আব্দুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৩ ১২:৪৯ পিএম
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৩ ১৩:০২ পিএম
জীবিকার তাগিদে পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান আমাদের দেশের মানুষ। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে এই মানুষগুলোর পাঠানো টাকা তথা রেমিট্যান্সই আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। বর্তমানে বিদেশের এই শ্রমবাজারে পুরুষদের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছেন নারীরাও। কিন্তু অধিকাংশ সময় তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে বিস্তারিত...
আর্থিক সচ্ছলতার আশায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে সৌদি আরব যান ৩০ বছর বয়সি আমেনা খাতুন (ছদ্মনাম)। ২০২১ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন ছয় মাস বয়সি এক সন্তান কোলে নিয়ে। আরব দেশটিতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে নিয়মিতই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন নিয়োগকর্তার মাধ্যমে। একপর্যায়ে এক সন্তানের জন্ম দেন। অবশেষে ওই সন্তানকে নিয়েই দেশে ফিরে আসেন আমেনা। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান জন্মদানের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক কারণে বাড়ি ফিরতে পারেননি তিনি। এমনকি তিনি যে দেশে ফিরে এসেছেন, সেই খবরও দেননি পরিবারকে। ফলে আশ্রয় নেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের লার্নিং সেন্টারে।
২০১৬ সালে সৌদি আরবের রিয়াদে পাড়ি জমান খুলনা জেলার সাবিনা আক্তার (ছদ্মনাম)। অভাবের জীবনে যে সচ্ছলতার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সেই আশায় গুড়েবাড়ি হয় দালালের কারণে। যে কাজ ও বেতনের কথা বলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটা না দিয়ে তাকে মাসিক মাত্র ৫শ সৌদি রিয়াল তথা বাংলাদেশি ১১ হাজার টাকায় তিন বাসায় গৃহকর্মীর কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই বছর কাজ করেও তার বেতন বাড়ানো হয়নি। উপরন্তু দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে তিনি ভাবতেন আত্মহত্যার কথা। কিন্তু পরিবার ও মেয়ের কথা ভেবে সেই পথে আর পা বাড়াননি। তাকে উদ্ধারের জন্য তিনি সেই সময় বাংলাদেশি এক সংবাদমাধ্যমে টেলিফোনে সাক্ষাৎকার দেন। সেই নরক থেকে বাঁচার আকুতি আজও কানে বাজে।
গাজীপুরের রাবেয়া খাতুন (ছদ্মনাম), বয়স ২৮। কাজ করতেন তৈরি পোশাক কারখানায়। স্থানীয় দালালদের প্ররোচনায় ২০২১ সালে উচ্চ বেতনে কাজের আশায় ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমান তিনি। কিন্তু যে আশায় বুক বেঁধে ভিনদেশে এসেছিলেন, সেখানে কাজে যোগ দেওয়ার পর বুঝতে পারেন তিনি জাহান্নামে এসে পড়েছেন। সৌদি আরবের যে বাসায় কাজ করতেন, সেখানকার মানুষেরা অমানবিক আচরণ করত তার সঙ্গে। বিশ্রামের সুযোগ তো ছিলই না বরং খাওয়া, এমনকি পানি পানের জন্যও অনুমতি নিতে হতো। ওই বাসায় কয়েক মাস থাকার পর তাকে পাঠানো হয় আরেক বাসায়। সেখানে গিয়ে তাকে নিয়মিত যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হতো। সেই সঙ্গে শারীরিক প্রহার তো ছিলই। এভাবে মাসখানেক যাওয়ার পর একদিন সুযোগ পেয়ে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন রাবেয়া। দেশে ফিরে এলেও দুঃসহ সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে আজও।
