আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৩ ০৮:৫৯ এএম
সোনাদিয়ার কালাদিয়া চরে খাবার খাওয়ায় ব্যস্ত দুটি গুলিন্দাঠোঁটি চাপাখি।
সোনাদিয়া দ্বীপের কালাদিয়া চরে মহাবিপন্ন চামচঠোঁটি চাপাখির খোঁজে ছয়জনের টিমে এসেছি। একসময় চামচঠোঁটি চাপাখির ছবি তুলতে সক্ষম হলাম। ওর ছবি তুলতে তুলতে লক্ষ করলাম জোয়ারের পানি বেড়ে চলেছে। সবাই দ্রুত সামনের দিকে এগোতে লাগল। কিন্তু কাদাময় জোয়ারের পানিতে ভালোভাবে হাঁটতে না পারায় আমি একটু পিছিয়ে পড়লাম।
সবাই যখন উঁচু জায়গায় পৌঁছে গেছে আমি তখন মাত্র জোয়ারের পানি পাড়ি দিয়ে একটু শুকনো জায়গায় উঠলাম এবং লক্ষ করলাম বাম দিকে একচিলতে জেগে থাকা চরের অংশে বিশাল একঝাঁক পাখি। বাইনোকুলারে চোখ রেখে ভালো করে খুঁজতে খুঁজতে কাদাপানিতে ঠোঁটমোটা চাপাখির পাশে লম্বা ও বাঁকা চঞ্চুর কয়েকটি পাখিকে দেখলাম অগভীর পানিতে চঞ্চু চালাতে। ক্যামেরার শাটারে সমানে ক্লিক করে গেলাম। জোয়ারের পানি আমার পা স্পর্শ করা পর্যন্ত ক্লিক করে গেলাম। ঢাকায় এসে কদিন পরে কম্পিউটারে ভালোভাবে ছবিগুলো পরীক্ষা করতেই ওদের পরিচয় নিশ্চিত হলাম। আমার পক্ষী তালিকায় আরেকটি নতুন পাখি যোগ হলো সোনাদিয়া ট্রিপ থেকে।
নতুন যোগ হওয়া পাখিটি এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান শীতের পরিযায়ী গুলিন্দাঠোঁটি চাপাখি। ইংরেজি নাম Curlew Sandpiper। বৈজ্ঞানিক নাম Calidris ferruginea। ওদের মূল আবাস ইউরোপ ও উত্তর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। গুলিন্দাঠোঁটি চাপাখি দেখতে অনেকটা বাঁকা চঞ্চু চাপাখির (dunlin) মতো। কিন্তু ডানলিনের চেয়ে ওর চঞ্চু বেশি লম্বা ও নিচের দিকে বেশি বাঁকানো, পা বেশি লম্বা ও কোমর সাদা। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য ১৮-২৩ সেন্টিমিটার (সেমি), প্রসারিত ডানা ৩৮-৪৬ সেমি ও ওজন ৪৪-১১৭ গ্রাম। প্রজননহীন পাখির দেহের ওপরটা ধূসরাভ-বাদামি ও নিচটা সাদা। সুস্পষ্ট সাদা ভ্রু-রেখা। বুকে সরু ধূসর-বাদামি ডোরার আমেজ রয়েছে। কোমর প্রশস্ত। প্রজননকালে কাঁধ-ঢাকনি, ডানা-ঢাকনি ও ডানার তৃতীয় সারির পালকের পাড় হয় লালচে-কালো। মাথার চাঁদি, মুখমণ্ডল ও দেহের নিচের দিক লালচে বা গাঢ় তামাটে বর্ণ ধারণ করে। লেজতল-ঢাকনি সাদা, তাতে কালচে ছিট থাকে। ওড়ার সময় ডানার হালকা ডোরা ও স্পষ্ট সাদা কোমর চোখে পড়ে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ঋতুতেই চোখ বাদামি, চঞ্চু কালো এবং পা ও পায়ের পাতা খয়েরি থেকে কালো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম।
শীতকালে ওদেরকে দেশের সব উপকূলীয় এলাকা, দ্বীপাঞ্চল ও নদীর কাদাচরে অন্যান্য ছোটো জলচর পাখির বড়ো মিশ্র ঝাঁকে বিচরণ করতে দেখা যায়। দিবাচর পাখিগুলো অল্প পানিতে হেঁটে বা কাদামাটিতে দৌড়ে নরম কাদায় লম্বা চঞ্চু ঢুকিয়ে জলজ পোকামাকড় ও খুদে অমেরুদণ্ডী প্রাণী খুঁজে খায়। ওড়ার সময় মনোরম সুরে ‘চিররিপ-চিররিপ-চিররিপ’ শব্দে ডাকে। জুন থেকে জুলাই মাসে প্রজননকালে সাইবেরিয়ার উত্তরে জলাশয় ঘেঁষে ও শিলাময় তুন্দ্রা অঞ্চলের ঢালু স্থানে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিমের রং বাদামি বা লালচে-বাদামি ছোপযুক্ত ঘিয়ে ফ্যাকাশে জলপাই। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে প্রায় ২১ দিনে। ছানাদের দেহে ওড়ার পালক গজায় ১৪-১৬ দিনে। মা একাই ছানাদের লালনপালন করে। আয়ুষ্কাল ৭-৮ বছর।