিকার ৫০.২৭ শতাংশ ভুক্তভোগী বিভিন্ন ধরনের সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এদের মধ্যে ৮০.৯০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। যদিও সাইবার বুলিংয়ের মাত্রা বিগত সালের তুলনায় কমেছে। ২০১৭ সালে সাইবার বুলিংয়ের হার ছিল ৫৯.৯০ শতাংশ।

দেশে অন্যান্য বছরের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে নতুন ধরনের সাইবার অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। ২০২২ সালের প্রতিবেদনে এই মাত্রা ছিল ১.৮১ শতাংশ। চলতি বছরের প্রতিবেদনে এই মাত্রা দাঁড়িয়েছে ৬.৯১ শতাংশে। এই নানামাতৃক প্রতারণার মধ্যে রয়েছে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাসে প্রতারণা, ঋণ দেওয়া, প্রতারণামূলক অ্যাপ ব্যবহার ইত্যাদি।

লিঙ্গভিত্তিক তুলনামূলক পরিসংখ্যানে সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের মধ্যে নারীদের হার সবচেয়ে বেশি, ৫৯.৭৩ শতাংশ। বিপরীতে পুরুষ ভুক্তভোগীর সংখ্যা ৪০.২৭ শতাংশ। এসব ভুক্তভোগীর মধ্যে অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার পুরুষের সংখ্যা ৫.০২ শতাংশ আর নারীর সংখ্যা ৪.৪৪ শতাংশ। অনলাইনে বা ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির শিকার হয়েছে ১৫.৪৭ শতাংশ নারী ও ১৪.২৮ শতাংশ পুরুষ। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি ব্যবহার করে হয়রানির শিকার হয়েছে ১১ শতাংশ নারী ও ১২.২১ শতাংশ পুরুষ। ফটোশপে ছবি বিকৃত করে অনলাইনে প্রচারণার শিকার হয়েছে ৯.১৬ শতাংশ নারী ও ৪.৩৩ শতাংশ পুরুষ। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে ২৫.১৮ শতাংশ নারী ও ২৬.৮১ শতাংশ পুরুষ। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরির মাধ্যমে অপপ্রচারের শিকার হয়েছে ৭.২৪ শতাংশ নারী ও ৩.০২ শতাংশ পুরুষ। মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে ১২ শতাংশ নারীর এবং ১০ শতাংশ পুরুষের।

সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ৭৫ শতাংশের বয়সই ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ২০১৮ সালের জরিপ থেকে এ পর্যন্ত একাধারে এই বয়সি ভুক্তভোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশই সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে অপপ্রচার ও আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার।


প্রতিনিয়ত সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু এই মানুষগুলোর অধিকাংশেরই তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক আইন সম্পর্কে নেই কোনো জ্ঞান। সমীক্ষা হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ৫৫ শতাংশই বিদ্যমান আইন সম্পর্কে জানে না। পাঁচ বছর ধরেই ভুক্তভোগীদের গড়ে প্রায় অর্ধেকই ছিল আইন বিষয়ে অজ্ঞ।

এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানানোর পরিমাণও বেশ উদ্বেগজনক। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভুক্তভোগীদের মধ্যে অভিযোগকারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। ২০১৮ সালের জরিপে যেখানে অভিযোগকারীর হার ছিল ৬১ শতাংশ, ২০২৩-এ গিয়ে তা কমে ২০.৮৩ শতাংশে নেমেছে।

সংস্থাটি ভুক্তভোগীদের আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ উদঘাটন করেছে। যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ ভুক্তভোগীই জানে না কীভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে হয়। ‍বিষয়টি গোপন রাখতে চান ২০ শতাংশ, অভিযোগ করেও লাভ হবে না এই ভেবে ব্যবস্থা নেননি ১৯ শতাংশ, আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানির ভয়ের কথা জানিয়েছেন ১৮ শতাংশ ভুক্তভোগী। এ ছাড়া সামাজিক ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য ১১ শতাংশ, অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায় অভিযোগ করেননি ৫ শতাংশ। অন্যান্য কারণে অভিযোগ জানাননি ৩ শতাংশ ভুক্তভোগী।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা