আহমাদ শামীম
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৩ ১৩:০১ পিএম
প্রতি বছর বর্ষার শুরুর সময় থেকে বছরের শেষভাগ পর্যন্ত দেশে বিস্তার ঘটে ডেঙ্গুজ্বরের। নীরব মহামারির মতো এ ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রায় সব জেলায়। এডিস মশাবাহিত প্রাণঘাতী এ ব্যাধির ইতিহাস, বিবর্তন ও বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ লেখা....
রাজনীতি-অর্থনীতির পাশাপাশি দেশের বর্তমান সময়ে অধিক আলোচিত সংবাদ ডেঙ্গু। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীরা ভিড় জমাচ্ছেন প্রতিদিন। সবখানেই ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে’ অবস্থা। প্রাণঘাতী এ জ্বর ইতোমধ্যে মহামারির আকার ধারণ করেছে যেন।
প্রতিদিনের সংবাদপত্রের প্রধান খবর হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এডিস মশাবাহিত ভাইরাসজনিত এ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর ১২ জুলাই পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ৮৮ জন। দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৩ হাজার ৭৯১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এ বছর জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ১৪৩ জন। গত বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা ছিল ২৮১ এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৩৮২।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়তই। সরকারি ও বেসরকারি কোনো উদ্যোগই যেন কাজে আসছে না। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে বিপন্ন হয়ে উঠেছে জনজীবন। কবে, কোথায় এবং কীভাবে এ প্রাণঘাতী ডেঙ্গু আমাদের জীবনে প্রবেশ করেছে, তারই ইতিহাস নিয়ে আজকের এ লেখার অবতারণা।
ডেঙ্গুজ্বরের ইতিহাস
সমসাময়িক সময়ে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গু আলোচিত ব্যাধি হিসেবে পরিচিতি পেলেও, এর ইতিহাস কিন্তু বেশ প্রাচীন। রোগটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন চীনের চিকিৎসাসংক্রান্ত নথিপত্রে। ৯৯২ খ্রিস্টাব্দে চীনে এ রোগটি শনাক্ত হয়। তবে কারও কারও মতে, চীনের জিন রাজবংশের সময়ও (২৬৫-৪২০ খ্রিস্টপূর্ব) ডেঙ্গুর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে এ রোগকে উড়ন্ত পোকার কারণে ‘বিষাক্ত পানির’ রোগ বলে অভিহিত করা হয়।
১৭৭৯ সালে রোগটির শনাক্ত এবং নামকরণের পরের বছরই প্রথম স্বীকৃত ডেঙ্গু মহামারি দেখা দেয় এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকায়। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথার কারণে একে ‘হাড়ভাঙা জ্বর’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হতো। মূলত আঠারো ও উনিশ শতকে বিশ্বব্যাপী যখন নগরায়ণ ঘটতে থাকে, তখন থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী আর্থসামাজিক নানান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এশিয়া, আফ্রিকাসহ উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে বানের জলের মতো দ্রুত ঘটতে থাকে ডেঙ্গুর বিস্তার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, মহামারি আকারে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইনের ম্যানিলায়। পঞ্চাশের দশকে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু ১৯৮০ সাল থেকে ডেঙ্গু প্রায় প্রতি বছরই মহামারি আকার ধারণ করে। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে ডেঙ্গুকে ম্যালেরিয়ার পর মশাবাহিত প্রধান রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
১৯৪৩ সালে জাপানের দুই রোগতত্ত্ববিদ রেন কিমুরা ও সুসুমু হোত্তা প্রথম ডেঙ্গু ভাইরাসকে আলাদা করেছিলেন। এ দুজন ওই বছর জাপানের নাগাসাকিতে ঘটে যাওয়া ডেঙ্গু মহামারির সময় নেওয়া রোগীদের রক্তের নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাস চিহ্নিত করেন। ১৯৪৫ সাল নাগাদ ইউরোপের দুই বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট অ্যালবার্ট বি. সাবিন ও ওয়াল্টার স্লেসিনজারও নিজস্ব গবেষণায় ডেঙ্গু ভাইরাস আলাদা করন।
