মাহবুব আলম রিয়াজ
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩ ১২:৪৮ পিএম
ওপরে ডানে আশফাক, বামে রাশিক, নিচে রিয়াসাত
নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মোড়কে ব্যবহার করা পলিব্যাগ নষ্ট করে পরিবেশ, তৈরি করে জলাবদ্ধতা।পলিব্যাগের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত চলছে গবেষণা।‘ইকোভিয়া’ নামক প্রতিষ্ঠান পলিব্যাগ তৈরি করে ব্যবহার অনুপযোগী পুরোনো কাপড় হতে। পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ তৈরির পেছনে উদ্যমী তিন তরুণের গল্প শোনাচ্ছেন মাহবুব আলম রিয়াজ
সমস্যা থেকে শুরু
আমাদের ব্যবহৃত পণ্যের বেশিরভাগ পরিবেশে মিশলেও কিছু পণ্য মাটিতে না মিশে নষ্ট করে পরিবেশ, কমায় উর্বরতা। পণ্যের উপাদান যেগুলো অবিষাক্ত পদার্থে ভাগ হয়ে পরিবেশে মেশে তা হলো বায়োডিগ্রেডেবল পদার্থ। যেমন- গাছের পাতা বা ফলমূলের আবরণ যখন মাটিতে মেশে তখন অণুজীবের ক্রিয়াকলাপের দরুন তা জৈবসারে রূপান্তর হয়। এতে উৎপন্ন হয় গ্যাস, পানি, বায়োগ্যাস ও অন্যান্য উপাদান। কিন্তু নন-বায়োডিগ্রেডেবল পদার্থের ক্ষেত্রে পোহাতে হয় নানা সমস্যা।
নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মোড়ক কিংবা ইন্ডাস্ট্রি হতে রপ্তানিমুখে পণ্য পাঠাতে ব্যবহার হয় প্লাস্টিক সামগ্রী। এতে বছরে কয়েক লাখ মিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক জমা হচ্ছে। এগুলো হয় পোড়ানো হয় বা পানিতে মেশানো হচ্ছে । পণ্য প্যাকেটিংয়ে ব্যাগের চাহিদা ও সচরাচর পলিব্যাগের সমস্যা উত্তরণের জন্য টিম ইকোভিয়ার মাথায় আইডিয়া আসে পরিবেশ ঠিক রাখতে। কাজে লাগে পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ তৈরিতে।
ইকোভিয়ার পেছনে আছেন তিনজন- রিয়াসাত জামান, রাশিক হাসান, আশফাকুল আজম আফনান। রিয়াসাত পড়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাশিক ও আশফাক পড়েছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। তারা প্রতিষ্ঠানের নাম ইকোভিয়া দেন ইংরেজি শব্দ ইকোফ্রেন্ডলি বা পরিবেশবান্ধব এবং ভিয়া (Via) বা পথ শব্দ থেকে।
ইকোভিয়ার অগ্রসরতা
দেশে পোশাকশিল্পের ফেলনা অব্যবহৃত টুকরা কাপড় বা ঝুট তাদের পলিব্যাগ তৈরির মূল কাঁচামাল। এসব কাঁচামালে পাওয়া যায় সেলুলোজ। দেশে টেক্সটাইল শিল্প বেশি হওয়ায় সেলুলোজ খুব সহজে পাওয়া যায়। তা ছাড়া কাপড়, গাছ, কাগজ এসবেও সেলুলোজ পাওয়া যায়।
শুরুর দিকে তারা পলিব্যাগের নানা ধরনের প্রোটোটাইপ বা নমুনা তৈরি করে। নমুনা তৈরিতেই সময় যায় প্রায় দেড় বছর। অতঃপর মাটিতে মেশে এমন পলিব্যাগের নমুনা তৈরি হয়। নিজেদের কাজ দেখিয়ে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান তৈরিতে ইনভেস্টমেন্টের অর্থ জোগাড় করেন তারা। অর্থ জোগাড় হলে শুরুর দিকে পলিব্যাগ বানানো হতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়। মার্কেটিং করে অর্ডার এনে সেসব প্রতিষ্ঠান তাদের চাহিদামতো পণ্য তৈরি করত। শুরুতে কম সংখ্যক অর্ডার এলেও তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রায় দুই বছর পর নিজেরা মেশিনারি কিনে ঢাকার টঙ্গীতে কারখানা স্থাপন করেন। পলিব্যাগের ভালো মানের জন্য প্রতিনিয়ত অর্ডার বাড়ছে, এতে কর্মচারী ও নিজেদের শ্রম দিয়ে পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছিয়ে দিচ্ছে।
কেস সলভিং থেকে শেখা
২০১৭ সালের দিকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষ থাকাকালীন সময় থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস কেস কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ শুরু করে। প্রতিটি প্রতিযোগিতায় তারা উদ্ভাবনী আইডিয়া নিয়ে কাজ করত। প্রতিযোগিতায় সফলতাও আসে তাদের। বুয়েটে সিএসই ফেস্টে তারা প্রথম সফলতার মুখ দেখে, হয়েছিল দ্বিতীয়। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশগ্রহণ করে পুরস্কার অর্জন করে। এতে ইন্ডাস্ট্রিতে যা সমস্যা তৈরি হয় এবং তা উত্তরণের উপায় নিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়ে।
বিজনেস কেস কম্পিটিশনগুলোতে ইন্ডাস্ট্রির সমস্যাগুলো সমাধান চাওয়া হয়। সমস্যার উপায় বের করা, এর যৌক্তিকতা, টেকসই কিনা, খরচ বা প্রতিষ্ঠান কত বছরে তাদের মূলধন ফিরে পাবে ইত্যাদি বিষয়ের উপায় বের করতে হয়। তিনজনের মধ্যে রাশিক বিজনেস কেসের স্ট্যাটেজি ও ফিন্যান্সে বেশি পারদর্শী ছিল, আশফাক মার্কেটিং ও নেগোসিয়েশনে আর রিয়াসাত পারদর্শী ছিল স্ট্যাটেজি ও টেকনিক্যাল অংশে।
ইকোভিয়া প্রতিমাসে ১০ লাখ পিস পলিব্যাগ তৈরি করে। তা বিক্রি করে শপিংমল, পোশাক ব্যান্ড ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। যেহেতু এটা খোলা বাজারে বিক্রি না করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে তা হলো ই২ই বা বিজনেস টু বিজনেস পণ্য লেনদেনের প্রক্রিয়া। প্রতিষ্ঠানের বয়স প্রায় চার বছর। প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে পরিসর, বাড়ছে কর্মচারী। ইকোভিয়ার প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে চায়, মানুষকে পরিবেশ নিয়ে সচেতন করতে চায়, তারা জানাতে চায় ইকোভিয়ার পলিব্যাগ পরিবেশবান্ধব, যা মিশবে মাটিতে।