পরিবার ছেড়ে বিদেশে যাওয়া দেশের অধিকাংশ অভিবাসী নারী গৃহকর্মী হচ্ছেন নির্যাতনের শিকার। দেশে ফেরার পর তাদের মুখে নির্যাতনের ভয়ংকর বর্ণনা শুনে আতঙ্ক জাগে মনে। নির্যাতিত যেসব নারী পালিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের শরীরেও নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট। দেশে ফিরে তারা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুললেও অধিকাংশই সামাজিক কারণে মুখ বন্ধ রাখেন। বিদেশে নারীকর্মীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সামনে বারবার তুলে ধরা হলেও অবস্থার বাস্তবিক উন্নতি কতটা ঘটেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রথম নারীকর্মীদের বিদেশে যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালে। প্রতি বছরই বিভিন্ন সংখ্যক নারীকর্মী হয়েছেন অভিবাসী। সেই হিসাবে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত বিগত ৩২ বছরে বিদেশে কর্মী হিসেবে গিয়েছেন ১১ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৮ জন নারী। ২০২৩ সালের প্রথম অর্ধে ৪২ হাজার ২২৬ জন নারী কাজের উদ্দেশ্য গিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বছর শেষে এই সংখ্যা লাখে পৌঁছাবে বলেই মনে করছেন মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অভিবাসী এই নারী শ্রমিকদের প্রধান গন্তব্য সৌদি আরব হলেও জর্ডান, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, লেবানন, যুক্তরাজ্য এবং মরিশাসেও যাচ্ছেন আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায়। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, হংকং, সাইপ্রাসেও কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন নারীরা। ব্রুনাই, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজারও উন্মুক্ত হয়েছে নারীদের জন্য দুই বছর ধরে।
ভাগ্য বদলের আশায় বিদেশগামী দেশের প্রায় ১২ লাখ নারীর সবাই যে স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন ভিনদেশে, তাদের সেই স্বপ্ন কি আদৌ পূরণ হয়েছে? এক কথায় উত্তর, মোটেই হয়নি। উপরন্তু নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই দেশে ফিরেছেন। অনেকে ফিরেছেন লাশ হয়ে।
বিদেশে কর্মরত নারীকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মৃত্যু ঘটছে সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন, ওমান ও আরব-আমিরাতে। নিয়োগকর্তার মাধ্যমে যৌন নির্যাতন, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের জন্য আত্মহত্যার নজিরও আছে অহরহ। এ ছাড়াও অতিরিক্ত কাজের চাপ ও মানসিক যন্ত্রণার ফলে স্ট্রোকজনিত কারণেও তাদের মৃত্যু হচ্ছে। অভিবাসীকর্মী উন্নয়ন সংস্থার (ওকাপ) এক গবেষণা বলছে, ফেরত আসা নারীকর্মীদের ৬১ শতাংশ নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ১৪ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ৫২ শতাংশ নারীকে জোরপূর্বক দীর্ঘসময় কাজে বাধ্য করা হয়। আর নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন ৬৩ শতাংশ নারী। ৮৬ শতাংশকে ঠিকমতো বেতন দেওয়া হয় না।
শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি বিদেশ থেকে লাশ হয়ে দেশে ফেরা নারীশ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২২- এই তিন বছরে ৪০৪ জন নারীশ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। এই মানুষগুলোর মৃত্যুর কারণ নিয়েও দেখা দিচ্ছে প্রশ্ন। তিন বছরে দেশে আসা ৪০৪ জন মৃত নারী শ্রমিকের মধ্যে ২২৭ জনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা ছিল ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের রয়েছে আলাদা অভিবাসন কর্মসূচি। প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ৭১৪ নারীশ্রমিকের লাশ এসেছে দেশে। যার মধ্যে ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যুর সনদ লেখা লাশের সংখ্যা ২৬২। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে সৌদি আরব, জর্দান, লেবানন ও ওমানে। এই সময়ে মারা গিয়েছেন সৌদি আরবে ২০২ জন, জর্দানে ৯৬ জন, লেবাননে ৭৮ জন ও ওমানে ৫৮ জন। সালের হিসেবে ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মৃত্যু ঘটেছিল ২০২৯ সালে, ১৩৯ জন। এ ছাড়াও ২০১৬ সালে ৫২ জন, ২০১৭ সালে ৯৪, ২০১৮ সালে ১১০, ২০১৯ সালে ১৩৯, ২০২০ সালে ৮০, ২০২১ সালে ১২২ এবং ২০২২ সালে ১১৭ জন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৩৭ শতাংশ ছিল স্বাভাবিক মৃত্যু। এ ছাড়াও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত ১৯ শতাংশ, আত্মহত্যা ১৬, দুর্ঘটনা ১৫ এবং অন্যান্য কারণে ১৩ শতাংশ নারীশ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। মৃত নারীশ্রমিকের পরিবারের সদস্যসহ অভিবাসন-বিশেষজ্ঞরা মৃত্যুর এই কারণ বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচিপ্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘বিদেশে যাওয়ার পর এই নারীশ্রমিকরা তিন ধরনের সংকটের মুখোমুখি হন। প্রথমত, একটা বড় অংশ অভিযোগ করেন- তারা ওই দেশের খাবার, পরিবেশ, আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। ফলে প্রত্যাশিত বেতন পান না। দ্বিতীয়ত, তারা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে এবং ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না, তখন নিয়োগকর্তা কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। তৃতীয়ত, যে ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই তা হলো- যৌন নির্যাতন। এ নিপীড়ন-নির্যাতন এতটাই বীভৎস হয়ে থাকে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ওই দেশের অনেক নিয়োগকর্তা মনে করেন, নারীশ্রমিক তার কেনা দাস। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানো প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গৃহকর্মী পাঠানো সীমাবদ্ধ করেছে অথবা না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সৌদি আরব আমাদের ওপর এক রকম চাপ দিয়ে যাচ্ছে। নারী গৃহকর্মী না পাঠালে তারা পুরুষকর্মীদেরও নেবে না। যে নারীরা নিপীড়নের শিকার হন, তারা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা। আর্থিক ও সামাজিক দুর্বলতার কারণেই নাগরিক হিসেবে তারা প্রকৃত মর্যাদা পান না।’
নির্যাতিত এই নারীদের পুনর্বাসন ও সাহায্যের অবস্থাও বেশ অপ্রতুল। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে যোগাযোগ করে বা অভিযোগ জানিয়েও তারা অধিকাংশ সময় কোনো সাহায্য বা প্রতিকার পায় না। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সঠিক নীতিমালা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
যদিও বর্তমানে সরকারের তরফ থেকে বিদেশে নারীকর্মীদের সুরক্ষা ও তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৃহকর্মী পেশায় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুক নারীকর্মীদের গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন কাজের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। যে দেশে যেতে ইচ্ছুক সে দেশের ভাষা, আইন, খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য ও সামাজিক রীতিনীতি বিষয়ে ধারণা দিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ৪৩টি কেন্দ্রে। এর আগে ৩০ দিন মেয়াদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও বর্তমানে এই প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়েছে ২ মাস। বিগত অর্থবছরে ২২ হাজার ৬২৭ জন নারী এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। বিদেশগামী নারীকর্মীদের সুরক্ষা দিতে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে ‘নারীকর্মী সুরক্ষা সেল’। এ ছাড়াও বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোয় শ্রমকল্যাণ উইংয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে ‘সেফ হোম’। কোনো কারণে বিপদে পড়লে নারীকর্মীদের উদ্ধার করে এসব সেফ হোমে আশ্রয় দেওয়া হয়ে থাকে।
অভিবাসী কোনো নারী শ্রমিকই যেন আর কখনও নির্যাতনের শিকার কিংবা জীবনপ্রদীপ নিভে গিয়ে লাশ হয়ে দেশে না ফেরে, এমন আশা আমাদের সবার।