‘ডেঙ্গু’ নামটি যেভাবে এলো
এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুজ্বরের ‘ ডেঙ্গু’ নামটি কীভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা নিয়ে আছে নানা মত। ধারণা করা হয়, আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষার প্রবাদ ‘কা-ডিঙ্গা পেপো’ থেকে ডেঙ্গু নামটি চয়ন করা হয়েছে। এ বাক্যবন্ধের অর্থ হলো, ‘শয়তান তথা মন্দ আত্মার শক্তির কাছে আটকে যাওয়ার মতো ব্যথা বা খিঁচুনি’। গবেষকদের কারও কারও মতে, সোয়াহিলি ভাষার ‘ডিঙ্গা’ শব্দটি স্প্যানিশ শব্দ ডেঙ্গু থেকে উদ্ভব হয়েছে। যার অর্থ ‘সতর্ক থাকা’। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর ও হাড়ের ব্যথার কারণে চলাচলে সতর্ক করতে বোঝানো হয়। ডেঙ্গু নামের উৎপত্তি নিয়ে আরেকটি প্রচলিত ধারণা হলো, ওয়েস্ট ইন্ডিজের দাসেরা এ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা এঁকেবেঁকে বা স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারত না বলে তাদের ‘ডান্ডি ফিভার’ বলে ডাকা হতো, সেখান থেকেও ডেঙ্গু নামটি আসতে পারে।
কেন বিস্তার ঘটছে ডেঙ্গুর
বিশ্বজুড়ে কেন এবং কীভাবে বিস্তার ঘটল ডেঙ্গুর, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অবস্থিত ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউরিয়েল কির্টন। তিনি মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য নগরায়ণের ধরনকে দায়ী করেছেন। তার মতে, বিগত সাত দশকে বিশ্বজুড়ে নগরায়ণের হার ২০ থেকে বেড়ে উন্নীত হয়েছে ৮০ শতাংশে; যা এডিসের বিস্তার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলেই তিনি মনে করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার একশর বেশি দেশে ডেঙ্গুজ্বর বিস্তার লাভ করেছে এবং বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ৪ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে। জলবায়ু পরিবর্তন, ভাইরাসের বিবর্তন, অপরিকল্পিত ও অত্যধিক জনসংখ্যার নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত এবং অস্বাস্থ্যকর বর্জ্য ও পানি ব্যবস্থাপনার কারণেই মূলত ডেঙ্গুজ্বর ছড়িয়ে পড়েছে এক দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ডেঙ্গুর বিস্তার
একটা সময় যে অসুখ বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মানুষকে আক্রান্ত করত, মশাবাহিত এ রোগ এখন ইউরোপ মহাদেশের মতো তুলনামূলক শীতল প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ছে; যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করছেন গবেষকরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্যমতে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের সামগ্রিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে; যার কারণে ইতোমধ্যে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো ভাইরাস বহনকারী মশারা গ্রীষ্মমণ্ডল থেকে আরও উচ্চভূমিতে চলে যাচ্ছে। যার কারণে এশিয়া ও আমেরিকা মহাদেশ ছাড়িয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু।
বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ব্ষিয়ক সংস্থা ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের তথ্যমতে, বর্তমান সময়ে দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। এ মহাদেশের চারটি দেশ ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু ও আর্জেন্টিনায় চলতি বছরের মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা যথাক্রমে ১৫ লাখ ১৫ হাজার ৪৬০, ১ লাখ ২৬ হাজার ১৮২, ১ লাখ ১৫ হাজার ৯৪৯ ও ৯৯ হাজার ৪৫৬।
এ সময়ে দেশগুলোয় মৃত্যুবরণ করেছেন যথাক্রমে ব্রাজিলে ৩৮৭, পেরুতে ১৬৬, বলিভিয়ায় ৭০ ও আর্জেন্টিনায় ৬০ জনের বেশি। এ ছাড়া এশিয়া অঞ্চলের আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, চীন, লাওস, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অস্ট্রেলিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব।